হ্যান্ড স্যানিটাইজার হঠাৎ জনপ্রিয় কেন

সারা বিশ্ব ভয়াবহ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। একইভাবে আক্রান্ত বাংলাদেশও। ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার চেয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছে।

সামাজিক দূরত্ব তথা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের কারণে চায়ের কাপে ঝড় উঠছে না। তবে অনেকে এ বিষয়ে স্ট্যাটাস লিখে কম্পিউটারের কি-বোর্ডে ঝড় তুলছেন। তাঁদের প্রশংসাই করতে হবে।

কম্পিউটার আর মোবাইলের কি-বোর্ডে ঝড় তোলাদের মোটের ওপর তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণিতে আছেন তাঁরা, যাঁরা এ ভাইরাস সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ নন, কিন্তু এ বিষয়ে সচেতন বা উদ্বিগ্ন। তাঁরা প্রচুর পড়াশোনা করছেন এবং অর্জিত জ্ঞান অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করছেন। দ্বিতীয় শ্রেণিতে আছেন তাঁরা, যাঁদের এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান রয়েছে। এই শ্রেণিতে পড়েন চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, অণুজীব বিজ্ঞানী, প্রাণরসায়ন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা তুলনামূলক সুগঠিত তথ্য দিচ্ছেন। এর বাইরে আরেক শ্রেণি আছেন, যাঁদের দেওয়া তথ্য আবার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই শ্রেণিতে আবার তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আছেন।

গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে ব্যাপক আলোচনা, তার বিষয়বস্তু অনেক। এর মধ্যে রয়েছে কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন, পিসিআরের মতো ভারী ভারী শব্দ, যার অধিকাংশ হয়তো কিছুদিন আগেও পাঠকদের জানা ছিল না।

আমি যে বিষয়টি নিয়ে সামান্য আলোচনা করতে চাই, তা এদের তুলনায় হালকা; সম্ভবত করোনা প্রতিরোধে সবচেয়ে সহজ যে সমাধানটির কথা বলায় হয়েছে, সেটি। তা হচ্ছে হাত ধোয়া, ইংরেজিতে বলে হ্যান্ড ওয়াশিং। আদতে বিষয়টি সহজ মনে হলেও সহজ নয়।

এখন এই পরিস্থিতিতে হাত ধোয়া নিয়ে কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, গত কয়েক দিন এ একটি ট্রেন্ড বা ধরন চোখে পড়া। করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এর প্রতিরোধে হাত ধোয়ার গুরুত্বের কথা বলেছেন। সবাই শুনেছেও। তখনই হাত ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি নাম শোনা গেছে তা হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। এ বস্তুটি এই বঙ্গে আগেও পাওয়া যেত, বেশ কিছু ফার্মাসিউটিক্যাল ও কেমিক্যাল কোম্পানি এটি বাজারজাত করে। এর ব্যবহার মূলত চিকিৎসা ও গবেষণাক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে এর ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়নি। গত কয়েক দিনে এর প্রচলন বেড়েছে তো বটেই। লক্ষণীয় হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেশ কিছু কলেজের ছাত্ররাও গত কয়েক দিনে অ্যালকোহল–নির্ভর হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করেছে। ভালো কথা, হাত ভাইরাসমুক্ত করা নিয়ে কথা তা সাবান দিয়ে হোক বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে। সুতরাং এভাবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা একটা আছে। তা হচ্ছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, হাত ধোয়ার জন্য সাবান–পানিই সর্বোত্তম সমাধান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার হচ্ছে দ্বিতীয় উপায়। কিন্তু এখানে উল্টো হয়ে যাচ্ছে, সাবানের চেয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আগে চলে আসছেন, অনেকটা বাঁশের চেয়ে কঞ্চি ধড় হয়ে যাওয়ার মতো। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? উত্তরের সঙ্গে সম্ভবত আমাদের আচরণ ও চিন্তার ধরনের সম্পর্ক বেশি, বাজারের সম্পর্ক কম। কারণ, সাবান বিশেষ করে তরল সাবানের প্রচারণায় এর জীবাণুরোধী ক্ষমতা নিয়ে সুন্দর করে বলা হয়, এদের মার্কেট সক্ষমতা বা ক্যাপাসিটিও বেশি। সেই তুলনায় হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বাণিজ্যিক প্রচার লক্ষণীয়ভাবে কম। তারপর এর প্রসারের কারণ কী। কারণ, সম্ভবত স্টাইল বা স্মার্টনেস। হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারে যে স্মার্টনেস আছে, তা সাবান দিয়ে হাত ধোয়ায় নেই। এখানেই সম্ভবত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি রহস্যের সমাধান আছে।

