আসুন, এই কঠিন সময়ে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করি

দেশের এই কঠিন সময়ে আমাদের সচেতনতার বিকল্প নেই। ছবি: প্রথম আলো
দেশের এই কঠিন সময়ে আমাদের সচেতনতার বিকল্প নেই। ছবি: প্রথম আলো

দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। জনসমাগম কমাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে, যানবাহনের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। অফিস-আদালতের কার্যক্রম সীমিত রাখা হয়েছে। আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সব অফিস-আদালত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

যেহেতু এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসকে ধ্বংস করার মতো কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, তাই এর একমাত্র সমাধান নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখা। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে অনেকেই অনেক ধরনের মতামত দিচ্ছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, সরকার দু-একটি জায়গা ছাড়া সব জায়গায় যথাসময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিয়েছে। সমস্যা আমাদের জনগণের মধ্যে। আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে, সে তুলনায় গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে অনেকের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি।

গণমাধ্যমে এই ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে প্রতিনিয়ত নানা প্রতিবেদন দেখার পরও জনগণ এর ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারছে না। যেমন জনসমাগম কমাতে শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পাশাপাশি অফিস-আদালতের কার্যক্রম সীমিত করা হয়েছে, জনগণ একে ছুটি মনে করে ঘরে না থেকে, ঘরের বাইরে বের হয়েছে। সর্বশেষ জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সেনা মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত জনগণকে কোনোভাবেই বোঝানো যাচ্ছে না যে এটা ঘরে অবস্থান করার জন্য ছুটি। ২৬ মার্চ থেকে অফিস-আদালত বন্ধ হওয়ার কারণে আমরা দেখছি, হাজার হাজার মানুষ তাদের গ্রামের বাড়ি ছুটে যাচ্ছে। এখানেই আমাদের বড় সমস্যা যে আমাদের জনগণকে বোঝাতে সরকার ও গণমাধ্যম দুটিই ব্যর্থ হচ্ছে। যেহেতু আমরা জনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, সেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব প্রদানের কোনো বিকল্প নেই।

আমি যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্য সরকারের বৃত্তি নিয়ে গত সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে অবস্থান করেছিলাম। যুক্তরাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২২ মার্চ দেশে ফিরেছি। এই দিন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে লকডাউন ঘোষণা করেনি। শুধু সরকার জনগণকে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দিয়েছে এবং এটা বাস্তবায়ন করার জন্য পুলিশ বা সেনাবাহিনী কোনোটিই মোতায়েন করার দরকার হয়নি তাদের।

জনগণ নিজ থেকেই সাবধান হয়েছে এবং সেটা মেনে চলছে। যেমন লিডস শহর থেকে ম্যানচেস্টার এয়ারপোর্টে আসার জন্য আমাকে ট্রেন নিতে হয়েছিল। আমি দেখে অবাক হলাম, পুরো স্টেশন ফাঁকা। ট্রেনের প্রতিটি বগিতে চার থেকে পাঁচজন করে যাত্রী। প্রতি স্টেশনে ট্রেন থামছে, কিন্তু এক বা দুজনের বেশি যাত্রা ওঠানামা করছে না। এমনকি কিছু কিছু স্টেশন থেকে একজনও ওঠেনি। এয়ারপোর্টও অনেকটাই ফাঁকা। সরকার তাদের অনুরোধ করছে এবং সে দেশের জনগণ সেটা নিজ থেকে মেনে চলছে। কিন্তু আমাদের দেশে হচ্ছে ঠিক উল্টো এবং জনগণ যে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে, সেটার মূল্য জনগণকেই দিতে হবে।

অনেকেই বলছে, সরকার লকডাউন ঘোষণা করছে না কেন। আমি বলব, জনসমাগম সীমিত রাখতে সরকার অনেকটাই লকডাউন পদ্ধতি অবলম্বন করছে এবং বাংলাদেশ সরকারও যুক্তরাজ্য সরকারের মতো ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করছে। কেননা মনস্তাত্ত্বিক কারণেই এ দেশের মানুষকে খুব বেশি দিন ঘরে আটকে রাখা যাবে না। তাই ভাইরাসের বিস্তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর আগ দিয়ে বা পিক টাইমের আগে লকডাউনে যেতে হবে, যা যুক্তরাজ্য সরকার করেছে।

যুক্তরাজ্যে মৃতের সংখ্যা ৩০০ ছাড়ানোর পরই তারা লকডাউনে গেছে এবং তাদেরও যুক্তি তারা খুব বেশি দিন তাদের জনগণকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখতে পারবে না। তাই ধীরে ধীরে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করে তারা লকডাউনে গেছে। এই সময়ের মধ্যে তারা জনগণকে বিষয়টির সঙ্গে অভ্যস্ত করিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, আগামী ১৫ থেকে ২০ দিন বাংলাদেশের জন্য ভয়ংকর হতে পারে; সেটি আমিও মনে করি। শুধু সরকারই ভালো জানে তাদের হাতে কী পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত আছে। যদি মনে হয়, সত্যি সত্যি সামনের ১৫ থেকে ২০ দিন আমাদের জন্য খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে, তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে, সরকারের লকডাউন ঘোষণা করা উচিত এখনই এবং সেটা বাস্তবায়নের জন্য সেনাবহিনীর বিকল্প নেই। কারণ, এই দেশের জনগণ কারও অনুরোধই মানবে না। তারা নিজেদের জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। আইনের কঠিন শাসন প্রয়োগের বিকল্প নেই।

