প্রকৃতির অপরূপ দানব তিনাপ সাইতার

রনিনপাড়া যাওয়ার পথে। ছবি: সংগৃহীত
রনিনপাড়া যাওয়ার পথে। ছবি: সংগৃহীত

ট্র্যাকিং বিষয়টার সঙ্গে প্রথম পরিচয় লামা ভ্রমণ করতে গিয়ে। সেও প্রায় চার বছর আগে। আর এবার জীবনের দ্বিতীয় ট্র্যাকিং করলাম তিনাপ সাইতার যাওয়ার পথে। সব মিলিয়ে তিন দিনে প্রায় ৫০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে। কিছুদিন আগে ‘কোথায় ভ্রমণ করা যায়?’ এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রথম শুনতে পাই এই ঝরনার কথা। আঞ্চলিক ভাষায় ‘সাইতার’ অর্থ ঝরনা।

বলছিলাম ২০১৮ সালের জুনের কথা। পরিকল্পনা ছিল রোজার বন্ধ কাজে লাগিয়ে এই ট্র্যাকিংয়ে বের হওয়ার। আমাদের যাত্রীসংখ্যা আট। সকালে বান্দরবান পৌঁছলাম কোনো সমস্যা ছাড়াই। বান্দরবান সদর থেকে এবার রোয়াংছড়ি উপজেলা যেতে হবে। গণপরিবহনেই যাওয়া যায়। বাসের লোকজনের কথা শুনে মজা পেলাম। আমরা যখন বাসের ছাদে যাওয়ার অনুরোধ জানালাম, তারা বলল, ‘অবশ্যই, আপনার এখানে আসেন ঘুরতে, যতটা পারেন মজা করে যান।’

সারা পথে এমন গাছ ছিল। ছবি: লেখক
সারা পথে এমন গাছ ছিল। ছবি: লেখক

রোয়াংছড়িতে পা রাখতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। এখান থেকে এবার হাঁটাপথ। প্রায় ১৮ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে রনিনপাড়ায় রাত কাটাতে হবে। পরের দিন আরও প্রায় ৮ কিলোমিটার পাহাড়ি আর ঝিরিপথের শেষে তিনাপ সাইতার।

রোয়াংছড়িতে বৌদ্ধমন্দির। ছবি: লেখক
রোয়াংছড়িতে বৌদ্ধমন্দির। ছবি: লেখক

চায়ে ছোটবেলার ২৫ পয়সার লজেন্সের স্বাদ
রনিনপাড়ার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে স্থানীয় পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। থানায় গিয়ে পুলিশের ব্যবহার এবং দায়িত্বপরায়ণতা দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত হলাম। যাহোক, কিছুটা কম হাঁটার জন্য আমরা খানিকটা পথ নৌকায় পাড়ি দিলাম। এরপর শুরু হলো আমাদের আসল ট্র্যাকিং। ট্র্যাকিংয়ের শুরুই হলো এক খাঁড়া পাহাড় পাড়ি দেওয়ার মাধ্যমে। আধা ঘণ্টা পরপর বিশ্রামের জন্য থামতে হচ্ছে। পাহাড়ে জুমের পাশেই একটি করে জুমঘর থাকে। আমাদের বিশ্রামের স্থান হিসেবে এই জুমঘরগুলো ব্যাপক কাজে দিয়েছে এবার। ঘণ্টা দুই হাঁটার পর শরীর যখন আর চলে না, ঠিক ওই সময়েই পেয়ে গেলাম একটি দোকান। আহামরি কোনো দোকান নয়। সামান্য চা, কিছু অপরিচিত বিস্কুট, সেদ্ধ ডিম আর আনারস। তবে আমাদের কাছে মনে হলো যেন অমৃতের সন্ধান পেয়েছি। সবাই দেখলাম শুধু গিলছে, যেন খাবার চিবানো ভুলে গিয়েছে। আর আনারস তো নয় যেন রসের হাঁড়ি গিললাম। ঢাকায় আসার পর আনারস খেয়ে মনে হয়েছিল মাটি খাচ্ছি। কিছুটা মন খারাপ হলো এই ভেবে যে পাহাড়ি আনারস আমার শহুরে আনারস খাওয়াটা চিরদিনের জন্য মাটি করে দিল। এখানকার চায়ের স্বাদটাও ভিন্ন। চায়ে ছোটবেলায় খাওয়া ২৫ পয়সা দামের লজেন্সের স্বাদ পেলাম।

