প্রকৃতি ও পাহাড়প্রেমীদের স্বর্গ নীলগিরিতে খানিকটা সময়

পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনেকেই পাহাড়–পর্বত ঘুরতে যান। ছবি: সংগৃহীত
পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনেকেই পাহাড়–পর্বত ঘুরতে যান। ছবি: সংগৃহীত

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে হাইস্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দীর্ঘ ১৭ বছর পরে এক দিনের ট্যুরে গেলাম। হাইস্কুলজীবন শেষ করার পরে রোজার ঈদের ১-২ দিন আগে বেশ কয়েকবার একত্রে ইফতার করার সুযোগ হয়েছিল তাদের সঙ্গে। কিন্তু একত্রে বেড়ানো সময় সুযোগ হয়ে ওঠেনি কখনো। তাই এ বছর প্রবাস থেকে দেশে বেড়াতে এসে দারুণ একটি ভ্রমণের অংশ হয়ে যাই।

দেশের দক্ষিণ–পূর্ব অঞ্চলের পার্বত্য জেলাগুলো পর্যটন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন ও মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে দেশীয় পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে প্রতিবছর। খাগড়াছড়ির রামগড় ও রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদে বেড়ানো হয়েছে। তাই এবার বান্দরবান বেড়ানোর আগ্রহ ছিল।

লিসবন থেকে বাড়ি আসার পর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িক বিভিন্ন কাজে বেশির ভাগ সময়ে বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। আমাদের এই ভ্রমণের দিনেও ঢাকায় ছিলাম। সাধারণত বৃহস্পতিবারে ঢাকা থেকে ফিরতে বাসের টিকিট পেতে ভালোই ঝামেলা পোহাতে হয়। কিন্তু দুদিন পরের ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন (১ ফেব্রুয়ারি) সেই ভোগান্তিকে আকাশসমান করেছিল।

বান্দরবানের নীলগিরিতে এমন পাহাড়ের দেখা মিলবে। ছবি: লেখক
বান্দরবানের নীলগিরিতে এমন পাহাড়ের দেখা মিলবে। ছবি: লেখক

সন্ধ্যা ছয়টা বাড়ি ফিরতে বাস কাউন্টারে এসে দেখি কোনো টিকিট নেই। ওদিকে আমি পরিবার নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যাব বলে আগে থেকে সব নির্ধারিত ছিল। তাদের সঙ্গে যোগ দিতে না পারলে আমার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্মাবে। তাই যেকোনো উপায়ে বাড়ি ফিরতে হবে। কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের প্রায় সব কাউন্টার খুঁজেও ওই রাতের কোনো বাসের টিকিট পেলাম না। অবশেষে উপায় না দেখে লক্ষ্মীপুরের লোকাল একটি বাসের ইঞ্জিনের ওপরে বসে যাত্রা শুরু করলাম!

রাত ১২টায় বাড়ি পৌঁছে আবার ৩টায় বান্দরবানের উদ্দেশে রওনা হই। রাস্তায় মাঝারি মানের যানজট উপেক্ষা করে ৭ ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বান্দরবান সদরে গিয়ে পৌঁছাই সকাল ১০টায়। এ ৭ ঘণ্টার ভ্রমণ মোটেও সুখকর ছিল না। কারণ একের অধিক সদস্য পথিমধ্যে বমি করে একাকার করে ফেলেছেন! তাই সদরে গিয়ে একটু বিশ্রাম ও সকালের নাশতা সেরে নিলাম।

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, বিশাল বিশাল পাহাড় ও বৃক্ষরাজি আর মাঝেমধ্যে পাহাড়ের পাদদেশে দু-চারটা বাড়ির দেখা মেলে বান্দরবানে। ছবি: লেখক
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, বিশাল বিশাল পাহাড় ও বৃক্ষরাজি আর মাঝেমধ্যে পাহাড়ের পাদদেশে দু-চারটা বাড়ির দেখা মেলে বান্দরবানে। ছবি: লেখক

বান্দরবান সদর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পেরেছি নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র। উঁচু–নিচু দুর্গম পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সেই পথ পাড়ি দিতে প্রয়োজন স্থানীয় বিশেষ এক বাহন। লোকে এটিকে চান্দের গাড়ি বলে। মূলত এটি একটি শক্তিশালী ইঞ্জিনের জিপগাড়ি। এই ৪৫ কিলোমিটার পথ মূলত আমার কাছে নীলগিরি ভ্রমণের মূল আকর্ষণ বা অ্যাডভেঞ্চার মনে হয়েছে।

সরু এই পথে দুর্বল হৃদয়ের কোনো মানুষের পক্ষে ভ্রমণ করা হয়তো সম্ভব হবে না। আঁকাবাঁকা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলা রাস্তায় সজোরে ছুটে চলে চান্দের গাড়ি। একপাশে উঁচু পাহাড় অন্য পাশে নিচু ঢাল বা কখনো কখনো দুই পাশে নিচু ঢাল বা উঁচু পাহাড় সত্যি অসাধারণ এক সৃষ্টি। প্রকৃতি বা পাহাড়প্রেমীদের কাছে এই এক স্বর্গ মনে হবে। চারদিকে শুধুই বিশাল বিশাল পাহাড় ও বৃক্ষরাজি। মাঝেমধ্যে দু-চারটা বাড়ির দেখা মেলে কোনো বিশাল পাহাড়ের পাদদেশে।

