করোনাভাইরাস: অনলাইন ক্লাস নিয়ে বিকল্প ভাবনা

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ বর্তমান বিশ্বের এক আতঙ্কের নাম। এ মহামারি সারা বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। বিশ্বের ১৬০ দেশেরও অধিক দেশ তাদের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে।

কোভিড-১৯–এর জন্য সারা বিশ্বের ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত চিন্তা ও ভাবনার বিষয়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য যা অত্যন্ত আতঙ্কের বিষয় তো বটে! সরকার ১৮ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। অনেকেই মনে করছেন, এটা আরও বর্ধিত হতে পারে।

দীর্ঘ বন্ধে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরের প্রায় শিক্ষার্থীরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় যাতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে ব্যাঘাত না হয়, তার জন্য সরকার ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ই-পাঠদানের (ভিডিও ক্লাস) মাধ্যমে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য জুম অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে পাঠদানের ব্যবস্থা করছে, যা দ্রুত শুরু করা অত্যন্ত জরুরি।

কিন্তু এ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে পাঠদান করার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? এ মাধ্যমগুলো দিয়ে পাঠদান করতে গেলে কিছু সমস্যার কথা প্রথমেই অনুমান করা যায়, তা হলো অনেক শিক্ষার্থীর বাসায় টিভি, রেডিও বা মোবাইল ফোনের কোনোটাই নেই, অনেক শিক্ষার্থী আছে, যার ইন্টারনেট সংযোগ নেই বা অনেক ধীরগতিসম্পন্ন। তাহলে এই শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা কীভাবে পাঠদান নিশ্চিত করব?

এ ক্ষেত্রে আমাদের যা করতে হবে, তা হলো প্রত্যেক শিক্ষকের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। প্রত্যেক শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের অবস্থা যাচাই করবেন; তাঁর শিক্ষার্থীরা এই মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে পাঠদানে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না, তা যাচাই করবেন। তাদের সমস্যাগুলো এবং বিকল্প উপায়গুলো চিহ্নিত করবেন। যেমন ধরা যাক, কোনো শিক্ষার্থীর বাসায় টিভি, রেডিও বা মোবাইল—এর কোনোটাই নেই। তাহলে সে কী করবে? সে কীভাবে পাঠদানে অংশগ্রহণ করবে? সংশ্লিষ্ট শিক্ষক এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে সহায়তা করবেন। যেমন: কীভাবে অন্যের সাহায্য নিয়ে পাঠে অংশগ্রহণ করবে, তার ব্যবস্থা করে দেবে, কোন শিক্ষার্থীর সঙ্গে জোড়া (ট্যাগ) করে দেবে অথবা এলাকার মধ্যে যার বাসায় টিভি, রেডিও বা মোবাইল আছে, এমন পরিবারে সাহায্য নিয়ে তার পাঠদানে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সর্বক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবে এবং শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।

সরকার একটি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদান পরিচালনা করছে। কিন্তু এটা কতটা যৌক্তিক? বাংলাদেশে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ১২০–এর অধিক পাঠ্যপুস্তক। ধরি ১২০টি পাঠ্যপুস্তক, এই শতাধিক বিভিন্ন বিষয়ের বা শ্রেণির পাঠদান কি একটি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে আদৌ সম্ভব? অন্যদিকে, সব বিষয়ের পাঠদান কি জরুরি? তা বিবেচনার বিষয়। ধরি সব বিষয়ে পাঠদান জরুরি না, এ ক্ষেত্রে কিছু অত্যাবশ্যক বিষয়ের ক্ষেত্রে পাঠদান তো অবশ্যই জরুরি। সব শ্রেণির কিছু অত্যাবশ্যক বিষয়ের পাঠদান করতে গেলেও একটি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠদান করা কষ্টসাধ্য বিষয় হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একাধিক টিভি চ্যানেল ও রেডিও সেন্টারকে ব্যবহার করে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কখন কোনো চ্যানেলে কোনো শ্রেণির কোনো বিষয়ের পাঠদান করা হবে, তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকতে হবে এবং তা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। যাতে সব শিক্ষার্থী সময়মতো পাঠে অংশগ্রহণ করতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে সব শিক্ষার্থীর পাঠে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য পাঠের রেকর্ড বিভিন্ন মাধ্যমে বিস্তরণ করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য জুম অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে পাঠদানের ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান সমস্যা হচ্ছে ইন্টারনেট সমস্যা। এর পরেই যে সমস্যা আসে তা হচ্ছে ডিভাইসের (ল্যাপটপ/কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোন নেই বা সমস্যাগ্রস্ত ডিভাইস) সমস্যা বা অপ্রতুলতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে, যেখানে অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সংযোগ নেই বা অনেক ধীরগতিসম্পন্ন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যা করতে পারে, তা হলো শিক্ষার্থীদের অবস্থা যাচাই করা, কতজন শিক্ষার্থীর জুম অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে পাঠদানে অংশগ্রহণ করতে সমস্যা হচ্ছে। ধারণা করা যাচ্ছে, এ ধরনের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হবে না। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। যেমন আশপাশের কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে জোড়া (ট্যাগ) করে দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি কমন শেয়ার ড্রাইভ করতে পারে, যেখানে পাঠগুলো সংরক্ষণ করতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধামতো সময়ে ডাউনলোড করে পড়তে পারে। সর্বোপরি শিক্ষা হোক মুক্ত এবং উন্মুক্ত।

লেখক: উন্নয়নকর্মী