পড়িয়া বই, অন্ধকারে কেন রই

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আপনি যদি উল্লিখিত শিরোনাম দেখে অবাক হন, তবে আশার আলো দেখা যায়। বলা হয়, ‘জ্ঞানই শক্তি।’ আবার জ্ঞান অর্জনের সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম হলো পড়া। মানুষ প্রকৃতি থেকেও শিখে থাকে। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে শাস্ত্রীয় জ্ঞানের মেলবন্ধনে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান তৈরি হয়। পৃথিবীর কল্যাণে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের ভূমিকাই মুখ্য। পড়াশোনার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান বাড়ে। এবার প্রশ্ন আসে জ্ঞান কী? জ্ঞান মানুষের কী কাজে লাগে?

জ্ঞানের প্রাথমিক স্তর হলো সাধারণ বুদ্ধি। ভালো–মন্দ ফারাক করার বোধ। ঔচিত্যবোধের বিচারে কী করা যাবে, কী করা যাবে না, কেন করা উচিত, কেন করা উচিত না—এই বোধবুদ্ধি যার মধ্যে আছে, তার সাধারণ বুদ্ধি আছে বলে ধরা হয়। এর ব্যত্যয় হলে ওই ব্যক্তির বিচার করা যায়। কিন্তু যার এই বোধগম্যতা নেই। অর্থাৎ কৃতকর্মের সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে যিনি ওয়াকিবহাল নয় বা যিনি বুঝতে অক্ষম, এমন লোককে আইন ‘ইনস্যানিটি ডিফেন্স’ নামে বিচারের আওতামুক্ত রাখে।

মানে হলো, যার জ্ঞান নেই, তার বিরুদ্ধে বিচার নেই! পাশাপাশি এমন লোককে কোনো দায়িত্বশীল কাজে সংযুক্ত করা যায় না। মানসিক বিকারগ্রস্ত লোক না ছাত্র হতে পারে, না শিক্ষক। তার একটাই পেশা, সেটা হলো ‘পাগলামি’। তবে চাইলেই কেউ আবার পাগলের ভোল ধরে থাকতে পারবে না। ‘ইনস্যানিটি ডিফেন্স’ সুবিধা পেতে হলে তাকে ডাক্তারের দ্বারা প্রত্যয়িত পাগল হতে হবে! তাহলে মানে দাঁড়াল, পাগলের সার্টিফিকেট ছাড়া সবাই সুস্থ। তাই তারা সব দায়দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে বাধ্য।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ। কমে এসেছে নারী-পুরুষের শিক্ষাবৈষম্যের হার। কর্মজীবনেও নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ প্রায় সমান তালে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত লোকজন। এরপরও আমাদের জাতীয় জীবনে আলোর দেখা মেলা ভার! জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত মানুষেরা কেন অন্ধকারের দানব হয়? এখনো কী কারণ অনুসন্ধানের সময় হয়নি?

২.
শিক্ষা মানুষকে কী দেয়? শিক্ষার উদ্দেশ্য কী?
পৃথিবীতে যত সুযোগ আছে, তার মধ্যে শিক্ষা লাভের সুযোগকে সবচেয়ে বড় করে দেখা হয়। শিক্ষা হলো জীবন গড়ার হাতিয়ার। সমাজ বদলের অস্ত্র। সভ্যতা বিনির্মাণের গাঁথুনি। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন তাঁর ‘দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘শুধু টাকাপয়সার অভাবই দারিদ্র্য নয়। একজন মানুষের সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে না পারার মতো বড় দারিদ্র্য আর নেই।’

শিক্ষার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হলো আচরণে পরিবর্তন আনা। স্বভাবের দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার মূল বাহন হলো শিক্ষা।

‘পড়িলে বই, আলোকিত হই’—একটি বহুল প্রচারিত স্লোগান। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে মূলত তরুণ শিক্ষার্থীদের সেতুবন্ধটা প্রগাঢ়। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিগুলো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারে দ্বারে যেয়ে বই বিলি করে আসে। প্রচুর বই ইস্যু হয়। ছেলেমেয়েরা পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণদের কার্যক্রম লক্ষ করলে এর প্রমাণ মেলে।

তাহলে আবরার ফাহাদকে মারল কারা? ক্যাম্পাসগুলোতে অনাচার কারা করে? হীন রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের একাংশ কেন লিপ্ত হয় দানব হওয়ার দৌড়ে? ‘শুনহে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’—কে পড়েনি এই অমিয় বাণী? তাহলে কি শুধু পরীক্ষা পাসই উদ্দেশ্য ছিল। তবে কি হৃদয়াবেগ দিয়ে অনুভব করিনি কেউ এই বাক্যের মর্মকথা?