হাঁটার পথগুলো ব্যাপক বিচিত্র। ধরুন, আপনি আপনার রুম থেকে পাশের রুমে যাবেন। আপনি সোজা হাঁটবেন তাই তো, কিন্তু এটা যে পাহাড়, এখানে কি আর কোনো কিছু সরল উপায়ে করা সম্ভব। তো এইখানে পাশের রুমে যাওয়ার জন্য আগে আপনাকে একটি সোজা পাহাড়ে উঠতে হবে, এরপর আবার নামতে হবে। তবে আপনি পাশের রুমে পৌঁছাবেন। আশা করি বিষয়টা আপনাদের বোঝাতে পেরেছি।

গাইড। ছবি: লেখক
গাইড। ছবি: লেখক

ঘামে গোসল হয়েছে, আবার ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়াচ্ছে
বান্দরবান জায়গাটা বড়ই সুন্দর। পথের বাঁকে বাঁকে সে নানা প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে বসে আছে মনোমুগ্ধ করার জন্য। যতবার আমরা কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, ঠিক ততবারই প্রকৃতি আমাদের তার রূপের মায়ায় নতুন করে মুগ্ধ করেছে আর ভুলতে বাধ্য করেছে আমাদের কষ্ট। হয়তো ঘামে সারা শরীর আপনার গোসল করে ফেলেছে, দেখবেন কোথা থেকে যেন ঠান্ডা বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দিয়ে যাবে। যাহোক পথে আরও কয়েকটি বিরতি দিয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা হাঁটার পর রনিনপাড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে এল।

রনিনপাড়ায় প্রবেশের পথটা খানিকটা হলিউডের ভৌতিক চলচ্চিত্রের মতো। প্রবেশপথটি আসলে একটি কবরস্থান। এখানকার কবরস্থানগুলো কিছুটা ভিন্নধর্মী। কবরের চারপাশে কোনো প্রাচীর নেই, আছে কেবল নাম খোদাই করা একটি পাথর। এমন শত নাম খোদাই করা পাথরের নিচের মানুষগুলো যেন আপনার প্রতিটি গতিবিধি লক্ষ করছে। সন্ধ্যার সময় যখন এই পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম ক্লান্তি নিয়ে, বিচিত্র এক অনুভূতি কাজ করছিল নিজের মাঝে। অবশেষে রনিনপাড়ায় পা রাখলাম। ভাবতে অবাক লাগে এতো দুর্গম একটি জায়গায় প্রায় ১৫০ পরিবারের বসবাস, সংখ্যার দিক দিয়ে বিবেচনা করলে প্রায় ৯০০ মানুষ। বাংলাদেশ বড়ই বৈচিত্র্যময়।

রাতে আমাদের জন্য আয়োজন মুরগির মাংস, আলুভর্তা, ডাল এবং পাহাড়ি চালের ভাত। খাবার জায়গাটি দেখে ক্লান্তি কিছুটা সুখকর অনুভূতিতে রূপান্তরিত হলো। বাড়ির উঠানের পাশে একটি মাচা মতো দাঁড় করানো, যার মাঝে বাঁশ দিয়ে টেবিল আর চেয়ারের ব্যবস্থা করা। খেতে গিয়ে বুঝলাম পাহাড়ি মানুষ মসলা কম খায়, এমনকি লবণও খায় না বললেই চলে। এর পেছনের কারণ হয়তো এই যে এত দুর্গম জায়গায় এসব মসলা পাওয়াও যায় কম। যাহোক, খাওয়া শুরু করলাম এবং মনে হচ্ছিল অমৃত খাচ্ছি। আসলে সারা দিন পাহাড়ি পথ হাঁটার পর কী খাচ্ছিলাম, সেটি আর মুখ্য বিষয় ছিল না, খাচ্ছিলাম যে সেটি মুখ্য বিষয়।

