চা কাপে ঝড়: টি-ব্যাগ না পাতা চা

টি–ব্যাগ নিয়ে নানাবিধ ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু টি–ব্যাগ নিয়ে আমরা যতটা ভয় পাচ্ছি, বাস্তব পরিস্থিতি এতটা জটিল কিছু নয়। ছবি: সংগৃহীত
টি–ব্যাগ নিয়ে নানাবিধ ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু টি–ব্যাগ নিয়ে আমরা যতটা ভয় পাচ্ছি, বাস্তব পরিস্থিতি এতটা জটিল কিছু নয়। ছবি: সংগৃহীত

‘চাতে নাহি মাদকতা দোষ, চা পানে করে চিত্ত পরিতোষ’—ব্রিটিশদের এমন চিত্তাকর্ষক বিজ্ঞাপন আর বিনা পয়সায় খাওয়ানোর কৌশলে আঠারো শতকে বাঙালি সংস্কৃতিতে চায়ের অনুপ্রবেশ ঘটে। সেই থেকে আজ অবধি বাঙালির জনপ্রিয় পানীয় হচ্ছে চা।

ব্যস্ত নাগরিক জীবনে ক্লান্তি দূর করতে আমরা প্রায়ই এক কাপ চায়ে স্বস্তি খুঁজি। আর ঝামেলা কম ও দামে সাশ্রয়ী হওয়ায় অনেক চাপ্রেমীর কাছেই প্রথম পছন্দ হলো ‘টি–ব্যাগ’। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে টি–ব্যাগ দিয়ে বানানো চায়ে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও অতি আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের উপস্থিতির খবর সারা বিশ্বে আলোচনার ঝড় তুলেছে।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিবন্ধে যে বিষয়গুলো বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তা হলো—
*প্লাস্টিক টি–ব্যাগ থেকে বানানো প্রতি কাপ চায়ে প্রায় ১ হাজার ১৬০ কোটি মাইক্রো এবং ৩১ কোটি ন্যানো প্লাস্টিক কণা মিশে থাকতে পারে (সূত্র: এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি জার্নাল, সেপ্টেম্বর ২০১৯ সংখ্যা)।

*কাগজের কিছু টি–ব্যাগে দৃঢ়তা প্রদান করার জন্য ‘ইপিক্লোরোহাইড্রিন’ মেশানো হয়। আর ব্যাগের খোলা অংশ বন্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয় তাপ সংবেদী রাসায়নিক। এ ছাড়া টি–ব্যাগের রং ধবধবে সাদা করার জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘ক্লোরিন’ দ্বারা ব্লিচিং করা হয়। এসব রাসায়নিক চায়ের গরম পানির সঙ্গে মিশে মানবশরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যহানি ঘটাতে পারে। (সূত্র: আমেরিকান চিকিৎসক জোসেফ মারকোলার লেখা ‘প্লাস্টিক অ্যান্ড ক্যানসারাস কম্পাউন্ডস ইন টি–ব্যাগ: আ সারপ্রাইজিং সোর্স অব পটেনশিয়াল টক্সিন’ এবং জিলিয়ান এক্সটন রচিত ‘মাই টি হ্যাজ হোয়াট ইন ইট?’ নিবন্ধ)

এ ছাড়া অসাধু কিছু কোম্পানি বেশি লাভের আশায় টি–ব্যাগের মধ্যে সস্তা দামের গুঁড়ো চা ব্যবহার করে। ফলে চায়ের প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় চাপ্রেমীরা। এ ছাড়া স্বাদ ও ঘ্রাণ অটুট রাখতে বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম রং, প্রিজারভেটিভ ইত্যাদি ব্যবহারের কথাও শোনা যায়।

এসব কারণে উন্নত বিশ্বের অনেকেই ইতিমধ্যে টি–ব্যাগকে ‘নীরব ঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু সচেতন মহলের প্রশ্ন হচ্ছে, টি–ব্যাগের বিরুদ্ধে এই যে এত এত অভিযোগ, বাস্তব পরিস্থিতি কি আসলেই এতটা আতঙ্কিত হওয়ার মতো?

এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই টি–ব্যাগে প্লাস্টিক আতঙ্কের প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করা যাক।

প্রথমত, বিশ্বের বাজারে মোট টি–ব্যাগের শতকরা মাত্র ৫ ভাগ প্লাস্টিক উপাদানে তৈরি। আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পরিমাণটা আরও কম। তা ছাড়া যে গবেষণা প্রবন্ধের মাধ্যমে এ বিষয়টি সবার নজরে এসেছে তার উপসংহারে স্পষ্ট ভাষায় বলা আছে, ‘প্রতি কাপ টি–ব্যাগ চায়ে যে পরিমাণ প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে, তা মানবদেহের জন্য তেমন ঝুঁকিপূর্ণ নয়’। তবে একনাগাড়ে বহুদিন ধরে প্লাস্টিক টি–ব্যাগের চা পান করলে কিছুটা স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা করেছে এই গবেষক দল।

এবার এই গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে আরেকটি পরিসংখ্যানের দিকে খেয়াল করা যাক। বলা হয়েছে, প্রতি কাপ টি–ব্যাগ চায়ে প্রাপ্ত প্লাস্টিক কণার পরিমাণ প্রায় ১৬ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি দিনে ১০ কাপ করেও এই চা পান করেন, তবে এক সপ্তাহে তার শরীরে সর্বোচ্চ ১১২০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত প্লাস্টিক কণা প্রবেশ করতে পারে, যা ১ গ্রামের প্রায় এক হাজার ভাগের এক ভাগের সামান্য বেশি মাত্র।

দু-চারটে ভুঁইফোড় কোম্পানি অধিক লাভের আশায় কিছু অপকর্ম করে বলেই জনসাধারণের মনে টি–ব্যাগ নিয়ে নানাবিধ ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
দু-চারটে ভুঁইফোড় কোম্পানি অধিক লাভের আশায় কিছু অপকর্ম করে বলেই জনসাধারণের মনে টি–ব্যাগ নিয়ে নানাবিধ ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে, মাইক্রো প্লাস্টিকের ওপর অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণা সমীক্ষা বলছে, সমগ্র বিশ্বে লবণ, টুথপেস্ট, খাবার পানি, কোমল পানীয়, কাপড় তৈরির কৃত্রিম সুতা, এমনকি নিশ্বাসের মাধ্যমে গড়ে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৫ গ্রাম প্লাস্টিক কণা মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে (সূত্র: এন অ্যানালাইসিস ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার, জুন ২০১৯)। অর্থাৎ টি–ব্যাগের প্লাস্টিকের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি প্লাস্টিক কণা আমরা নিজেদের অজান্তেই প্রতিনিয়ত গ্রহণ করছি। আশার কথা হচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এত স্বল্প মাত্রার অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার দ্বারা মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা নেই বললেই চলে। তবে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে।

এবার কাগজের টি–ব্যাগে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক, কৃত্রিম রং কিংবা প্রিজারভেটিভের প্রসঙ্গে আসা যাক। অধিকাংশ স্বনামধন্য চা কোম্পানিই তাদের ভোক্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে টি–ব্যাগে ক্ষতিকর রাসায়নিক, রং কিংবা ব্লিচিং ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন উদ্ভিদজাত উপাদান (ভুট্টা, আখ, কাসাভা, বিট ইত্যাদি) হতে প্রাপ্ত স্টার্চ বা সেলুলোজ থেকেই এসব টি–ব্যাগের কাগজ তৈরি করা হয়। ফলে টি–ব্যাগ থাকে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর। তা ছাড়া খ্যাতিমান কোম্পানিগুলোকে তাদের পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়। তাই বলা যায়, টি–ব্যাগ নিয়ে চাপ্রেমী মানুষদের মনে যে আতঙ্ক ইদানীং সৃষ্টি হয়েছে, তা নিতান্তই অমূলক।

আরও সুখবর হচ্ছে, বিশ্বের হাতে গোনা যে কয়েকটি কোম্পানি তাদের টি–ব্যাগে অতি স্বল্প মাত্রায় প্লাস্টিক উপাদান ব্যবহার করত, তারাও ইতিমধ্যে ‘নিরাপদ বিকল্প’ ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে, দু-চারটে ভুঁইফোড় কোম্পানি অধিক লাভের আশায় কিছু অপকর্ম করে বলেই জনসাধারণের মনে টি–ব্যাগ নিয়ে নানাবিধ ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু টি–ব্যাগ নিয়ে আমরা যতটা ভয় পাচ্ছি, বাস্তব পরিস্থিতি এতটা জটিল কিছু নয়। এখনো এ দেশের বেশির ভাগ চাপ্রেমী মানুষ খোলা ‘পাতা–চা’ দিয়ে বানানো চা খেতেই বেশি পছন্দ করেন।

চা বিশেষজ্ঞদের অভিমত অনুযায়ী চায়ের প্রকৃত আস্বাদ পেতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ‘পাতা চা’য়ের কাছেই। তাই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দিন শেষে একটাই প্রত্যাশা—‘ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চায়ে বাষ্প হয়ে উবে যাক সব ধোঁয়াশা!’

*লেখক: চা গবেষক