করোনা: জীবন বড়, না টাকা

করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, মুজিব বর্ষের বেশির ভাগ আয়োজন স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। মাঠের খেলা পর্যন্ত বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় বড় কনফারেন্স পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমনকি জাপান অলিম্পিক নিয়ে শঙ্কাও জেগেছে।

এ থেকে আমরা যে সত্যটি শিখেছি, তা হলো সবার আগে জীবন, পরে অন্য কিছু।

আমি নিজে করোনাভাইরাস বিশেষজ্ঞ নই। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে করোনাভাইরাস নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো পড়ে মনের মধ্যে একধরনের শঙ্কা জেগে উঠেছে। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী দুই থেকে তিন লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারে। আপনাদের মধ্যে যাদের আমার মতো নিউমোনিয়া রয়েছে, তারা হয়তো প্রত্যেকেই আমার মতো একটা কথাই ভাবছেন—আমি বাঁচব তো?

এটা সত্যি যে উন্নত দেশগুলোতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের বাসায় বসে কাজ করতে উৎসাহ দিচ্ছে, ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে মিটিংগুলো সেরে নিচ্ছেন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন লার্নিং সিস্টেমের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু আমার এই লেখাটির উদ্দেশ্য সেগুলো নয়।

আসল কথা হলো, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বের কথা চিন্তা করে এ দেশের সচেতন নাগরিকেরা প্রচণ্ড ভীতিকর অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

আপনি যদি পৃথিবীর বড় বড় স্টক মার্কেটের দিকে লক্ষ করেন, তাহলে দেখবেন যে সব কটিতেই সূচক কমে গেছে। একেবারে নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সূচক কমতে শুরু করেছে। শীর্ষ ধনীরা হাজার কোটি টাকা হারিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা কথা খুব সহজেই বলে দেওয়া যায়, মানুষ ভালো থাকলে ব্যবসা ভালো থাকবে।

সে জন্য আমাদের উচিত মানুষকে ভালো রাখার ওপরে জোর দেওয়া, ব্যবসাকে নয়।

আমার মনে হয় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব অনেকটা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির মতো। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে সবকিছু হুট করে ঘটেছিল, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই। এদিকে করোনাভাইরাস আমাদের চোখের সামনেই ধীরে ধীরে আমাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। করোনাভাইরাস যেন রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ‘সুপার স্লো মোশন’ ভার্সন।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, হলিউড অভিনেতা টম হ্যাঙ্কস আক্রান্ত। ইতালি ও স্পেনে প্রায় ১০ কোটি মানুষকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থাও করোনাকে প্রতিরোধ করতে পারছে না। বাংলাদেশের কী হবে? প্রতিষ্ঠানগুলোর কী করা উচিত?

কর্মীদের আস্থা অর্জন করা এবং তাঁদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রথম দায়িত্ব।

‘এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার’ অনুযায়ী, আস্থা মূলত তিনটি বিষয়ের ওপরে নির্ভর করে। দক্ষতা (কতটুকু ভালোভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করছে), নীতি (প্রতিষ্ঠানের নৈতিক মূল্যবোধ) এবং কণ্ঠস্বর (কর্মীদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া)।

মাইক্রোসফটের প্রেসিডেন্ট ব্র্যাড স্মিথ সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মানুষ এমন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করতে চায়, যারা কর্মীদের ভালোমন্দের বিষয়ে খেয়াল রাখে’।

কিন্তু করোনাভাইরাসের এই যুগেও বেশির ভাগ বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের টাকা উপার্জনের যন্ত্রে পরিণত করে রেখেছে।

প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের কর্মীদের যত্ন নেয়, একদিন কর্মীরাই প্রতিষ্ঠানের যত্ন নেবে। মানুষজন উদ্বিগ্ন; তারা বেড়াতে যাচ্ছে না, বাইরে খেতে যাচ্ছে না—তবে তাদের কেন আগের মতো পরিস্থিতিতেই কাজে যেতে হচ্ছে?

আমি আশা করতে চাই, আমরা যতটা চিন্তা করেছি, করোনাভাইরাসের প্রভাব ততটা খারাপ হবে না। কিন্তু এটা সত্যি যে আমরা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এবং ভীতিকর একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।

সব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের উদ্দেশে বলতে চাই, টাকা একটু কম আসুক, সেটাকে গ্রহণ করুন। কর্মীদের যত্ন নিন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সিইওরা নিজেদের চিফ ইমপ্যাথি অফিসার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করুন।

*লেখক: শিক্ষার্থী, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়