আমরা যেদিন রনিনপাড়া পৌঁছলাম, সেদিন ছিল পূর্ণিমা। আকাশে অল্পবিস্তর সাদা মেঘ আর তার মাঝে ডিমলাইটের মতো গোলাকার একটি বস্তু। এর বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছু জিনিস আছে কেবল অনুভব করা যায়। এটি আমার জীবনের প্রথম ভ্রমণ, যেখানে আমি অসংখ্যবার ক্যামেরায় ছবি না তুলে কেবল অনুভব করেছি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল এই সৌন্দর্য অনুভব না করে ছবি তুলে নষ্ট করলে পাপ হবে পাপ। মাঝেমধ্যে এমনও মনে হচ্ছিল যেন আমি আফ্রিকা নয়তো আমাজনের কোনো দুর্গম পরিবেশে আছি।

পাহাড়ে ফুল। ছবি: লেখক
পাহাড়ে ফুল। ছবি: লেখক

দ্বিতীয় দিন সকালে উঠে দেখি হাত–পা আর নাড়ানো যাচ্ছে না। একটু নড়তে গেলেই শরীর মনে করিয়ে দিচ্ছে গতকালের ছয় ঘণ্টা হাঁটার সেই স্মৃতি। চিন্তায় পড়ে গেলাম আজ কীভাবে এত পথ পাড়ি দিয়ে তিনাপ সাইতার যাব। একবার ভাবলাম আজকের মতো রনিনপাড়াতেই বিশ্রাম নিই। এখানেও তো দেখার মতো কত কিছুই আছে। আসলেই রনিনপাড়া ও তার আশপাশে দেখার মতো বহু কিছু আছে। কিন্তু ঢাকা ফিরেই যে পরীক্ষার জন্য বসা লাগবে। তাই সময় নষ্ট না করে সেদিনই ভাঙা শরীর নিয়ে পাহাড়ি আর ঝিরিপথ পাড়ি দিয়ে তিনাপ সাইতারের উদ্দেশে রওনা হলাম।

অর্ধেক পথ পাহাড়ি, মাঝে কিছুটা ঝিরিপথ পাড়ি দিয়ে এরপর তিনাপ সাইতার। যাওয়া আসার পথে একটি মাত্র দোকান পড়ে রাস্তায়। লামা ভ্রমণের পর আবার ঝিরিপথ পাড়ি দেওয়ার সৌভাগ্য হলো। এ বড়ই আজব অনুভূতি। যেন প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে মজা নিচ্ছে। ওপরে জ্যৈষ্ঠ মাসের তপতপে সূর্য, তার ওপর হাঁটার ফলে মনে হচ্ছে যেন মরুভূমির গরম আর ওইদিকে ঝিরির পানি বরফের মতো ঠান্ডা। ঝিরিপথ পাড়ি দেওয়ার সময় যখন অর্ধেক শরীর পানির নিচে আর অর্ধেক ওপরে, সেই সময়ের অনুভূতি সুখ আর দুঃখের এক মিশ্রণ। প্রায় চার ঘণ্টা হাঁটার পর তিনাপ সাইতারের দেখা মিলল। এত সুন্দর আর বিশাল আকৃতির ঝরনা আমার ক্ষুদ্র জীবনে দেখিনি। প্রকৃতি যে আসলেই কত বিচিত্র, কত সুন্দর, কত ভয়ংকর এবং বিধাতা যে তাকে কতটা ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে, তার একটি নমুনা নতুন করে পেলাম। বিশাল বিশাল পাথরের মাঝ দিয়ে প্রবহমান স্রোতের খোরাক জুগিয়ে চলেছে এই ঝরনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিক থেকে ভ্রমণজীবনের শুরু, তবে প্রকৃতির এতো নৈকট্য আগে কখনো অনুভব করিনি। প্রকৃতির এই বিশালতায় এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে ছবি তোলা হয়নি তিনাপ সাইতারের। ভেবেছিলাম আপাতত কিছুটা প্রকৃতির খেলা দেখি, যাওয়ার সময় ছবি তোলা যাবে। কিন্তু এবারের ভ্রমণে বিধাতা যেন পণ করেছিলেন আমাদের সব ধরনের অভিজ্ঞতা করাবেন। ঘণ্টা দুই থাকার পর ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ছবি আর তোলা হলো না আমার।

