করোনা: নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর প্রভাব ও করণীয়

করোনাভাইরাসের আক্রমণে পুরো বিশ্ব এখন বিপর্যস্ত। এই ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনে হলেও এই মুহূর্তে দেশটি করোনা মোকাবিলায় সফল বলা যায়। মৃত মানুষের সংখ্যায় সব দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছে ইতালি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী দুই সপ্তাহ বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ছড়ানোর জন্য ‘হাই স্প্রেডিং টাইম’। এ সময়ে যতটুকু সচেতন হওয়া প্রয়োজন, আমরা ততটুকু সচেতন হইনি এবং অন্যকে করতে পারিনি। গ্রামের মানুষের মধ্যে অসচেতনতার মাত্রা অনেক বেশি। অন্য সময়ের মতোই অপ্রয়োজনে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং আড্ডা দিচ্ছে। তারা হয়তো এই ভাইরাসের ভয়াবহতা এখনো উপলব্ধি করতে পারেনি অথবা যা হওয়ার হবে এই মনোভাব।

শহুরে মানুষ কোভিড-১৯–এর বিষয়ে তুলনামূলকভাবে সচেতন এবং বেশ আতঙ্কগ্রস্ত। আতঙ্ক থেকে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়া খুবই ভালো, কিন্তু আতঙ্কিত হয়ে এমন কোনো কিছু করা উচিত না যেন অন্যের কষ্ট ও ভোগান্তি দুটোই বাড়ে। দুঃখজনকভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অনেক ক্রেতা এই কাজটিই করছেন, যার প্রভাব পড়ছে এবং পড়বে নিম্নবিত্ত এবং অসহায় গরিব শ্রেণির ওপর। আর এ অবস্থার পুরো সুবিধাটা নিচ্ছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এবং তাঁদের সিন্ডিকেট, যাঁদের মূল উদ্দেশ্য যেকোনো উপায়ে মুনাফা অর্জন করা।

সাধারণ জনগণকে বিপদের সম্মুখে ঠেলে দেওয়া কিংবা তাদের সমস্যাকে আরও প্রকট করার ক্ষেত্রে এ দেশের অতি উচ্চ মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বরাবরই চোখে পড়ার মতো। কিছুদিন আগেও আমরা দেখেছি বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতির সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি উচ্চমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন। আবার একশ্রেণির ক্রেতা বাস্তবসম্মত কারণে কিংবা গুজবেই হোক বরাবরই মজুত প্রবণতার দিকে ঝোঁকে থাকে। যেমন কিছুদিন আগে বাজারে লবণ থাকবে না—এই গুজবে বিশ্বাস করে কিছু ক্রেতা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে লবণ একসঙ্গে কিনে রেখেছে। অথচ একটি ছোট পরিবারে এক কেজি লবণ দিয়ে এক মাসের বেশি চলে যায়। আবার গর্বিত ক্রেতারা ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে হাস্যোজ্জ্বল ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। কী মানসিকতা আমাদের!

