ঘরবন্দী সময়ে সন্তানকে যা শেখাতে পারি

সন্তান যে কাজ করতে পছন্দ করে, তা করতে দিন। ছবি: লেখক
সন্তান যে কাজ করতে পছন্দ করে, তা করতে দিন। ছবি: লেখক

দেশে দেশে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯–এর প্রকোপ। স্কুল–কলেজ বন্ধ। বন্ধ অফিস–আদালত। কোটি কোটি শিশু–কিশোর এখন ঘরে অবস্থান করছে। বলা যায়, একরকম বন্দী জীবন। শিশুরা অল্পেই বিরক্ত হয়, সেখানে বন্দী জীবন তাদের জন্য মেনে নেওয়া কষ্টের। অধিকাংশ মা–বাবা চিন্তিত শিশু-কিশোরদের সময় কাটানো নিয়ে। কারণ ঘরে ঘরে শিশু–কিশোররা ইলেকট্রনিকস ডিভাইসে গেমস, অনলাইনে ভিডিও দেখে দিনের অধিকাংশ সময় কাটাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টা ঘরে বন্দী সন্তানের মানগত সময় কাটানো নিয়ে চিন্তা অনেক মা–বাবার।

শিশুদের প্রাণচাঞ্চল্য বেশি থাকায় তারা দীর্ঘ সময় ছোটাছুটি করতে সক্ষম। তাদের এই সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হবে।

এই অস্থির সময়ে শিশুসন্তানদের বিভিন্নভাবে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে। ভারতের নয়াদিল্লিতে আমার দুই সন্তানের স্কুল ৯ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে। সাড়ে নয় ও সাড়ে পাঁচ বছরের দুই মেয়েসন্তানকে দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্নভাবে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করছি, সফল হচ্ছি বেশ। করোনাভাইরাসের এই সময়ে সন্তানদের মানসম্মত সময় কাটানোর পাশাপাশি তাদের সুস্থ–সবল রাখার এই প্রয়াস থেকে যদি অন্য মায়েরা উপকৃত হতে পারেন, সে লক্ষ্যে এই লেখা।

করোনাভাইরাস নিয়ে শিক্ষা দিন
আপনার সন্তানের সঙ্গে করোনাভাইরাস নিয়ে কথা বলুন। সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে শিশু ভয় পেলে ভীতি দূর করুন, সহজ করে বোঝান। শিশুদের বোঝার সুবিধার জন্য অনলাইনে শিশুর উপযোগী ভিডিও রয়েছে, তা দেখান। মীনার কার্টুন রয়েছে, জীবাণু কীভাবে ছড়ায়, তা দেখান। অনেক মজার মজার পদ্ধতি রয়েছে শিশুদের জীবাণু থেকে পরিষ্কার কী করে থাকা যায় বা হাত না পরিষ্কার করলে কী করে জীবাণু শরীরে ছড়ায় তা শেখান।

অনলাইন স্কুল
অনেক স্কুল বন্ধের এই সময় অনলাইনে শিশু শিক্ষার্থীদের ক্লাস করায়। প্রতিটি ক্লাসের শিক্ষকেরা আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা শিশুদের ক্লাস নেন। এতে দিনের দু-তিন ঘণ্টা শিশু স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কোনো স্কুল এক দিন পরপর, কোনো স্কুলে সপ্তাহে দুই বা এক দিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে। অনলাইনে হোমওয়ার্ক দেওয়া হয়, অনলাইনে জমা নেওয়া হয়। কোনো কোনো স্কুল প্রায় দুই সপ্তাহ বা এক মাসের হোমওয়ার্ক দিয়েছে। স্কুল না থাকলে শিশুরা রোজ রোজ হোমওয়ার্ক করতে চাইবে না, কোনো কোনো শিশু আবার দু–তিন দিনে সব বাসার কাজ করে ফেলে, তাই আপনাকে একটু বেশি সময় দিতে হবে। শিশুকে স্কুলের কাজ দিনেরটা দিনে করতে উৎসাহ দেবেন। বাসায় টিউটর না আসায় বাবা অথবা মা, একজন শিশুর লেখাপড়াতে সময় দিন ঘড়ি ধরে।

বয়সভেদে সন্তানকে ঘরের কাজ ও রান্নায় সহায়তা করতে শেখান। ছবি: লেখক
বয়সভেদে সন্তানকে ঘরের কাজ ও রান্নায় সহায়তা করতে শেখান। ছবি: লেখক