ভ্রমণের পথে বৌদ্ধমন্দির। ছবি: লেখক
ভ্রমণের পথে বৌদ্ধমন্দির। ছবি: লেখক

জোঁকের রাজ্যে যাচ্ছ
আমাদের গাইড আবার তাড়া দিচ্ছিলেন ফিরতি পথ ধরার জন্য। কেন তাড়া দিচ্ছিল, তা কিছুটা পথ পাড়ি দিতেই বুঝতে পারলাম। যে ঝিরির পানি আসার সময় কোমরসমানও ছিল না, সেই ঝিরির পানি এখন দেখি প্রায় এক হাত বেড়ে গিয়েছে। স্রোতও প্রায় দ্বিগুণ। কিছুটা ঝিরিপথ পাড়ি দেওয়ার পর গাইড বলে উঠল, সামনের ঝিরি পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়, পাহাড় পার হয়ে যেতে হবে। কিন্তু এই পাহাড়ে পথ কোথায়, এ তো শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। সঙ্গে বৃষ্টির বদৌলতে পাহাড়ের গা–ঘেঁষা এই পথ পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে। আসার সময় রোদ ছিল আর মোটামুটি পরিষ্কার পথ হয়েই আসতে পারা গিয়েছে তিনাপ সাইতার। কোনো জোঁক ধরেনি। তাই তিনাপ সাইতার আসার পথে চিন্তা করছিলাম, যারা ‘জোঁকের রাজ্যে যাচ্ছ’ বলে ভয় দেখিয়েছিল, তাদের সবাইকে ঢাকা এসে আচ্ছামতো কথা শোনানো যাবে। কিন্তু এখন যে বৃষ্টি হচ্ছে, তার ওপর দুর্গম পাহাড়ি পথ। শুরু হলো জোঁকের আক্রমণ। সামনে পেছনে প্রায় সবাইকে জোঁকে ধরল। আমাকে সৌভাগ্যবশত ধরল না তবে মস্ত এক আছাড় খেলাম। পাশে গাছ ছিল বলে রক্ষা, নইলে সোজা নিচের দানব রূপ নেওয়া ঝিরিতে পড়তাম। বাকিটা আর না বলি। যাহোক, এই বিভীষিকাময় পাহাড় পার হওয়ার পর আবার কিছুটা ঝিরিপথ পাড়ি দিয়ে এবার পাহাড়ি পথ ধরে সোজা রনিনপাড়ার দিকে যাত্রা। আস্তে আস্তে জোঁকের আক্রমণ আরও বাড়ল। আমাকেও ধরল দু–একটা। আমার জোঁকভীতি প্রবল ছিল, কিন্তু যেখানে জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন, সেখানে জোঁকের ভয় অনেকাংশেই তুচ্ছ হয়ে যায়। আর এ ভ্রমণ শেষে জোঁকভীতি চলে গিয়েছে। বোঝাই যায় না আপনাকে কিছু কামড়াচ্ছে, ব্যথাই যদি না পেলাম তো ভয় কিসের। সন্ধ্যার আগে রনিনপাড়া পৌঁছাতে হবে, নইলে এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে আর কত কিসের মোকাবিলা করতে হয় কে জানে। এতকিছু যখন একসঙ্গে ঘটছিল, আশপাশে কী ঘটছে তার দিকে নজর দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। খাঁড়া একটি পাহাড়ে উঠে বিশ্রাম নিতে গিয়ে যখন একটু দাঁড়ালাম, প্রকৃতি আমায় আবারও তার সৌন্দর্যে আমার সব ক্লান্তি দূর করে দিল। আমার পাশের আর দূরের পাহাড়ে, সব জায়গায় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।

তিনাপ সাইতার যাওয়ার পথে এমন চোখধাঁধানো দৃশ্যর দেখা মিলবে। ছবি: লেখক
তিনাপ সাইতার যাওয়ার পথে এমন চোখধাঁধানো দৃশ্যর দেখা মিলবে। ছবি: লেখক

