ছোটবেলার কান ধরে ওঠবস, আর মনিরামপুর এসির ওঠবস...

সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হোসেন বয়স্ক দুই ব্যক্তিকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত
সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হোসেন বয়স্ক দুই ব্যক্তিকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত

আজ থেকে ১৫ বছরের বেশি সময় আগে আমরা যখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন স্কুলে যেকোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে আমাদের কান ধরে ওঠবস করাতেন শিক্ষকেরা। অপরাধ যত বেশি, কান ধরার পরিমাণ তত বাড়ত।

একবার স্কুলের এক শিক্ষক প্রতিটা বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা খাতা আনার জন্য আদেশ করলেন। কিন্তু গ্রামের বেশির ভাগ ছেলেরই সে রকম সামর্থ্য ছিল না। পরের দিন এ অপরাধে আমিসহ আমার বেশির ভাগ বন্ধুর শাস্তি নির্ধারিত হলো কান ধরা, তবে কান ধরে ওঠবস না, কান ধরে পুরো স্কুলের করিডর ঘুরতে হবে। সে দিনের সেই ঘটনার পর স্কুলে আর কক্ষনো খাতা ছাড়া যায়নি, তবে আমার এক বন্ধু আর কক্ষনো স্কুলেই যায়নি। হয়তো প্রচণ্ড রকমের অপমানবোধ ওই বয়সে তার ভেতর চলে এসেছিল।

এখন যুগ পাল্টেছে। সরকার থেকে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক সব শাস্তি আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখনকার শিক্ষকেরা ছাত্রদের আর শাস্তি দিয়ে শিক্ষা দেন না, আদর ও ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষা দেন।

তবে এ দেশে এখনো উঁচু দরের মানুষের নিচু দরের মানুষকে শাস্তি হিসেবে কান ধরানোর জন্য সরকারের কোনো বিধিনিষেধ নেই। এখানে একজন ওপরতলার মানুষ চাইলেই তার চেয়ে ক্ষমতায় খাটো মানুষকে শাস্তি হিসেবে জনতার সামনে কান ধরাতে পারে। আবার সেই প্রদত্ত শাস্তি প্রদানকে অপরাধ মনে না করে নিজেই সেটা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করতে পারে নির্দ্বিধায়।

গতকাল শুক্রবার সামাজিক মাধ্যমে ভ্যানচালকসহ দুই বৃদ্ধকে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে সামনে ছবি তুলছেন যশোরের মনিরামপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান। দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের বাজারভর্তি মানুষের সামনে কান ধরে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তাঁরা যদি দরিদ্র ভ্যানচালক না হয়ে আর অন্য অনেক কিছুর একটা কিছু হলে আজকের অপমানের গ্লানি বইতে হতো না। তারা যদি ওই এলাকার ক্ষমতাধর ব্যক্তির ক্যাডার বা চাটুকার হয়ে ক্ষমতাবান হতে পারতেন অথবা এই বিপদের সময়ে খাদ্যদ্রব্য মজুত করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করতেন, তাহলে হয়তো প্রশাসন তাঁদের ওপর এত খড়্গহস্ত হতো না। তবে তাঁরা এসবের কিছুই না হয়ে হলেন দারিদ্র ভ্যানচালক আর বাকি দুজন হয়তো দারিদ্র কৃষক। দেশের মানুষের মুখে ভাত জোগাড় যাঁরা করেন, তাঁরাই দুমুঠো ভাতের জন্য সংগ্রাম করেন আর উপরি হিসেবে তাঁরা পান প্রশাসনের এমন শাস্তি।

‘আমরা, আপনারা এক মাস কাজে না গেলেও বেতন পান। কিন্তু ওই মানুষগুলো পায় না। তারা দিন আনে দিন খায়।’ তাঁদের কাছে করোনার চেয়ে ভয়ংকর ক্ষুধা, এই ক্ষুধার ভয়ের অভিজ্ঞতা তাঁদের অনেকবার হয়েছে। যে ভয় দেখা যায়, সেই ভয়টাই তাঁদের বাইরে আনতে বাধ্য করেছে। তাঁদের চাহিদা সীমিত, তাঁদের আকাঙ্ক্ষা কম। তাঁদের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের। সারা জীবন তাঁরা অনেক বঞ্চনা সহ্য করে শেষ বয়সে উপনীত হয়েছেন, অন্তত এই বয়সে নতুন বঞ্চনা আর গ্লানির কালিমা তাঁদের জ্বরাক্রান্ত মুখে লেপন করবেন না।

* লেখক: শিক্ষার্থী, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়