দেশের যেসব সংস্থা ওয়াটার, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) নিয়ে কাজ করে, তারা দীর্ঘদিন ধরে হ্যান্ড ওয়াশিংকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করে আসছে। এ বিষয়ে প্রচুর গবেষণা ও ক্যাম্পেইনও হয়েছে। তবে হ্যান্ড ওয়াশিং যতটা প্রচলিত হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি।

গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ হাত ধোয়ার গুরুত্বের কথা জানে কিন্তু বাস্তবে মানে না। অথচ সেই দেশেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে গেল? যেখানে সাবান অনেক বেশি সহজলভ্য। তার মানে কি মানুষ ভাবছে করোনাভাইরাস অনেক বেশি শক্তিশালী, হাতের কাছে থাকা সাবানের জন্য যথেষ্ট নয়, হ্যান্ড স্যানিটাইজার যেহেতু নতুন ও দেখতে অন্য রকম, এটা করোনাভাইরাস মারতেও পারে? নাকি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারে যে স্মার্টনেস আছে, সেটাই আসল। কয়েক বছর আগে একটি গবেষণার জন্য আমাকে গ্রামে গ্রামে মানববর্জ্য সংগ্রহ করে বেড়াতে হয়েছিল। গ্রামের মানুষ বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকাত। মানববর্জ্য ডিজপোজেবল ব্যাগে রাখার পর সেই আমিই যখন মাস্ক খুলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত–মুখ পরিষ্কার করতাম, তখন তাঁরাই কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসতেন। তাঁরা হ্যান্ড স্যানিটাইজার আগে দেখেননি। তাঁদের চোখে নতুন কিছু মানেই স্মার্টনেস।

এত কথা বলার উদ্দেশ্য কী? মানুষ যদি হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে তাতে সমস্যা কি? মার্কিন সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) পরিষ্কার বলেছে, সাবান দিয়ে হাত ধুলে হাতের প্রায় সব জীবাণু ও কেমিক্যাল দূর হয় (২০ সেকেন্ডের কথা মাথায় রাখতে হবে)। যদি সাবান পানি না থাকে, তাহলে ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল আছে, এমন হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করলে জীবাণু অন্যদের মাঝে ছড়ানো থেকে বিরত থাকা যায় (ছড়ানো থেকে বিরত রাখে, নিজেকে পুরোপুরি নিরাপদ করে না) (সিডিসি, ২০২০)।

তা ছাড়া হাতে বেশি চর্বি বা গ্রিজ জাতীয় পদার্থ থাকলে এই স্যানিটাইজার ভালো কাজ করে না (বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে যা খুব স্বাভাবিক। আবার উদ্বায়ী বিধায় এই স্যানিটাইজার ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের বেশি হাতে থাকে না (হিক্যাপের গবেষণা, ২০০২)। ফলে বোঝা যায় সাবানের তুলনায় হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। অর্থাৎ করোনা ও অন্য যেকোনো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধে সাবান–পানি দিয়ে হাত ধোয়াই প্রাথমিক ও কার্যকর সমাধান। যেখানে সাবান–পানি না থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দ্বিতীয় কার্যকর সমাধান, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং আমরা সবচেয়ে কার্যকর সমাধান বাদ দিয়ে যেন দ্বিতীয়টি নিয়ে আগে ব্যস্ত না হই।

দ্বিগ্বিজয় দে: পরিবেশ ব্যবস্থাপনা শিক্ষার্থী, টোএন্টে বিশ্ববিদ্যালয়, নেদারল্যান্ডস