পাহাড়ি আনারসগুলো ঠিক পাহাড়ের মতোই বিশাল
যাঁরা বৃষ্টি ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য মর্ত্যের স্বর্গ হলো সিলেট আর এই পাহাড়ি বৃষ্টি। ঘন মেঘ আর বৃষ্টিতে একাকার চারপাশ। বৃষ্টি হওয়ায় একটি সুবিধা হলো। চলার পথে গরম কম লাগছিল, নইলে আসতে আরও কষ্ট হতো। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পরই সেই একমাত্র দোকানে পৌঁছলাম। যাওয়ার সময় সবার জন্য একটি করে ডিম সেদ্ধ করে রাখতে বলা হয়েছিল। এসে দেখি ডিম সেদ্ধ করা আছে তবে বুঝতে পারলাম এক ডিমে কিছু হবে না। জনপ্রতি আরও দুটি ডিম সেদ্ধ খেতে হলো। ৯ জন মিলে ৬টি আনারস সাবাড়। আর পাহাড়ি আনারসগুলোও যেন ঠিক পাহাড়ের মতোই বিশাল। এরপর এল চা। নতুন আরও এক অভিজ্ঞতা সেরে নিলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল, এর মাঝেই চা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সন্ধ্যা দ্রুত নেমে আসছে, তাই ক্লান্তি ভুলে আবারও রওনা হলাম।

ফুটে আছে শাপলা। ছবি: লেখক
ফুটে আছে শাপলা। ছবি: লেখক

পাহাড়ি লাল চালের ভাত খাওয়া হলো না
কে জানত প্রকৃতি আমাদের জন্য সামনে আরও চমক নিয়ে বসে আছে। কিছুটা পথ হাঁটার পর দেখতে পেলাম সূর্য অস্ত যাচ্ছে। এই প্রথম পাহাড়ে সূর্যাস্ত দেখা। সবাই দাঁড়িয়ে গেছেন। সবাই এই মায়ার জালে বন্দী হয়ে নড়তে পারছে না। লাল সূর্যটা দূরের এক পাহাড়ের মাঝে মিশে যাচ্ছে। তার লাল–কমলা আলোয় রাঙা হয়ে আছে আশপাশের সকল সাদা মেঘ। মিনিটখানেক সবাই চুপ। এরপর একটি চিৎকার শুনতে পেলাম। জোঁক। সবাই যার যার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। এই সৌন্দর্য দেখার প্রতিদান যে এভাবে দিতে হবে কে জানত। সবার পায়েই চার–পাঁচটা করে জোঁক। কোনোমতে জোঁকগুলো পা থেকে সরিয়ে রীতিমতো দৌড়। কিন্তু দৌড়ও যে দেওয়া যাচ্ছে না, বৃষ্টির ফলে প্রচুর পিচ্ছিল হয়ে গেছে পায়ে হাঁটা এই পাহাড়ি পথ। কোনোমতে আছাড় খাওয়া থেকে নিজেকে প্রাণপণে বাঁচিয়ে রনিনপাড়ার কাছাকাছি আসতে না আসতেই অন্ধকার নেমে এল। বহু কষ্টে বাকি পথ কোনোভাবে পাড়ি দিয়ে রনিনপাড়ায় এসে দেখি আরও চারটা জোঁক আমার সঙ্গে পথ পাড়ি দিয়েছে। তাদের ছাড়ানো আরেক ঝামেলা। যাকে জোঁক ধরে, তাকে এতটাই ভালোবেসে ফেলে যে ছাড়তেও চায় না। জোঁকে ধরা জায়গা বেশ কিছুদিন চুলকায়। সবাই পরিষ্কার হয়ে বিশ্রাম নিয়ে খেতে বসলাম। খুব ইচ্ছা ছিল পাহাড়ি লাল চালের ভাত খাব, তবে এই একটি আশাই কেবল অপূর্ণ রয়ে গেল।

খাওয়াদাওয়া সেরে সেদিনের মতো সব অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করে শুতে গেলাম। চিন্তা হচ্ছিল পরের দিনের জন্য। এই শরীর নিয়ে আবারও কীভাবে সম্ভব ছয় ঘণ্টা হেঁটে রোয়াংছড়ি যাওয়া। এই ভয় নিয়েই ঘুমাতে গেলাম। অনেক দিন বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসে না, আজ চলে এল।