কিংবা বালিশ আর পর্দাকাণ্ডের হোতা কারা? তাঁরা কি বই পড়েনি? আদর্শলিপির খণ্ডবাক্যগুলো আমাদের হৃদয়ে দোলা দেয়নি নিশ্চয়ই। তাই তো মিথ্যা বলার সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক নেই। দুর্নীতির সঙ্গে শিক্ষার উদ্দেশ্যের রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। গুজব ছড়ানো ও তাতে কান দেওয়া হালের ফ্যাশন।

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

৩.
পদ-পদবির প্রভাবে তাই সমাজে স্পষ্ট বিভেদ বিদ্যমান। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও কিছু অভাগাদের পশুতুল্য ব্যবহার প্রাপ্য হয়ে যায় নিয়তির খেলায়। অথচ আমরা কে না পড়েছি, ‘গাহি সাম্যের গান—/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুহেলিকা’, ‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘অগ্নিবীণা’ ইত্যাদি পড়া হয়েছে, কিন্তু কেবলই বিশ্বাস করা হয়নি তাঁর ‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?/ কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’ বাক্যের গুঢ় মূলভাব! সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আমাদের শিক্ষিত সমাজেও প্রকট। মানবকল্যাণে ধর্মের মানবিক ব্যবহার না হয়ে, ধর্ম হয়ে উঠছে বিবাদের হাতিয়ার। অথচ আমরা নিজেদের পড়ুয়া দাবি করে জ্ঞানের বড়াই করি। ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ যদি জেনেই থাকি, তবে ইনসানিয়াত কোথায়? অথবা অকালপ্রয়াত কিশোরকবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘এ পৃথিবীকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ কাব্যরেখা আমাদের কান ছুঁয়েছে কেবল, মন ছোঁয়নি। তাই তো প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর আমাদের এত জুলুম!

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার তরী’ কবিতাখানি পড়া হলো কিংবা জসীমউদ্‌দীনের ‘কবর’। কিন্তু নিজেকে দুনিয়ায় অমর ভেবে চিন্তা করিনি জীবনের বালুকাবেলায় কী রেখে যাব সৃষ্টির সেবায়? ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই—ছোটো সে তরী/ আমারি সোনার ধানে গিয়াছে ভরি’ শুধু মুখে আওড়ালাম। সোনার ধান জোগাড়ে ব্যস্ত হলাম কই? আমরা বই পড়লাম বটে, তবে কি অন্ধকারেই রইলাম?

তাই তো আজ আক্ষেপে বলি, ‘পড়িয়া বই, অন্ধকারে রই।’ অথচ আমাদের হওয়ার কথা ছিল আলোর দিশারি, আলোকিত মানুষ। ‘পড়িলে বই, আলোকিত হই’ ঠিক তখনই, যখনই আমরা হৃদয় দিয়ে বাক্যটির ভাবার্থ অনুভব করি।

পাঠের উদ্দেশ্য সফল হয়, যখন লেখাটি নিয়ে চিন্তা করি এবং বাস্তবজীবনে কাজে লাগাই। মুখস্থ করে পাসের আশা আমাদের বাক্য বানানো শেখায়, মানুষ হওয়া নয়। তবে আশার কথা, আমাদের সমাজে এখনো আলো হয়ে ছুটে বেড়ানো লোকের যে বড্ড অভাব, এমন নয়, তা টের পাওয়া যায় জাতীয় সংকট বা দুর্যোগে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত কল্যাণকামী ছোটাছুটিতে। তাই এই সব মহাত্মাকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়, মায়ায় জড়িয়ে রাখা চাই। নিজেদের জন্য আরও একবার ‘আদর্শলিপি’ বইটি পাঠ আবশ্যক মনে হয়।

*লেখক: অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের আইন কর্মকর্তা। [email protected]