শিশুর মতামতকে গুরুত্ব দিন
অধিকাংশ কর্মজীবী মা–বাবা শিশুকে বেশি সময় দিতে পারে না। অফিসে কাজ, সংসারের কাজ, সামাজিকতা। তেমনি হোমমেকার মায়েরা সারা দিন সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকেন। সেই সঙ্গে থাকে সামাজিকতা। অন্যদিকে, সন্তান ব্যস্ত থাকে স্কুল, হোমওয়ার্ক, এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিস, কোচিং ইত্যাদি নিয়ে। ফলে দিন শেষে একে অপরের জন্য খুব একটা সময় থাকে না। গৃহবন্দীর এই সময়ে সন্তানের সঙ্গে মা–বাবা মানসম্মত সময় (কোয়ালিটি টাইম) কাটাতে পারেন।

সন্তানের সঙ্গে গল্প করুন, ওর কথা শুনুন, ওর চিন্তাভাবনাকে গুরুত্ব দিন। পারিবারিক আলোচনায় সন্তানকে শামিল করুন, তার মতামত নিন। তার কথা যৌক্তিক হলে গ্রাহ্য করুন, আর না হলে তাকে বুঝিয়ে বলুন। সন্তানের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব কমিয়ে আনুন। সন্তানের সঙ্গে যত বেশি সময় কাটাবেন, সন্তানের মনোভাব তত বুঝবেন। সংসারের অন্য কাজেও সন্তানকে শামিল করুন। সন্তানকে গল্প পড়ে শোনান, তেমনি আবার সন্তানকে বলুন আপনাকে পড়ে শোনাতে। পরিবারে বয়স্ক কেউ থাকলে সন্তানকে শেখান তাঁর দেখভাল করতে। এই সময়ের মূল লক্ষ্য হবে সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কের দৃঢ়তা বাড়ানো।

পরিচ্ছন্নতা ও শারীরিক পরিশ্রম
সন্তানকে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা শেখান। বোঝাতে হবে টয়লেট থেকে বের হওয়ার আগে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে হবে, খাওয়ার আগে হাত ধুতে হবে। জীবাণুকে দূরে রাখতে দরকার বারবার হাত ধোয়া। হাঁচি, কাশি দেওয়ার সময় রুমাল বা টিস্যু ব্যবহার করতে বলুন। শিশুকে বাসায় শুধু লেখাপড়া ও বসে বসে খেলা করালেই হবে না; শারীরিক কসরত করাতে হবে। ইউটিউবে ছোটদের উপযোগী ব্যায়াম ও ইয়োগা আছে, তা সন্তানের নিয়ে একসঙ্গে করুন। সীমিত আকারে খেলাধুলার ব্যবস্থা করুন। সম্ভব হলে যথাযথ নিরাপত্তা দিয়ে সন্তানকে বাসার ছাদে নিয়ে যান, উন্মুক্ত বাতাসে খেলাধুলা করতে দিন। মাথায় রাখবেন, ছাদে তখন শুধু আপনার পরিবারের সুস্থ লোকজনই থাকবেন, ফ্ল্যাট বাসা হলে অন্য পরিবারের সঙ্গে পালা বদল করে ছাদে আসুন, সঙ্গে স্যানিটাইজার রাখুন। উন্মুক্ত বাতাসে খেলাধুলা করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।

স্বাবলম্বী হতে শেখান
শিশুকে তার নিজের কাজ নিজে করতে শেখান। বয়সভেদে তার বিছানা, টেবিল, বুকসেলফ, খেলনা, এমনকি তার পোশাকের আলমারি, ওয়ার্ডরোব বা ক্লজিট গোছাতে শেখান। শেখান টুকটাক রান্না ও বেকিং। কেক মাফিন, কুকি বানানোর সময় সন্তানের সাহায্য নিন। সবজি, ফল ধুতে দিন। খাবার টেবিল সাজানো শেখান। খাবার পর নিজের প্লেট, গ্লাস, কিচেনে রাখতে বলুন। মাইক্রোওয়েভ ওভেনে খাবার গরম করতে শেখান। ফার্নিচার মুছতে, গাছে পানি দেওয়ার পাশাপাশি ঘরে পোষা প্রাণী থাকলে সেটির দেখভাল করতে দিন।

ফুলের গাছের যত্ন নেওয়াও শেখান। ছবি: লেখক
ফুলের গাছের যত্ন নেওয়াও শেখান। ছবি: লেখক