পরের দিন সকালে উঠে দেখি আগের দিন সকালে যাওবা শরীর নাড়াতে পেড়েছিলাম আজ তো শোয়া থেকেই উঠতে পারছি না। আগের রাতে বাঙালির জাতীয় ওষুধ নাপা খেয়েও কোনো কাজে দিল না। বহু কষ্টে হাত–পা নাড়াচাড়া করে খাওয়াদাওয়া সেরে রওনা হলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি পা থেকে সব অনুভূতি গায়েব। শুধু মনের জোরে হাঁটতে পারছি। আবার সেই ছয় ঘণ্টার হাঁটা পথ পাড়ি দিয়ে কিছুটা পথ নৌকায় চড়ে রোয়াংছড়ি সদরে পৌঁছলাম। আমার অবস্থাই মনে হয় একটু বেশি নাজেহাল ছিল, তাই বারবার পিছিয়ে পড়ছিলাম।

পাহাড়ি কলা, পেঁপে, আদা ও কলার মোচা। ছবি: লেখক
পাহাড়ি কলা, পেঁপে, আদা ও কলার মোচা। ছবি: লেখক

রোয়াংছড়ি বাজারের রাস্তা পাড়ি হওয়ার সময় ডাব দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। দোকানে গেলে এক অবাক করা কথা শুনলাম। ডাবের কথা বলতেই দোকানদার বলে উঠল ঠান্ডা ডাব খাবেন নাকি! আহ শান্তি শান্তি। ওদিকে আরেক ঝামেলা হয়ে গেছে। রোয়াংছড়ি থেকে বান্দরবানের শেষ বাস ছাড়ে পাঁচটায় আর আমরা রোয়াংছড়ি পৌঁছলাম প্রায় ছয়টার দিকে। কী আর করার, পুরা একটি বাস ভাড়া করে নেওয়া লাগল আমাদের আটজনের জন্য। যেই আমি কিছুক্ষণ আগে হাঁটতে পারছিলাম না, সেই আমার বাস দেখে আবার ছাদে চড়ার লোভ জাগল। এর মধ্যে আবার গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও হচ্ছে। ঘণ্টাখানেক বাদে বান্দরবান হাজির হলাম। যাওয়ার পথে বহুকাল বাদে এত স্পষ্ট ও বড় রংধনু দেখতে পেলাম।

সুস্বাদু মাছভর্তার পর এল গরু মাংস
ফেরার পথে মাথায় এক চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল, জম্পেশ একটি ভূরিভোজ দিতে হবে এবার। ট্র্যাকিং সঙ্গী এক বড় ভাই এক চিপার ভাঙা দোকানে নিয়ে গেল। আমি কোনোমতেই এই দোকানে ভূরিভোজের জন্য রাজি নই। ভাই বলে, এই দোকানের খাবার ভালো, আর এত সস্তায় এর চেয়ে ভালো খাবার পাওয়া যাবে না। এই লোকটার ওপর আমার এসব বিষয়ে অগাধ আস্থা। পুরান ঢাকার নানান গলির বিখ্যাত খাবারের সঙ্গে এই লোকটাই যে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন আমাকে। খাবার এল, প্রথমেই মাছভর্তা। খিদে ছিল বলেই কি না জানি না, মাছভর্তা মুখে দিতেই মনে হলো এমন সুস্বাদু মাছভর্তা আমি আগে কখনো খাইনি। এরপর এল গরুর মাংস। এটিও ভালো ছিল। খাওয়াদাওয়া সেরে রাস্তার পাশে জড়ো করা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে হাতে থাকা কোমল পানীয় খাচ্ছিলাম। মনটা বেশ শান্ত আর পরিশ্রান্ত। মনে মনে ভাবছিলাম, জীবনের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ দেওয়ার জন্য শ্রেষ্ঠ কষ্টটাই করতে হয়েছে।

বাস রওনা হলো ঢাকার উদ্দেশে। ফেরার যাত্রা শুরু হয়ে গেল। আবার সেই ব্যস্ত জীবনে ফিরে আসার জন্য রওনা হলাম আমরা। এই ভ্রমণটি আবার মনে করিয়ে দিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের সেই প্রশ্নের ‘জীবন এত ছোট ক্যানে’।