নির্জনতা যাদের প্রিয়, তাদের মনের মধ্যে শখ জাগতেই পারে এমন কোনো একটি পাহাড়ের পাদদেশে নিজেদের একটি ঘর বাঁধতে! খানিকের মধ্যে মন রোমাঞ্চকর হয়ে উঠবে এমন পরিবেশ দেখলে, যেখানে নীল আকাশ সবুজ পাহাড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে। দিগন্তবিস্তৃত সবুজের মাঝে নির্মল বাতাসে হারিয়ে যাবে মন নিমেষেই!

নীলগিরির ভৌগোলিক অবস্থান, এই জায়গায় সৌন্দর্য এবং আকর্ষণ বিদেশি পর্যটক টানতে পারে। শুধু সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে এটিকে আন্তর্জাতিক মানের করে তৈরি করতে হবে। ছবি: লেখক
নীলগিরির ভৌগোলিক অবস্থান, এই জায়গায় সৌন্দর্য এবং আকর্ষণ বিদেশি পর্যটক টানতে পারে। শুধু সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে এটিকে আন্তর্জাতিক মানের করে তৈরি করতে হবে। ছবি: লেখক

দু–তিনটা চেকপোস্ট পেরিয়ে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে। মনে হচ্ছে, আশপাশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। চতুর্দিকে পাহাড়ঘেরা সেই এক অন্য রকম পরিবেশ। মূল পর্যটন কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করে বেশ খানিকটা সময় পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। পর্যটন কেন্দ্রের ভেতরে রেস্তোরাঁ, কাপড়ের দোকান, বিশ্রামাগার, মসজিদ, বসার জায়গাসহ পুরুষ-নারীদের জন্য আলাদা আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে।

দেশীয় পর্যটকের জন্য এমনটি যথেষ্ট ব্যবস্থা বা সুযোগ-সুবিধা হলেও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে এটি যথেষ্ট নয়। নীলগিরির ভৌগোলিক অবস্থান, এই জায়গায় সৌন্দর্য এবং আকর্ষণ বিদেশি পর্যটক টানতে সহায়ক। শুধু সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে এটিকে আন্তর্জাতিক মানের করে তৈরি করতে হবে। ভারত, নেপাল ও মালয়েশিয়া এর দৃষ্টান্ত হতে পারে। দেশগুলো কীভাবে পাহাড় ও প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে পর্যটনশিল্পকে বিশ্বের দরবারে হাজির করেছে।

পাহাড় প্রকৃতিকে আধুনিকতার সমন্বয়ে বিশ্ব মানের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গড়ে তোলা দরকার পাহাড়ের রিসোর্টগুলো। ছবি: লেখক
পাহাড় প্রকৃতিকে আধুনিকতার সমন্বয়ে বিশ্ব মানের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গড়ে তোলা দরকার পাহাড়ের রিসোর্টগুলো। ছবি: লেখক

দেশের বাইরে ভারতের দার্জিলিং, নেপালের ইলাম, থাইল্যান্ডের ফুকেটসহ বিভিন্ন লোকেশন এবং ইউরোপের বেশ কিছু দেশে এমন প্রাকৃতিক পাহাড়ি পরিবেশে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। পাহাড় প্রকৃতিকে আধুনিকতার সমন্বয়ে বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে সেসব স্থানকে। ফলে দেশীয় পর্যটকের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক বিদেশি পর্যটক ভিড় জমায় সেসব স্থানে। সেই এলাকায় উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও শক্তিশালী হচ্ছে।

নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রের বাইরে এবং রাস্তায় ছোট ছোট বাজারে লোকজন স্থানীয় ফলমূল এবং তাদের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করছে। একেবারে টাটকা পাহাড়ি ফল ও অনন্য সামগ্রী সাধারণ বাজার মূল্যের অনেক কম দামে বিক্রি করছে তারা। ফলে পর্যটকেরা তাদের যাতায়াতের মধ্যে বিরতিতে এসব প্রাকৃতিক ও ভেজালমুক্ত ফলমূলের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছেন।

শহরের নিকটে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রটিও মন কেড়েছে। এখান থেকে সমগ্র বান্দরবান শহরকে দেখার সুযোগ রয়েছে। নীলগিরি আর নীলাচলের গঠন সৌন্দর্য ও পাহাড়ি আকর্ষণ একই মনে হয়েছে। তবে যারা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, তাদের জন্য নীলগিরি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে। আর বান্দরবান শহরের কাছাকাছি বেড়াতে নীলাচল উৎকৃষ্ট জায়গা।

*লেখক: পর্তুগালপ্রবাসী