আগ্রহের কাজ করতে দিন
এখনকার শিশুদের জোর করে কিছু করানো যায় না। আমরা অনেক সময় সন্তানকে জোর করি। আমাদের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করি। এই সময় শিশুর আগ্রহের কাজটি করতে দিন। শিশুদের কেউ ছবি আঁকতে পছন্দ করে, কেউ পছন্দ করে ইলেকট্রনিকস জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে, কেউ ইউটিউবার হতে, কেউ পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে, কেউ রান্না করতে, কেউ নাচতে, কেউ গাইতে, কেউ লিখতে পছন্দ করে। কেউ ডিজাইনিং পছন্দ করে। কেউ কার্টুন বানাতে পছন্দ করে, করতে দিন। ওদের সঙ্গে আপনিও আগ্রহ নিয়ে পাশে থাকুন। এতে সন্তানের সৃজনশীলতা প্রকাশ পাবে এবং বেশ ব্যস্তও থাকবে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান ও সুষম খাবার দিন
সন্তানকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে দিন। ঘুম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে দিন ভিটামিন সি–সমৃদ্ধ খাবার। ডিম একটি সুপার ফুড হিসেবে গণ্য হয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য। টকদই দিন, এমনি খেতে না চাইলে বিভিন্ন ফল কেটে মিশিয়ে দিন। কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম, আখরোট, শুকনা ডুমুর, কিশমিশ, খেজুর, আমড়া, পেয়ারা, জাম্বুরা, আমলকী, লেবু, আপেল, কমলা, কলা, তরমুজ, ডালিম, জাম ও বেরি–জাতীয় ফল দিন। শাকসবজির মধ্যে পালং শাক, গাজর, ব্রকোলি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমাটো, মিষ্টি আলু, ক্যাপসিকাম, বিট, কাঁচা মরিচ, মেথি শাক দিন আপনার সন্তানের খাবারে। মাছ, মুরগির মাংস, মিষ্টি শস্য বা ফাইবার–জাতীয় খাবার দিন, শুধু গমের তৈরি খাবার না দিয়ে মাল্টি গ্রেইন বা বিভিন্ন শস্য দিয়ে তৈরি খাবার দিন। লাল চালের ভাত দারুণ উপকারী। রসুন, পেঁয়াজও দারুণ কার্যকার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য।

স্ক্রিন টাইম দিন
সন্তানকে নিয়ে টিভি দেখুন, শিশু–কিশোরদের উপযোগী অনেক ভালো ভালো সিনেমা রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষামূলক, অ্যাডভেঞ্চারাস, কমেডি, স্পাই থিলার, সায়েন্স ফিকশন, কমেডি, সোশ্যাল, এমনকি হরর সিনেমাও আছে। সন্তানকে যদি অনলাইনে খেলতে বা ইউটিউব দেখতে দিতেই হয়, তাহলে লক্ষ রাখুন, সে কী খেলছে বা কী দেখছে। ইউটিউবে অনেক শিক্ষামূলক ভিডিও আছে, যা দেখে অনেক কিছু শিখতে পারে শিশুরা, সেগুলো সন্তানের সঙ্গে আপনিও দেখুন। আপনার সচেতনতা সন্তানকে ভুল পথে পরিচালিত হতে রক্ষা করবে।

পুরস্কার দিন
সন্তানকে বিভিন্ন কাজে উৎসাহিত করতে পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখুন। তাকে ছবি আঁকতে দিন। পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়তে দিন। গল্প–কবিতা লিখতে বলুন, আপনার বাসায় বারান্দা থাকলে, বারান্দায় বাগান করতে শেখান। প্রতিটা কাজের শেষে তাকে পুরস্কার দিন।

যা করবেন না
সন্তানের সামনে ঝগড়া করবেন না। করোনাভাইরাসের কারণে আতঙ্কে উত্তেজিত একে অপরকে দোষারোপ করবেন না। যত দূর সম্ভব মাথা ঠান্ডা রাখুন। সন্তানের ওপর রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করবেন না। কঠিন কোনো শাস্তি দেবেন না। পরিবারের সবাই একসঙ্গে সুন্দর সময় কাটান। বিচ্ছিন্ন হয়ে সময় কাটাবেন না, সন্তানকে দীর্ঘক্ষণ একা টিভি দেখতে দেবেন না বা অনলাইনে বসতে দেবেন না। সন্তানের জেদের কাছে হার মেনে তাকে যখন-তখন ট্যাব, আইপ্যাড, ল্যাপটপ ও ফোন দেবেন না। দিলেও সময়সীমা নির্ধারণ করে দিন।

আমরা কেউ জানি না কোভিড-১৯ আমাদের কত দিন ঘরে বন্ধ করে রাখবে। সন্তান ও সংসারের পেছনে সময় দিতে দিতে নিজেকে অবহেলা করবেন না। পরিবারকে ভালো ও সুস্থ রাখতে, আপনি নিজের মনের ও স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখুন। পরিবারকে ভালো ও সুস্থ রাখতে নিজেকেও ভালো রাখতে হবে। যাবতীয় দুশ্চিন্তা দূরে সরিয়ে সবাই ভালো থাকতে সচেষ্ট হোন।

*লেখক: সাংবাদিক