দ্বিতীয়বার জীবন পেলেন সাংবাদিক আরিফুল

আরিফুল ইসলাম
আরিফুল ইসলাম

গভীর রাতে, ফিল্মি স্টাইলে সাংবাদিককে নাজেহাল ও ঘায়েল করে, পরিবার-পরিজনের সামনে ‘তুই জ্বালাচ্ছিস’ বলে বাসার দরজা ভেঙে আটক করে নিয়ে দণ্ড দেওয়া হয়। তিনি বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম।

তাঁর স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার বলেন, ‘শুক্রবার রাত ১২টার দিকে একদল লোক হুড়মুড় করে “দরজা ভেঙে” আমাদের বসতঘরে ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্যে তিনজন জাপটে ধরে আরিফুলকে পেটাতে থাকে। আমাকেও মারার উপক্রম করে, গালিগালাজ চলতে থাকে। একপর্যায়ে কয়েকজন মিলে টেনেহিঁচড়ে আরিফুলকে তুলে নিয়ে যায়। তাকে জামাও পরতে দেয়নি। সকালে তিনি জানতে পারেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে আরেক দফা মারধরের পর সাজানো অভিযোগে আরিফুলকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।’

একজন সাংবাদিকের যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে বুঝতে হবে দেশের সাধারণ মানুষের কী অবস্থা?

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার ভাষ্য অনুযায়ী, আরিফুল ইসলামের বাসা থেকে ৪৫০ গ্রাম দেশি মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের ভাগ্য ভালো। নাটকের পরবর্তী রাউন্ডে তাঁকে আসতে হয়নি। সেই রাতে আরিফুল ইসলামকে বন্ধুকযুদ্ধের ভয়ও দেখানো হয়েছিল। দ্বিতীয়বার জীবন পেয়েছেন আরিফুল। কুড়িগ্রামের ঘটনা ক্ষমতার অপপ্রয়োগের একটি ছোট নমুনা। আরিফুলের ভাগ্য ভালো, তাঁকে নিয়ে অন্য খবর হয়নি।

আরিফুল ইসলামের ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। বিষয়টি যে প্রতিশোধমূলক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কুড়িগ্রামের ঘটনায় প্রমাণ হয়, দেশে একটি ‘তন্ত্র’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নোংরামি ঢুকে গেছে। প্রশাসনে বুঝতে হবে, জানতে হবে এবং মানতেও হবে দেশের মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তার জন্যই আপনারা নিযুক্ত হয়েছেন। আপনাদের জন্য গাড়ি, বাড়ি, নানা পর্যায়ে সুবিধা দেওয়ার পরও অবিচার মেনে নেওয়া যায় না।

‘মাদকবিরোধী অভিযান’-এর উদ্যোগ জেলা প্রশাসন নাকি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয় নিয়েছিল, তা নিয়ে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক ও জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালকের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। আর কুড়িগ্রাম সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, তিনি ওই গভীর রাতের অভিযানের বিষয়ে কিছুই জানতেন না।

আরিফুলের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার সেদিনকার রাতের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘শুক্রবার দিবাগত রাতে ঘুমোনোর আয়োজন চলছে, এমন সময় দরজায় আঘাত। কে ডাকছে, এ প্রশ্নে কোনো সাড়া নেই। সন্দেহ তাই বাড়ে। আরিফুল সদর থানার ওসির কাছে ফোন দেওয়ার যখন চেষ্টা করেছেন, তখনই হুড়মুড় করে দরজা ভেঙে সাত–আটজনের একটি দল ঘরে ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্যে তিনজন জাপটে ধরে আরিফুলকে পেটাতে থাকে। আমাকেও মারার উপক্রম করে, গালিগালাজ চলতে থাকে। কেন মারছেন, জিজ্ঞাসা করতেই তারা আরিফকে বলে, “তুই অনেক জ্বালাচ্ছিস”। মারতে মারতে তাকে নিয়ে যায়।’

মোস্তারিমার অভিযোগ, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন তাঁর নিজ নামে একটি পুকুর করেছিলেন। আরিফুল এ বিষয়ে নিউজ করার পর থেকেই তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ডিসি। সম্প্রতি তাঁর কার্যালয়ে নিয়োগ বিষয়ে অনিয়ম নিয়েও প্রতিবেদন তৈরি করেন আরিফুল। এ সবই কাল হয়েছে। তবে মোস্তারিমার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা প্রশাসক বলেছেন, ‘আমার নামে কোনা পুকুরের নামকরণ হয়নি। এক বছর আগে এমন প্রতিবেদন করেছিলেন আরিফুল। এ জন্য তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন। ওটা বিষয় না।’

কুড়িগ্রামের ঘটনা ক্ষমতা অপব্যবহারের উদাহরণ। দেশের মালিক কি জনগণ, না প্রশাসনের কর্মকর্তারা? সরকার কী প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে? এসব ঘটনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মহলগুলো রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে সাংবাদিক সমাজের দ্বন্দ্ব তৈরি করার অপচেষ্টা করছে বলে আমরা মনে করছি।

আইনের এমন যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ আইনের শাসনের সাংবিধানিক অঙ্গীকারের পরিপন্থী এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর নামান্তর। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় দ্রুত তদন্ত এবং জড়িতদের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে প্রশাসন তথা সরকারের ওপরই জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলবে বলে আমরা মনে করি।