বাংলাদেশের মানুষ কেন ঘরে থাকছে না, নৃবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান

জনগণকে সতর্ক করতে দোহারে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের বাড়িতে লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া হয়। ছবি: প্রথম আলো
জনগণকে সতর্ক করতে দোহারে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের বাড়িতে লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া হয়। ছবি: প্রথম আলো

সারা দুনিয়ার মানুষের পাশাপাশি এ দেশের মানুষের জীবনে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় করোনাভাইরাসের প্রকোপ। প্রতিদিন এর প্রকোপ ও প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর একেক দেশ একেক রকমভাবে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করছে।

ভাইরাসটি যেহেতু সংক্রামক, তাই সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিশেষ করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ঘরে থাকার নীতি অনুসরণ করেছে এবং করছে। এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের কোনো কার্যকর ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হয়নি, সুতরাং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ পুরো বিশ্বের গবেষক, চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মূলত প্রতিরোধকেই এ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া রোধে কার্যকর উপায় বলে মনে করছেন।

এর প্রতিরোধের মূল কথা হলো আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে না আসা আর কারও যদি এ ভাইরাসের কোনো লক্ষণ থাকে কিংবা আক্রান্ত কোনো দেশ থেকে কেউ এসে থাকেন, তাহলে অন্য সবার থেকে ঘরে কিংবা নির্ধারিত জায়গায় আলাদাভাবে কমপক্ষে ১৪ দিন নির্ধারিত কিছু নিয়ম মেনে অবস্থান করে চিকিৎসা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ কিংবা ‘আইসোলেশন’ এই টার্মগুলো এখন সবার মুখে মুখে। এর মধ্যে উদ্বেগের বিষয় হলো গত ১৫ দিনেই বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন ১ লাখের বেশি প্রবাসী। এর মধ্যে সরকারি হিসাবেই মাত্র ২০ হাজার মানুষ আছে কোয়ারেন্টিনে। তাহলে বাকি প্রায় ৮০ হাজার প্রবাসী এখন পর্যন্ত নজরদারির বাইরে এবং সবার জন্য হুমকি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চারদিকে এত প্রচার-প্রচারণার মধ্যেও মানুষ নিজের ও পরিবারের সবার জন্য মঙ্গল বিবেচনাতেও কেন ঘরে থাকতে চায় না? এর পেছনের মূল কারণ আমাদের নিজস্ব আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।

দেশে করোনাকে মোকাবিলা করতে হলে দেশের আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় পরিস্থিতির সাপেক্ষে মোকাবিলা করার নীতি ঠিক করা জরুরি। বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতিতে কেউ দেশে এলে তাঁকে ঘিরে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে একটা উৎসব উৎসব ভাব কাজ করে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসী বিদেশে গিয়ে কত কষ্ট করে কী করল, সেটা কোনো বিষয় নয়, বরং ছেলে ‘বিদেশ’ থেকে আসছে, এটা একটা বড় ঘটনা। আর এ বড় ঘটনায় অনেক মানুষ আসবে, আগে থেকে ঠিক করা নিজের কিংবা ভাইবোনের বিয়ের ছেলেমেয়ে দেখা হবে, উপহার বণ্টন হবে, আড্ডা-হাসিঠাট্টা হবে, বিদেশের দিনগুলোর গল্প হবে, খাওয়াদাওয়া হবে, যে আসতে পারবে না তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসতে হবে—এগুলো সামাজিক রীতির অংশ।

ভাইরাস ছড়ানোর ভয়ের থেকে এ নিয়মকানুনের বেড়াজাল অনেক শক্তিশালী, তাই বিদেশে অনেকটাই মানসিকভাবে বন্দী প্রবাসীরা অনেকেই ইচ্ছাকৃত বিদেশ থেকে এসে ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে চায়নি। কোয়ারেন্টিনে থাকতে চায়নি। নিজেও অন্যকে নিরাপদ রাখার জন্যই কোয়ারেন্টিন। এ ইতিবাচক অর্থের থেকে বরং কোয়ারেন্টিন মানে এক বন্দিজীবনের ফাঁকে দেশে এসে দুই সপ্তাহের জন্য আবার ‘গৃহবন্দী’ হয়ে থাকা—এ মনজাগতিক বাঁধা আমরা সময়মতো ভাঙতে পারিনি। তাই এখন বিদেশফেরতদের ঘরে তালা দিয়ে রাখার উপায় খুঁজতে হচ্ছে।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে সরকার সব ছাত্রছাত্রীকে ঘরে থাকতে বলেছে। পরীক্ষা পরীক্ষা করে সারা বছর ফেনা তুলে ফেলা বাপ-মা এ রকম অপ্রত্যাশিত ছুটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করে দিয়েছিল। একদিকে সারা দেশে ওয়াই-ফাইয়ের সহজলভ্যতা না থাকা, মানহীন টিভি অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপনের আধিক্য, অন্যদিকে মোবাইল ইন্টারনেটের ডেটার দুর্মূল্য শেষ পর্যন্ত কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রই ঘরে বসে ইউটিউব নেটফ্লিক্স দেখার থেকে মাঠে খেলা, বাইরে চায়ের দোকানে, গাছের তলায় আড্ডাকেই সহজ সময় কাটানোর মাধ্যম হিসেবে নিচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবারের বহুল বিস্তার এই ছাত্রছাত্রীদের ঘরে বসে গল্পগুজব করার সুযোগ এমনিতেই কমিয়ে দিয়েছে।