কয়েক দিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে আতঙ্কিত হয়ে অনেক ক্রেতা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ক্রয় করে রাখছেন। এক, দেড় কিংবা দুই মাসের পণ্যদ্রব্য মজুত করছেন। মেনে নিলাম ভোক্তা হিসেবে আপনার যত খুশি কেনার অধিকার আছে এবং পর্যাপ্ত টাকাও আছে। কিন্তু নিজের অধিকারের ষোলো আনা পূরণ করতে গিয়ে অন্যের অধিকার খর্ব করে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্যের চরম অবহেলা করছেন। আচ্ছা, একবার কি ভেবে দেখেছেন, আপনাদের এই বিলাসী ক্রয়ক্ষমতা নিম্নবিত্ত এবং দিন আনে দিন খায় এই শ্রেণির মানুষের জন্য চরম দুঃখ–দুর্দশার কারণ হতে পারে? চিন্তা করেছেন কি এই সুযোগে উচ্চ মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দ্বিগুণ, তিন গুণ কিংবা চার গুণ বেশি দামে বিক্রি করছে? হয়তো চিন্তা করেননি, কারণ এর প্রভাব আপনাদের ওপর খুব বেশি পড়ে না, পড়লেও যেকোনোভাবে সামাল দিয়ে ফেলতে পারবেন। কিন্তু যাঁরা অত্যন্ত নিম্ন¤বেতনের চাকরি করে, দিনমজুর এবং চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, তাদের ওপর এই প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে থেকে যায়। এই নেতিবাচক প্রভাব থেকে সামাজিক অস্থিরতা এবং অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, ঢাকা শহরে যাঁরা দিনমজুর এবং চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন, তাঁদের অধিকাংশই কাজের জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। আবার তাঁদের অধিকাংশই নিজ নিজ পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস। তাঁদের অনেকেরই পরিবার দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কিংবা এক-দুই দিন পরপর টাকা পাঠালেই কেবল তাঁদের সংসার চলতে পারে। ঢাকা শহরে এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যাটা একেবারেই কম নয়। এই শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যখন হ্রাস পায়, আয়ের পথ যখন সংকুচিত কিংবা বন্ধ হয়ে যাবে, তখন বাধ্য হয়ে তারা অন্যায় পথে পা দেবে, যা সামাজিক অস্থিরতা এবং অরাজকতার অন্যতম কারণ হতে পারে।

আমাদের দেশে এমন অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা শত কোটি কিংবা হাজার কোটি টাকার মালিক। যাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করতেও পিছপা হননি বলে ধারণা করা হয়। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। শিল্পপতিরা সহযোগিতার হাত বাড়ালে নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্গতি অনেকটা কমে যাবে।

এই মুহূর্তে সারা দেশের চিকিৎসক, নার্স এবং চিকিৎসাকর্মী যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) প্রদানসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রয়োজনীয় পিপিই প্রদান করা এক বা একাধিক পোশাক ব্যবসায়ীর জন্য কঠিন হবে বলে মনে করি না। বিভিন্ন মাধ্যমের খবরে জানা গেছে, ঢাকা শহরের কয়েকজন বাড়িওয়ালা এক-দুই মাসের বাসাভাড়া মওকুফ করে দিয়েছেন। অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ। আরও অনেকেই চাইলে এ রকম মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন, বিশেষ করে যাঁদের বাড়িতে অত্যন্ত নিম্ন আয়ের ভাড়াটে থাকেন। আমাদের সবার চলাফেরা এখন অনেক সীমিত। এর প্রভাব পড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। যেমন, একজন রিকশাওয়ালা আগে যদি দৈনিক ৫০০ টাকা আয় করতেন, এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই সমপরিমাণ আয় করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। একান্ত প্রয়োজনে আমরা যখন বের হই, তখন প্রত্যেকেই রিকশাভাড়া একটু বাড়িয়ে দিতে পারি। এই বিপর্যয়ের সময় এটি তাঁদের জন্য অনেক বড় সাহায্য হতে পারে। চাল, ডাল, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য দিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে আমরা নিম্নœআয়ের মানুষদের সহায়তা করতে পারি। পোশাকমালিকেরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীদের করোনা দুর্যোগের সময় এককালীন কিছু টাকা এবং প্রয়োজনীয় পণ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিম্ন¤আয়ের মানুষদের সহায়তা করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এখন এই ঘোষণার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন।

আমি আমার বাসায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অতিরিক্ত কোনো মজুত করিনি এবং করবও না। আমার জানামতে আরও অনেকেই করেনি। এতে কি আমাদের কোনো সমস্যায় পড়তে হবে? মোটেই না। কম খেলে সমস্যা হয় না, বরং প্রয়োজনের বেশি খেলেই বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আসুন নিজে সচেতন হই, অন্যকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করি; প্রত্যেকেই যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করি এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করি।

*লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]