আরেকটি বড় প্রশ্ন উঠেছে আমাদের সক্ষমতা নিয়ে। যেখানে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারছে না, সেখানে আমরা কতটুকু পারব, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে চীনও পারেনি, বর্তমানে ইতালিও পারছে না। এমনকি গতকাল একটি সংবাদে দেখলাম, নিউইয়র্কও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারছে না।

এই বাস্তবতায় সরকার ও তার মন্ত্রীরা যা–ই বলুন না কেন, আমি তাদের আশ্বাসে চিন্তামুক্ত হওয়ার কারণ দেখছি না। ভয়াবহ দূষণ ও ভেজালের মধ্যে বসবাস করার কারণে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা বেশি এবং এটাই হয়তো আমাদের একমাত্র সক্ষমতা। গত বছরই আমরা দেখেছি, সামান্য ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে সরকার যে হিমশিম খেয়েছে, সেখানে করোনা মোকাবিলা করার সাধ্য কতটুকু, তা দেখার বিষয়। নিজের সুরক্ষা নিজেই দেওয়ার চেষ্টা করুন।

এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য সরকারের পদ্ধতি ফলো করা যেতে পারে। তাদের এনএইচএস বা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছে। যেখানে যদি কেউ মনে করে সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তাহলে সে সেই ওয়েবসাইটে লগ–ইন করবে এবং ওয়েবসাইট তার শরীরের নানা লক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন করবে এবং যদি দেখা যায় সেগুলো করোনাভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কিত; তাহলে তাকে এক সপ্তাহ বাসায় থাকার অনুমতি দেবে এবং বিশ্রাম নিতে বলবে। আর না হলে তাকে বলবে করোনাভাইরাসের সঙ্গে তার লক্ষণগুলো সম্পর্কিত নয়।

এক সপ্তাহ পরে রোগীর অবস্থা খারাপ হলে, সে আবার লগ–ইন করবে এবং তখনই সে টেস্ট করতে পারবে এবং সে কোনো হাসপাতালে গিয়ে একা এই টেস্ট করাতে সক্ষম হবে না। এমন একটি সার্ভিস চালু করলে আমরা যারা অনেকেই ভয় পেয়ে টেস্ট করাতে যাচ্ছি, তাদের সংখ্যাটিও কমে আসবে। এতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপরও চাপ কমবে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকার নানা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। আমরা দেখি, সরকার প্রজেক্ট নিলেই বিভিন্ন মহলের পার্সেন্টেজের প্রশ্ন চলে আসে, সেটা যেন না হয় সেদিকে কঠোর দৃষ্টি দিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের দেশের প্রায় সবাই কোনো না কোনো অসুখে ভুগছে। তাই উনাদের জন্যও যাতে জরুরি চিকিৎসা সেবা চালু থাকে, সেটা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

দ্বিতীয় এবং অন্যতম জরুরি বিষয়, রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা, বিশেষ করে অভাবীদের জন্য। আমরা ধরেই নিই, সামনে আমাদের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে এবং সেটি মনে করেই সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি। যদি কঠিন সময় আসে, তাহলে সবার আগে সমস্যায় পড়বে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো। আমরা ইতিমধ্যে দেখছি তাদের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। তাদের এ পরিমাণ সামর্থ্য নেই যে তারা বসে কয়েক মাস খেতে পারবে। তাই তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা এখনই ভাবুন। যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই ব্যবস্থা ইতিমধ্যে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এটার সুফল যেন সত্যিকার অর্থের অভাবীদের ঘরে পৌঁছায়, সেদিকেও খেয়াল রাখুন।

এই বিশেষ মুহূর্তে, বিশেষ সেবা প্রদান করতে অনেকের প্রয়োজন হবে। তাই বিএনসিসি, রোভার স্কাউটের সদস্যদের সমন্বয়ে প্রতিটি থানায় বিশেষ ভলানটিয়ার টিম গঠন করা যেতে পারে; যারা যেকোনো প্রয়োজনে বিশেষ সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে তরুণদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভালো উপকার পাওয়া যেতে পারে।

সর্বোপরি দেশের এই কঠিন সময়ে আমাদের সচেতনতার বিকল্প নেই। আসুন, আমরা সবাই সচেতন হই এবং রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করি। পাশাপাশি রাষ্ট্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিরা দায়িত্বশীল আচরণ করুন এবং এই কঠিন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করুন। আপনাদের চেষ্টা ও ত্যাগ এ দেশের জনগণ সারা জীবন মনে রাখবে।

আসাদুজ্জামান কাজল: প্রভাষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই–মেইল: [email protected]