শিক্ষক, শিক্ষার্থী বাদে ঢাকাভিত্তিক কিছু বহুজাতিক কোম্পানি তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বাসায় থেকে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু সারা দেশের কর্মীর সংখ্যা হিসাব করলে তা নগণ্য। দেশের সবচেয়ে বড় পোশাক খাতসহ বেসরকারি অফিসের কর্মীদের অন্যান্য সময়ের মতো এখনো অফিস করতে হচ্ছে গণপরিবহন ব্যবহার করে, তাঁদের ঘরে থাকার কোনো উপায়ই এখনো রাখা হয়নি। এ ক্ষেত্রে এখানে সমাজের শ্রেণিবৈষম্যর চিত্র স্পষ্ট ফুটে উঠেছে, যেখানে সবার জীবনের মূল্য সমানভাবে দেখা হচ্ছে না।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংক থেকে নেওয়া বিভিন্ন ঋণগ্রহীতার ঋণের পরিশোধের জন্য সময় বাড়িয়েছে, সরকার বিদ্যুৎ, গ্যাসের বিল বিলম্বে জমা নেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু কোন বেসরকারি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত ঋণের কিস্তি জমা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো আপত্কালীন ছাড় ঘোষণা করেনি। এর ফলে একটা বিরাটসংখ্যক মানুষ ঋণের কিস্তি পরিশোধের দায়ে হলেও রাস্তায় বের হতে বাধ্য। আর বাকি দিন আনে দিন খায় মানুষের গল্প তো সবারই জানা। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার ভয়ে তাঁদের জীবন চলে না। তাঁরা রাষ্ট্রের কিন্তু কোনো পরিস্থিতেই তাঁদের অন্ন জোগানোর ভার রাষ্ট্র নেয় নাই। তাই তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই পেটের দায়ে ঘরের বাইরে। বরং করোনায় পকেটে পয়সা ওয়ালা অনেকেই ‘ঘরে থাকার’ নিরাপত্তার জন্য গত কয়েক দিনে পণ্য মজুতের হিড়িকের কারণে ও ব্যবসায়ীদের অসাধুতায় নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে প্রান্তিক মানুষের আরও বেশি সময় ধরে ঘরের বাইরে থাকতে হচ্ছে পেটের দায় মেটাতে। করোনা থেকে বাঁচতে সরকারি কোনো নীতিতে নয়, বরং করোনার করুণার ওপরে তাঁরা নির্ভরশীল।

তাই সব মিলিয়ে বলতে চাই, প্রতিটা দেশের মানুষ ভিন্ন, তাই মানুষের ভিন্নতাকে আমলে নিয়ে করোনা মোকাবিলার নীতি নেওয়া জরুরি। শুধু নেতিবাচকতা নয়, মানুষের ঘরে না থাকার দায় খোঁজার আগে বরং করোনা মোকাবিলার আমাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঘরে না থাকার জন্য কারণগুলো জানা জরুরি। এই বিষয়ে সরকারের তড়িৎ পদক্ষেপ দরকার।

এ ক্ষেত্রে এই মুহূর্তেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করা ও বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি এবং প্রয়োজনে আপৎকালীন ভর্তুকি দিতে হবে, তাতে করে একটা বড়সংখ্যক মানুষের কাজের জন্য ঘরের বাইরে কম সময় থাকতে হবে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী হাজারো সংস্থাকে বাধ্য করতে হবে আপৎকালীন সময়ের জন্য কিস্তি আদায়ের নীতিতে ছাড় দেওয়ার জন্য, এতে অনেক মানুষের ঘরে থাকার সুযোগ তৈরি হবে। এর বাইরে যেকোনো শহরকে লকডাউনের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারকে প্রয়োজনে বিভিন্ন পর্যায়ের নাগরিকের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের প্রস্তুতি রাখা জরুরি। মোটকথা, এই মুহূর্তে মানুষকে ঘরে রাখতে গেলে তাঁকে ঘরে থাকার সুযোগ করে দিতে হবে—এর কোনো বিকল্প নেই।

*লেখক: গবেষক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়