চাকরিতে দক্ষতাই পারে সফলতার গল্প বানাতে

পেশাগত জীবনে সফল হওয়ার জন্য দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। প্রশ্ন হলো দক্ষতাটা আসবে কোথায় থেকে? আমরা যদি বাংলাদেশের বর্তমান উচ্চশিক্ষার কথা চিন্তা করি, আমরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক বিষয়ে বেশি আগ্রহী।

মানুষ চিকিৎসক ও প্রকৌশলী কেন হতে চায়? কারণ, আয় বেশি। যদিও মানুষের সেবা করবেন—এমন মন-মানসিকতায় অনেকেই এ পেশায় আসেন। কিন্তু অনেকের টাকার দিকেই নজর বেশি। দেখা যায়, এমন বিষয়গুলোয় পড়ার আগ্রহ অনেকের প্রবল। কারণ, এসব বিষয়ের বাজারে চাকরি ভালো আছে।

দেখা যাচ্ছে, বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের বাজারে কোনটার চাহিদা বেশি এবং আয় বেশি, সেটার দিকেই নজর দিই। সে ক্ষেত্রে পছন্দ, অপছন্দ, মনন, মেধা, সৃজনশীলতা—এগুলোর তেমন গুরুত্ব আমরা দিতে চাই না। বিষয় নির্ধারণ যেমন একটা বিষয়, তেমন আরেকটা বিষয় হচ্ছে পেশাগত জীবনে সফল হওয়া। যেখানে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান আর দক্ষতাকে একসঙ্গে করে অভূতপূর্ব সাফল্য আনা সম্ভব। মৌলিক গবেষণা, নতুন কিছু নিয়ে ভাবনা, ক্রিয়েটিভ কিছু চিন্তা করা। সেগুলোর ক্ষেত্র থাকলেও এখনো তেমনভাবে প্রসারিত হয়নি। সেগুলো থেকে সম্মান, মর্যাদার পাশাপাশি আমাদের যে টাকার বিষয়, সেটা এমনিতেই চলে আসে। আলাদাভাবে ভাবার দরকার পড়ে না।

পেশাজীবনে সফল হতে হলে প্রথম যা দরকার, সেটা হচ্ছে দক্ষতা। বিশেষ করে এই টেকনিক্যাল বিষয়গুলোয় দক্ষতা ছাড়া কোয়ালিফিকেশনের কোনো মূল্যই নেই। কিন্তু সমস্যাটা হয় সেই দক্ষতাটা অর্জন করার পদ্ধতিতে। আমরা যখন বলি দক্ষতা। দক্ষতা তো কোনো সৃজন ছাড়া আসবে না। যেমন আমি যদি ভালো ছবি তুলতে চাই, আমার ফটোগ্রাফির সব জ্ঞান-বুদ্ধি যেমন দরকার, ঠিক তেমনি প্রচুর পরিমাণে ছবি তুলে সেটার ফলাফল দেখে নিজেকে শোধরানোও দরকার। আমাকে একজন বলেছিল, ভালো ছবি তুলতে হলে কয়েক হাজার ছবি আগে তোলো। তারপরই তুমি ভালো ছবি তুলতে পারবে। আমি জানি না এটাই সঠিক পলিসি কি না, কিন্তু সাধারণভাবে এটা বলতে পারি অনুশীলন ছাড়া দক্ষতা আনা কঠিন। অনুশীলনের সঙ্গে দক্ষতাকে ব্যস্তানুপাতিক বলা যেতে পারে। অনুশীলন যত বাড়ানো যাবে দক্ষতা তত পরিপূর্ণতা পাবে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। এখানে এই অনুশীলনের জায়গাটা এখনো খুবই সংকীর্ণ। এখানে ‘এসো নিজে করি’ টাইপের কিছু জিনিস আছে, অর্থাৎ কিছু হাতেকলমে শেখানো জিনিস আছে। সেগুলোর পরিপূর্ণ প্রয়োগের আগেই শেষ হয়ে যায়। এ ছাড়া আমরা বিভিন্ন কারণ দেখাই যে আমাদের সঠিক মানসম্মত ল্যাব নেই, ল্যাবে ইনস্ট্রাকশন নেই, মোটিভেশন নেই ইত্যাদি বিভিন্ন কারণ দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা ওই দক্ষতা অর্জনের যে জায়গা, সেখানে দুর্বল থেকে যাই। যার ফলে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা ভীতি সঞ্চার হয় ভবিষ্যতের জন্য। যেখানে তাদের শেখাটাকে আগ্রহ হিসেবে নেওয়ার কথা, সেখানে কোনটা পড়ব কোনটা না পড়ব, এমন একটা জিনিস চলে আসে। সৃজনশীলতার যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করানো হলেই দক্ষতার বিষয়টা এখনো সেকেলে রয়ে গিয়েছে।

আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার কথা বলি, এখানেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পদ্ধতিতে কম্পিউটারের সময় কম্পিউটার শেখানো হয় বা অন্য যেকোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে সেটা অপর্যাপ্ত। এখানে অবশ্যই অনেক প্র্যাকটিকেল টার্ম থাকে, অনেক ক্রেডিট অর্জন করতে হয়, এটা সত্য। কিন্তু যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে দরকার মোটিভেশন এবং বাড়তি সময় ব্যয় করে দক্ষতাটাকে অর্জন করা। সেটা যেকোনো মূল্যেই হোক।

যদি প্রয়োজন হয় কারিকুলাম আধুনিকায়ন করতে গিয়ে যদি প্র্যাকটিকেল বা ব্যবহারিক কাজ বাড়িয়ে দেওয়া যায়, সেটাও একটা সমাধান হতে পারে। আর বর্তমানে যে কারিকুলাম আছে, সেটার মধ্য থেকেই যদি কাউকে দক্ষ হতে হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে বাড়তি শ্রম দিতে হবে। এটা হতে পারে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের ক্ষেত্রে। একটা উদাহরণ টানলে, অল্প টাকায় কী করে বাড়ি বানানো যায়, সিমেন্ট ব্যবহার করলে কেমন খরচ, সিমেন্ট-ইট দিয়ে করলে কেমন খরচ, কাঠ দিয়ে করলে অথবা এমন কিছু ডিভাইস আছে রি-ইউজেবল বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে করা যায়। ইউটিউবে গেলে আমরা বিভিন্ন ভিডিও দেখতে পাই, যেগুলোর মধ্যে কতগুলো আছে একদম টিউটোরিয়াল টাইপের অর্থাৎ একদম শুরু থেকে শিখিয়ে দেবে তারা কীভাবে করে। সেদিন দেখেছিলাম ফোম এবং আটা দিয়ে স্বল্প খরচে অত্যন্ত সুন্দর একটা ঘর বানানো সম্ভব সেটার ভিডিও ইউটিউবে রয়ে গেছে।

আমাদের গ্লোবাল ভিলেজটাকে এখন কাজে লাগানোর পুরোপুরি সময়। আমরা যদি ইন্টারনেট থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বেছে নিতে পারি এবং সেগুলো কাজে লাগাতে পারি, তাহলে হয়তো দক্ষতার মাপকাঠি লাল দাগ ছেড়ে সবুজে এসে সাফল্যের হাতছানি দেবে। তবে শুধু এর ওপর নির্ভর করেই বসে থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে যেটা বলতে চাচ্ছি, সেটা হচ্ছে যে বিষয়টা নিয়ে আমরা কাজ করব, সে বিষয়টার ওপর জ্ঞান তো আমাদের লাগবেই। পাশাপাশি দক্ষতাও আমাদের লাগবে এবং এই দক্ষতা বাড়ানোর জন্য হয়তো আমাদের সময় এসেছে সবকিছু নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর। হোক সেটা কারিকুলাম। হোক সেটা আমাদের শেখার যে ধরন এবং যদি দক্ষতা আমরা অর্জন করতে পারি, তখন দেশে–বিদেশে আমাদের কাজের কোনো সমস্যা হবে না। হোক সেটা চাকরি, ব্যবসা, উদ্যোক্তা বা অন্য কিছু। কিন্তু দক্ষতার ঘাটতি থাকার কারণে আমরা যারা প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে যখন দক্ষ লোকের খোঁজে থাকি, তখন আমরা হাত বাড়াই পার্শ্ববর্তী দেশে। আমরা হন্যে হয়ে খুঁজি অনেক বছরের অভিজ্ঞ পদধারীদের। কিন্তু আমরা সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের যে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করে নেব, সেই ধরনের পরিবেশ আমাদের নেই। সে ক্ষেত্রে বিকল্প হতে পারে আমাদের কারিকুলামে দক্ষতাটাকে বেশি ফোকাস করা। অর্থাৎ হাতেকলমে শেখার যে ব্যাপারটা আছে, সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে সঙ্গে পর্যাপ্ত জ্ঞান তো লাগবেই। পাশাপাশি দক্ষতার মাপকাঠিতে সে কতটা অর্জন করতে পারল, তার মাপকাঠিতেই হবে তার চাকরি, ব্যবসা, সাফল্য।

সুপারিশটা হচ্ছে যদি আমরা কারিকুলামে দক্ষতা অর্জনের ব্যাপারটাকে অধিকতর গুরুত্ব দিই এবং কারিকুলামে যেটুকুই আছে বর্তমানে সেটাও শুধু পরীক্ষা পাশের জন্য নয়, আরও ভালো করে শেখার জন্য যদি বাড়তি সময় দিই কোর্সে কিংবা কোর্সের বাইরে, তাহলে আমরা যখন পেশাগত জীবনে যাব তখন নিজে যেমন ভালো অনুভব করব তেমনি জাতীয়ভাবেও আমাদের আর পেশাজীবী আনার জন্য বিদেশের নির্ভর হতে হবে না এবং আমাদের দেশের লোকেরাও বিদেশে গিয়ে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হবে না। তখন আমরা দক্ষতার ছাপ রাখতে পারব।

*লেখক: বিভাগীয় প্রধান, সফটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি