নীল সাগরের মালদ্বীপে যেমন কাটল

১২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ। ছবি: রয়টার্স
১২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ। ছবি: রয়টার্স

কর্মব্যস্ত জীবনে ফুরসত পাওয়া যেমন কঠিন, তেমন সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া অবসর আনন্দময় করে কাটানোও সহজ নয়। সরকারি কাজে মাঝেমধ্যে বিদেশে সফরের সুযোগ মিললেও দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের মধ্যে নিজের পছন্দের জায়গায় বা পরিবেশে যাওয়া হয়ে ওঠে না। ফলে বিদেশ ঘুরে এলেও মনের মধ্যে একটা অতৃপ্তি থেকেই যায়। পছন্দের জায়গা বা দর্শনীয় জায়গায় না যেতে পারার আফসোস মনের মধ্যে গুমরে কাঁদে। তা ছাড়া সরকারি সফরে পরিবার-পরিজন নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তো তেমন থাকে না। তাই পরিবার নিয়ে ভারতের সিকিম, দার্জিলিং ও মালদ্বীপ ভ্রমণের জন্য অফিস থেকে ছুটি নিই।

ট্যুর পরিকল্পনা মোতাবেক প্রথমে ভারতে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিই। দার্জিলিং ভ্রমণের পর সিকিম যাওয়ার পরিকল্পনা করি। অনিবার্য কারণে সিকিমের রংপো পর্যন্ত যাওয়ার পর ফিরে আসতে হয় শিলিগুড়িতে। শিলিগুড়িতে এসেই এনআরসি নিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ডাকা আন্দোলনের মধ্যে পড়ে যাই। দুদিন হোটেলে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আনন্দ করতে এসে আন্দোলনের মধ্যে পড়ে যাওয়ায় মন ছিল বিক্ষিপ্ত। এ বিষয়ে পরে লেখার আশা রাখছি। এ সময়ই বন্ধু কামালের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে পরিবারকে ঢাকায় রেখে দুই বন্ধু মিলে মালদ্বীপ ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। এ লেখায় নীল সাগরে দেশ মালদ্বীপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই।

মালদ্বীপে সাগরপাড়ে নীল পানির মধ্যে ওয়াটার ভিলা দাঁড়িয়ে আছে অতিথির অপেক্ষায়। ছবি: লেখক
মালদ্বীপে সাগরপাড়ে নীল পানির মধ্যে ওয়াটার ভিলা দাঁড়িয়ে আছে অতিথির অপেক্ষায়। ছবি: লেখক

কামাল ঢাকা থেকে মালদ্বীপের এয়ার লাইনসে মালদ্বীপ যাওয়ার টিকিটের বন্দোবস্ত করে ফেলে। বিমান টিকিট কেটে মেসেজ পাঠায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মালদ্বীপ এয়ার লাইনসের একটি বিমানযোগে চেন্নাই হয়ে মালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে যায়।

ভ্রমণসূচি অনুযায়ী ঢাকা থেকে বিকেল সাড়ে চারটায় বিমান ছেড়ে চেন্নাই হয়ে যাব মালদ্বীপের বিমানবন্দর মালে ভ্যালেনাতে। চার ঘণ্টায় মালেতে। বাচ্চাদের স্কুল শুরু হওয়ায় এবং বিমান টিকিটের অগ্নিমূল্যের কারণে তাদের আর মালদ্বীপ নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না।

১৪ জানুয়ারি কলকাতা থেকে বিমানে ঢাকায় ফিরি। রাতটা বাসায় কাটিয়ে ১৫ জানুয়ারি ফ্লাইট ছাড়ে এক ঘণ্টা লেটে। ৫টা ৪০ মিনিটে ফ্লাই করি আমরা। বিমানের খাবার গুণগতভাবে উত্তম ছিল। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর চেন্নাই বিমানবন্দরে নামি। চেন্নাইগামী যাত্রীরা নেমে গেলেন। চেন্নাই থেকে মালদ্বীপগামী যাত্রী বিমানে উঠলেন। চেন্নাই থেকে ছাড়ার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর মালে বিমানবন্দরে পৌঁছালাম আমরা। মাঝপথে রাতের পরিবেশিত খাবারও যথেষ্ট ভালো মানের ছিল। ফলে মালেতে নেমে রাতের খাবার নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না।

মালে বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন শেষ করতে মাত্র ৫ মিনিট সময় লাগে। ইমিগ্রেশন অফিসার শুধু জানতে চান কেন এসেছি? কত দিন থাকব? ব্যস, পাসপোর্টে সিল মেরে বিদায়। ইমিগ্রেশন পার হয়ে গাড়িতে করে সরাসরি হোটেলে। হোটেলে যেতে বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি গাড়ি দিয়ে বিশেষভাবে সাহায্য করেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা। সে জন্য তাঁদের অনেক ধন্যবাদ। মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মাথায় মালে বিমানবন্দর থেকে হুলহুলমালে নামক স্থানে আমাদের আগেই বুকিং করা হোটেলে পৌঁছে যাই। হোটেলের কর্মচারী জহির আমাদের অভ্যর্থনা জানান। কিন্তু রুমে যাওয়ার পর ধাক্কা খেলাম। কারণ দুজনের জন্য একটি ডাবল বেড। বন্ধু আমরা ঘনিষ্ঠ হলেও দুজনের পক্ষে এক বেডে ঘুমানো হয়নি কখনোই। এমনকি কখনই একসঙ্গে কোথাও রাত্রিযাপন করা হয়নি। জহিরকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি অতি দ্রুত আরেকটি ছোট খাটের ব্যবস্থা করলেন। ছোট রুমে যেখানে একটি ডাবল বেড বসানোর পর জায়গা থাকে না, সেখানে আরও একটি ছোট খাট বিছানোর পর রুমের মধ্যে নড়াচড়া করাই কঠিন হয়ে পড়লেও উপায় তো নেই। তাৎক্ষণিক আরেকটি ছোট খাটের ব্যবস্থা করা জন্য জহিরকে ধন্যবাদ না দিলে নিছকই অকৃতজ্ঞতা হতো।

বিচে হোন্ডায় যুবক-যুবতীর ঘোরা
ফ্রেশ হয়ে রাত ১১টায় হোটেলের পাশেই সি বিচে গেলাম ঘুরতে। পূর্ণ চাঁদের আলো নীল পানিতে পড়ে সে এক স্বর্গীয় রূপ ধারণ করেছে। দৃষ্টিসীমানার বাইরে যত দূর চোখ যায় সাগরের পানির ওপর চাঁদের আলো আর পানির তরঙ্গের যে রূপবৈচিত্র্য, ঢেউয়ের মূর্ছনা হৃদয়ে এক অব্যক্ত আনন্দের হিল্লোল যেন বয়ে দিল। কথা না বলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চোখের সবটা তৃষ্ণা, হৃদয়ের সবটা উচ্ছ্বাস নিয়ে চুপচাপ উপভোগ করলাম সে আনন্দ। বিচের কিনারায় অজস্র কাঁকড়া দৌড়াদৌড়ি করছে আর সে কাঁকড়া শিকারের জন্য ছোট-বড় মাছ সাগরের কিনারায় এসে ভিড় করছে। মাঝেমধ্যে কাঁকড়া শিকার করতে বেশ বড় আকারের মাছও একদম বিচের পানির শেষ সীমানায় উঠে আসছে—এ দৃশ্যও ছিল অবাক করা। ঘণ্টা খানেক সময় কাটিয়ে শরীর-মন যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল।

মালদ্বীপে একই সাগরের পানি পাশাপাশি দুই ধরনের বর্ণ ধারণ করে। এক জায়গায় নীল আরেক জায়গায় গাঢ় নীল। দূর থেকেও পানির ভিন্ন ভিন্ন রং চোখে পড়ে। ছবি: লেখক
মালদ্বীপে একই সাগরের পানি পাশাপাশি দুই ধরনের বর্ণ ধারণ করে। এক জায়গায় নীল আরেক জায়গায় গাঢ় নীল। দূর থেকেও পানির ভিন্ন ভিন্ন রং চোখে পড়ে। ছবি: লেখক

দুই বন্ধু মিলে এবার সাগরপাড়ের সীমানা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। এত রাতে মালদ্বীপের সাগরপাড়ের সীমানা ধরে হাঁটতে কিছুটা শঙ্কাও লাগছিল। কারণ মাথায় লম্বা লম্বা চুলের অধিকারী যুবকেরা দলে দলে হোন্ডা নিয়ে সাগরপাড়ে ঘুরছে। কারও কারও হোন্ডার পিছে আবার যুবতী দেখা যাচ্ছিল। রাত ১২টা থেকে ১২টা ৩০ মিনিটে এ রকম দৃশ্য দেখে অবাক হওয়ার পাশাপাশি কিছুটা হলেও ভীতিও কাজ করছিল। সাগরপাড় হেঁটে প্রায় রাত দেড়টার সময় ফিরে এলাম হোটেলে। হোটেল গিয়ে দেখলাম, বেচারা জহির ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে বসে আছে আমাদের প্রতীক্ষায়। আমরা লজ্জিত হলাম, তাঁর কাছে জেনে নিলাম হোটেলে ফেরার সর্বশেষ সময় রাত ১২টা। আমাদের মালদ্বীপে আসা এবং প্রথম দিনের অভিযান এভাবে সম্পন্ন করে আমরা ঘুমাতে গেলাম।

ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন
ভ্রমণজনিত সারা দিনের ক্লান্তি আর মালদ্বীপে নেমেই সাগরদর্শন ও সাগরপাড়ের তীর ধরে হাঁটাহাঁটির দরুন এবং রাত্রিও অনেক হওয়ার কারণে বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কামাল যে রাতে কতটা নাক ডাকল, তা আর বুঝতে পারলাম না। কামালের নাসিকাগর্জন যেহেতু শুনতে পেলাম না, তাতে বুঝতে পারলাম রাতের ঘুম ভালোই হয়েছে। সকাল ৭টার দিকে ঘুম থেকে উঠলাম। তোড়জোড় শুরু হলো সকাল ৯টায় ডে ট্যুরে যাওয়ার জন্য। রাতেই জহিরের সঙ্গে কথা বলে জাহাজযোগে সমুদ্রভ্রমণ ও দ্বীপে যাওয়ার প্রোগ্রাম ঠিক করা ছিল। একটি দ্বীপে যাওয়া, দ্বীপে যাওয়ার সময় ডুবো দ্বীপে নামা এবং জলকেলি করার কর্মসূচি ঠিক করা ছিল। দ্রুত নিচে নামলাম হোটেলের কমপ্লিমেন্টারি নাশতা খেতে। জহির জানালেন আজ কোনো একটা সমস্যার কারণে নাশতা দেওয়া হবে না। অগত্যা অন্য এক হোটেলের রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। ওই হোটেলে নাশতা সেরে দ্রুত ফিরে পানিতে নামার কাপড়চোপড় নিয়ে নিচে অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে জেটিঘাটে নিয়ে এল। দিনের সমুদ্রের পানে তাকিয়ে অন্তরাত্মা এক অপরিমেয় আনন্দে নেচে উঠল। যত দূর চোখ যায় শুধু নীল পানি আর মাঝেমধ্যে চলমান জাহাজ, স্পিডবোট আর মাথার উপর সি-প্লেনের আওয়াজ। বহু দূরে দূরে কিছু কিছু দ্বীপের ছবি যেন হাতছানি দিয়ে আয় আয় বলে ডাকছে। একি অপরূপ দৃশ্য! একি হৃদয় হরণ করা প্রকৃতি? পরম করুণাময়ের একি অপার সৃষ্টি! তন্ময় হয়ে ভাবতে ভাবতেই মাঝির তথা জাহাজের কাপ্তানের তাগাদা এল জাহাজে ওঠার। আমরা যাত্রী ২৪ জন। জাহাজের কাপ্তান ও অন্যরা মিলে ৪ থেকে ৫ জন। জাহাজের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৩০ জন ও মাঝি মাল্লা ৪ থেকে ৫ জন। বাংলাদেশি আমরা দুজন, পাকিস্তানি এক জুটি, যাঁদের দেখে মনে হলো হানিমুনে এসেছেন। ভারতীয় দু-তিনটি পরিবার। ইউরোপীয় একটি পরিবার এবং অন্য ট্যুরিস্ট, যাদের পরিচয় নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

জাহাজ আমাদের নিয়ে রওনা দিল প্রায় সকাল সাড়ে ৯টায় ঘটিকায়। নীল পানি কেটে কেটে জাহাজ চলছে। মাঝেমধ্যে স্পিডবোটের ঢেউয়ের ধাক্কায় দোলায় দুলছে জাহাজ। আবার কোথাও কোথাও প্রচণ্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছে আমাদের ছোট্ট জাহাজখানি।

রাতের মালদ্বীপের জেটিঘাট। ছবি: লেখক
রাতের মালদ্বীপের জেটিঘাট। ছবি: লেখক

ছোট-বড় অনেক দ্বীপ পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ। কোথাও কোথাও দ্বীপের ধার ঘেঁষেই সাগরের নীল পানির মধ্যে ওয়াটার ভিলা দাঁড়িয়ে আছে অতিথির অপেক্ষায়। দ্বীপের নানা প্রকৃতির গাছপালার মধ্যে ওয়াটার ভিলা আর রেস্টহাউসগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওয়াটার ভিলাগুলো দেখে সেখানে থাকার এক সুপ্ত ইচ্ছা প্রচণ্ড ধাক্কা দিচ্ছিল মনের মধ্যে। একই সঙ্গে এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যে কত কঠিন কাজ, সে চিন্তাও মাথার মধ্যে কিলবিল করছিল। মনকে বোঝালাম এসব চিন্তা রাখো বাপু, আপাতত আকাশ আর নীল পানির মিতালির মধ্যে তুমি অবগাহন করো। ওয়াটার ভিলায় থাকার শখ পারলে পরে মিটিয়ে নিয়ো যদি সাধ্যে কুলায়।

ভাবতে ভাবতেই একটি আধো জাগা আধো ডুবন্ত দ্বীপে এসে জাহাজ থামল। জাহাজ থামার একটু আগে থেকেই জাহাজের এক সহকারী এসে সবার মোবাইল একটি ওয়াটার প্রুফ ব্যাগে ভরে নিলেন। কী উদ্দেশ্যে এটা করল তা বুঝতে পারলাম না তখন। জাহাজ থামার সঙ্গে সঙ্গেই জাহাজের সহকারী দুজন মাস্ক আর ফিঞ্জ পরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমাদের প্রতি আহ্বান এল তোমরা এখানে এক ঘণ্টা পর্যন্ত পানিতে লাফানো, ঝাঁপানোসহ যত পারো আনন্দ করতে পারো। এ আহ্বান শোনা মাত্র ছয়-সাত বছরের বয়সে যমুনা নদীতে সাঁতার কাটার স্মৃতি কানে কানে, মনে মনে, প্রাণে প্রাণে সুর তুলল, ‘তুই কেন বসে আছিস এমন লগনে? নাম পানিতে। ঝাঁপ দে তুই পানিতে!’ আর কী করা, মন-প্রাণ যদি এমন করে বলে, তাহলে তো মানতেই হয় মনের কথা! যখন চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছি পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য, অমনি কামালের ডাক। তিনি ডেকে ডেকে বলছেন কী হবে? আরে কী হবে মানে কী? ভালো করে তাকিয়ে বুঝলাম জিনসের প্যান্ট পরনে আর হাতে লুঙ্গি নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। বুঝলাম জানতে যাচ্ছে লুঙ্গি পরে সাগরে নামবেন না জিনস পরে? মনে হলো এ কোন চিড়িয়ার পাল্লায় পড়লাম! সাগরবিহারে এসেছে জিনস পরে আর হাতে নিয়েছে লুঙ্গি! শাবাশ বাঙালি শাবাশ! বললাম ভাই, এই ভারত মহাসাগরে হয়তো কোনো দিন কোনো বাঙালি লুঙ্গি পরে নামেনি। ভবিষ্যতেও হয়তো কেউ নামবে না। অন্তত একটা রেকর্ড করার সুযোগ হাতছাড়া কেন? লুঙ্গি পরেই নেমে পড়ো। সাগরে তাতে বাঙালি জাতির একটা নতুন রেকর্ডও হবে (যদিও গিনেস বুকে রেকর্ড করার সুযোগ নেই)। আবার কাছা মেরে বাঙালির লুঙ্গি ড্যান্সও করাও হবে। একটু ইতস্তত করে আল্লাহ ভরসা বলেই লুঙ্গি কাছা মেরে নেমে পড়েন কামাল। আমি তো আগে থেকেই তৈরি ছিলাম এক ধাপ। সাঁতার কেটে দ্বীপের বালিতে এসে এলিয়ে দিলাম শরীর। ওমা! এ বালি তো বালি না এ যেন পাথরের বালি। যেমন ভারী তেমনি মোটা আর সাদা। অসাবধানে শরীরে লাগলে জ্বলতে থাকে শরীর। আমার হাঁটুতে একটু বেশি চাপ লাগায় ছাল-বাকলা উঠে জ্বালা করতে থাকল। বিদেশে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো কে কী কাপড় পরল, এগুলো নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আর এখানে মাঝসাগরে তো সবাই ব্যস্ত আনন্দ আর জলকেলিতে। কাজেই কে লুঙ্গি পরে সাগরে নামল আর কে নেংটি পরে নামল, তা দেখার কেউ তো নেই? আমাদের যেখানে সাগরে নামানো হলো, সে স্থানটি হলো সাগরের মাঝে একটি আধা ডুবো দ্বীপ। একদিকে গভীর পানি আর অন্য তিন দিকে কোথাও হাঁটুপানি বা তারও কম স্বচ্ছ নীল পানি। পানির নিচের কোরাল, ছোট-বড় মাছ আর ছোট ছোট জলজ গাছপালা ও শামুক, ঝিনুক পানির ওপর থেকেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল।

মালদ্বীপ সৈকতে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
মালদ্বীপ সৈকতে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

পর্যটকেরা যার যে রকম ইচ্ছা তেমনভাবেই আনন্দ করছে। কেউ দ্বীপের মাটিতে গা এলিয়ে দিয়ে রৌদ্রস্নান করছে। আবার কেউ পানির ভেতরে নানা শারীরিক ভঙ্গিতে ছবি তুলছেন। দুজোড়া কাপলকে দেখা গেল সাঁতারের পোশাক পরে জলদেবীর মতো জলে ভেসে ছবি তুলছেন। ইউরোপীয় পরিবারটি মুখে ওয়াটার মাস্ক ও পায়ে ফিন লাগিয়ে রঙিন মাছের দুনিয়ায় সাঁতরে বেড়াচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী আর তাদের ৫-৬ বছরের মেয়ে যখন পানিতে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, সে দৃশ্যও অনেক মনোহর লাগছিল। তাদের জলকেলির দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল যেন মা আর বাবা মাছ তাদের বেবি মাছকে নিয়ে জলকেলি করছে।

মালদ্বীপবাসীর দায়িত্ববোধে মুগ্ধ আমরা
দ্বীপে ডুবসাঁতার আর ছবি তোলা শেষে মাঝিদের ডাকে জাহাজে ফিরতে হলো। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো তা হলো দ্বীপে নামার আগে জাহাজের লোকজন সবার মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট সংগ্রহ করে একটি ওয়াটারপ্রুফ ব্যাগে করে দ্বীপে রাখে। দ্বীপে নেমে সবাই যার যার মোবাইল ট্যাব ব্যবহার করে ছবি তোলা শেষে আবার ব্যাগে রেখে দেয় এবং জাহাজে ওঠার পর জাহাজের মাঝিরা প্রত্যেক যাত্রীকে নিজ নিজ মোবাইল-ট্যাব ফেরত দেয়। এ কাজটা করার ক্ষেত্রেও কোনোরূপ হইচই বা ন্যূনতম বিশৃঙ্খলা হলো না। এ বিষয়টির মধ্যে দিয়ে পর্যটকদের প্রতি, তাদের জিনিসের প্রতি জাহাজের লোকজনের সার্বিক যত্নœআর ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার বিষয়টির দেখা মিলল। এখানে আরও একটি ঘটনা আমাদের নজর কাড়ে। একজন ভারতীয় পর্যটক একটি জীবন্ত কোরাল হাতে নিয়ে ছবি তুলছিলেন। এ সময় জাহাজের একজন কর্মচারী এগিয়ে এসে কোরালটি পর্যটকের কাছ থেকে নিয়ে সাঁতরে গিয়ে অনেক দূরে সেটি ছেড়ে দিলেন। দেশের প্রতি, দেশের সম্পদের প্রতি এ রকম দায়িত্ববোধ অতুলনীয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে এ রকম হলে হয়তো কোনো পর্যটক টাকা দিয়ে জীবন্ত কোরালটি কিনে নিতেন। যে সাগরের সম্পদে মালদ্বীপের মানুষের রুটি রুজির ব্যবস্থা হয়, সেই সাগরের সম্পদের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

সবাই ওঠার পর জাহাজ আবার চলতে শুরু করল আরেকটি দ্বীপের দিকে। ওই জাহাজে আমাদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রায় ৪০ মিনিট জাহাজ চলার পর আমরা পৌঁছালাম হিমাফুজি দ্বীপে। এটা একটা স্থানীয় দ্বীপ অর্থাৎ এ দ্বীপে মালদ্বীপের স্থানীয় লোকদের বাস। এখানে তুলনামূলকভাবে কম দামের হোটেল আছে। স্কুল, স্থানীয় প্রশাসন সবই আছে। এখানে আমাদের ফ্রাইড রাইস, চিকেন, সামুদ্রিক মাছ, ফলের রস এবং সালাত দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। খাবারের পর ৩০ মিনিট ইচ্ছামতো ঘোরাঘুরি করার সময় দেওয়া হলো। এ সময়ে যে যার যার ইচ্ছামতো দ্বীপের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘোরাঘুরি করা, ছবি তোলা, রৌদ্রস্নান করা আর কেউ কেউ দোলনায় দুলে বা গাছের ছায়ায় বেতের চেয়ার বা বেঞ্চে বসে গা এলিয়ে দিয়ে দুপুরের উজ্জ্বল রোদে কম্পমান নীল পানির রূপ দেখে সময় কাটালাম।

৩০ থেকে ৪০ মিনিট পর সবাই নির্দিষ্ট পয়েন্টে একত্র হয়ে দ্বীপের ডলফিন শপে কেনাকাটার জন্য গেলাম। জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। দামাদামি করলেও দু-একজন ব্যতীত অধিকাংশ পর্যটক কিছুই কিনলেন না। দোকানের পাশে গাছে ঢাউস সাইজের জামরুল থোকায় থোকায় ঝুলতে দেখে অনেকেই তা পেড়ে খেতে শুরু করলেন। আমরাও দু-চারটি পেড়ে মুখে দিলাম। সে এক অপূর্ব স্বাদ, গন্ধ আর রসালো জামরুল। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই জামরুল গাছ দেখলাম। এ সময় কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। আলাপ-আলোচনায় জানলাম, তারা বেশ ভালো আছেন। তারা এও জানালেন, মালদ্বীপের ফল খুব মিষ্টি।

আবার জাহাজে করে রওনা হলাম ডলফিন ক্রুজের উদ্দেশে। আমাদের ভাগ্য প্রসন্ন বলতে হবে, কিছুক্ষণ চলার পরই আমরা একঝাঁক ডলফিনের দেখা পেলাম। অনেকক্ষণ ধরে ডলফিনের দলকে তাড়া করলাম আর ওরাও যেন আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পানির ওপর ক্ষণে ক্ষণে ডিগবাজি দিয়ে আমাদের আনন্দ দিচ্ছিল। ছোট-বড় মিলে একসঙ্গে ১৫ থেকে ২০টি ডলফিনের ঝাঁক এর আগে কখনো দেখিনি। ডলফিন ক্রুজ দেখে আমরা এতই আনন্দিত যে মনে করলাম ট্যুরের টাকা ওয়াশিল হয়েছে।

জলকেলিতে পানি খেলাম
এরপর রওনা হলাম জলকেলি করার জন্য। এই শব্দটি জীবনে বহুবার শুনেছি, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতার সুযোগ হয়নি। জাহাজের একজন স্টাফের সাহায্য নিয়ে মুখে মাস্ক ও শরীরে লাইফ বেল্ট পরে নিলাম। বুঝে নিলাম পানির নিচে কীভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হয়। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে পানিতে দিলাম ঝাঁপ। প্রথম ধাক্কায় সাগরের লোনা পানি খেলাম বেশ খানিকটা। প্রথম ধাক্কা কাটানোর পর অন্যদের দেখাদেখি ডুব দিয়ে সাগরের তলদেশে তাকাতেই হাজারো বিচিত্র রঙের মাছের কলোনি দেখে আনন্দের প্রাথমিক ধাক্কা সামলানো কঠিন হয়ে পড়ল। বিভিন্ন পয়েন্টে ডুব দিয়ে দিয়ে সাগরতলের অজানা-অচেনা জগতের বর্ণিল মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর জগৎ দেখতে থাকলাম আনন্দিত চিত্তে। সাগরতলের বিচিত্র বৈচিত্র্যময় জগৎ আর বর্ণিল মাছের জগতে বিচরণ করে ঘণ্টাখানেক কাটালাম। শেষের দিকে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। স্রোতের টানে অনেকটা পিছে চলে এসেছিলাম সামনে এগোতে পারছিলাম না। হাত উঁচিয়ে সাহায্য চাইলে জাহাজের লোকজন যারা আমাদের পানিতে দেখ ভালো করছিল, তাদের একজন দ্রুত এসে জাহাজে তুলে নিল। জাহাজে ওঠার পর দেখলাম কামাল বসার বেঞ্চে গা এলিয়ে শুয়ে আছে। অবস্থাদৃষ্টে বুঝলাম কিছুটা পানি খেয়েই আর অনভ্যাসের কারণে এমন কাহিল হয়ে পড়েছে। জাহাজে ওঠার পর দ্বিতীয় ব্যাচ সাগরে নামল। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাচের পর্যটকেরা স্রোতের তীব্রতার কারণে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি টিকতে পারল না।

সবাই জাহাজে ওঠার পর জাহাজ চলতে শুরু করল। আমাদের গন্তব্য হুলহুলমালে দ্বীপ যেখানে আমাদের হোটেল। আমাদের আরও দুটি স্থানে যাওয়ার কথা থাকলেও সময়স্বল্পতার কারণে যাওয়া সম্ভব হলো না। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছলাম। গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অস্তগামী সূর্যের সোনালি আভায় দিগন্তবিস্তৃত সাগরের রূপ দেখতে দেখতে মনকে শুধালাম আবার কি হবে দেখা এমন রূপে তোমার সনে? হয়তো হবে হয়তো বা হবে না। তবু তোমার এরূপ বহু দিন জাগরূক থাকবে এ মনে, এ হৃদয়ের কোনো এক গহিন প্রকোষ্ঠে। চিন্তা মগ্ন হয়ে ভাবতে ভাবতেই জাহাজ পাড়ে ভিড়ল। কে কোনো হোটেলের যাত্রী, সে অনুযায়ী আগে থেকেই ঠিক করা গাড়িতে উঠতে বলা হলো। জেটিঘাট থেকে মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিটে আমরা পৌঁছে গেলাম হোটেলে। স্টাফ জানতে চাইল ট্যুর কেমন ছিল? এক কথায় উত্তর দিলাম লা-জবাব। এ ট্যুরের জন্য আমাদের জনপ্রতি খরচ হলো ৬৫ মার্কিন ডলার। হোটেলে ফিরে ফ্রেস হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবার খেলাম একটি স্থানীয় রেস্টুরেন্টে।

এরপর যথারীতি পাড়ে গিয়ে বসলাম চাঁদের আলোয় সাগরের সৌন্দর্য দেখতে। রাতের বেলায় সাগরপাড়ে লোকজনের সমাগম অত্যন্ত কম। দু–তিন ঘণ্টা সাগরপাড়ে সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। জহির, একটা ফাইভ স্টার হোটেলে যাওয়া-আসা, কিছু সময় অবস্থান করা ও দুপুরের খাবারসহ জন প্রতি ১৬০ মার্কিন ডলারের একটি ট্যুর প্যাকেজ অফার করে। এটি ব্যয়বহুল এবং মনঃপূত না হওয়ায় আমরা তা গ্রহণ না করে বিকল্প ট্যুর প্রোগ্রাম নিজেরাই তৈরি করি। উদ্দেশ্য এক দ্বীপে রাত্রিযাপন। আমরা একটা হোটেল বুকিং দিই ১৩০ ডলার ভাড়ায়। যাতায়াত খরচ জনপ্রতি ৩৫ মার্কিন ডলার। ফোনে হোটেলে যোগাযোগ করে জেনে নিই কয়টার সময় জেটিঘাটে পৌঁছাতে হবে। সকাল ১০টায় জেটিঘাটে জাহাজ ধরার উপস্থিত হয়ে নির্ধারিত জাহাজ খুঁজে না পেয়ে হোটেলে ফোন দিয়ে জাহাজের বিষয়ে জানতে চাইলে হোটেল থেকে জানানো হয় যে শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় তাদের কোনো জাহাজ নেই। রাত সাড়ে ১০টায় তাদের জাহাজ আছে। অথচ সকাল সাড়ে ৮টার সময় জানানো হয় যে ৬ নম্বর জেটিঘাটে তাদের জাহাজ থাকবে। হোটেলের স্টাফ আমাদের স্পিডবোটে করে দ্বীপে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়। কিন্তু স্পিডবোটে জনপ্রতি ভাড়া ২৫০ মার্কিন ডলার, যা আমাদের সাধ্যের বাইরে এবং কল্পনাতীত ব্যাপার। এ যেন বারো টাকার গরু তেরো টাকার খড় খায় এমন অবস্থা। হোটেলভাড়া ১৩০ ডলার আর দুজনের যাতায়াত খরচ ৫০০ ডলার! বুঝতে পারলাম এটা হোটেল কর্তৃপক্ষের কৌশল বা অপকৌশল। সৌভাগ্যবশত মোবাইলে ইন্টারনেট থাকায় জেটিঘাটে দাঁড়িয়েই সঙ্গে সঙ্গে হোটেল বুকিং বাতিল করে ১৩০ মার্কিন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেলাম।

যত গুড় তত মিঠা
মনে মনে ভাবলাম, হুলহুলমালের যে হোটেল লাগেজ রেখে এসেছি, নিজেদের ব্যবস্থাপনায় ট্যুর না করে সেখানে ফিরে যাওয়া সম্মানজনক হবে না। অথচ জেটিঘাটেও তো কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। অগত্যা এয়ারপোর্টে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ বিমানবন্দরে বড় হোটেলগুলোর এজেন্ট বা প্রতিনিধি ছোট ছোট ডেস্ক নিয়ে বসে আছে যাত্রীদের ট্রান্সফার হতে সহায়তা করার জন্য। অতএব একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে রাজধানী মালের জেটিঘাট থেকে মালের এয়ারপোর্টে পৌঁছে মোবাইলে ফ্লেক্সিলোড করে নিলাম। এরপর বুকিং ডটকমে গিয়ে হোটেল খোঁজা শুরু করলাম। সমস্যা হলো হোটেলের ভাড়া ১৫০ থেকে ২০০ ডলার হলেও ট্রান্সফার কস্ট ৪০০ থেকে ৭০০ বা আরও অধিক। খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত ২২০ ডলারের একটা ফাইভ স্টার হোটেল পাওয়া গেল যাতে ট্রান্সফার ফ্রি। এয়ারপোর্টের সংশ্লিষ্ট হোটেলে ডেস্কে গিয়ে হোটেল এজেন্টের নম্বর থেকে ফোন দিয়ে বিনা খরচায় যাতায়াতের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে হোটেল বুকিং কনফার্ম করলাম। এজেন্ট জানাল সাড়ে ১২টায় আমাদের স্পিডবোটে উঠতে হবে এবং ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছতে পারব। নির্ধারিত সময়েই ফাইভ স্টার মানের স্পিডবোটে আমরা রওনা হলাম। নীল সাগরের উত্তাল ঢেউ ভেঙে, শহর ছেড়ে, ছোট বড় দ্বীপ অতিক্রম করে এগিয়ে চলল স্পিডবোট। কখন ২০ থেকে ২৫ মিনিট কেটে গেল, তা বোঝার আগেই চলে এলাম হোটেলে। ওয়েলকাম ড্রিংকস পান করতে করতে চেকিংয়ের কাজ শেষ হলো। মাথার ওপরে হুটওয়ালা চারদিকে খোলা এক ধরনের গাড়ি এসে হাজির আমাদের হোটেল কক্ষে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গাড়িতে বসার পর চালক যেতে যেতে দ্বীপের কোন দিকে কী আছে, তা আমাদের জানিয়ে এবং দেখিয়ে দিল। আমরা রুমে পৌঁছালাম অল্প সময়ের মধ্যেই। কিন্তু রুম দেখে আনন্দ হলেও রুমের অবস্থান দেখে একটু মন খারাপ হলো। কারণ আমাদের রুমে সি ভিউ নেই। দুপাশে সাগর কিন্তু রুম থেকে সাগর দেখা যায় না। খোঁজ নিয়ে জানলাম সি ভিউ রুমের ভাড়া ৩৫০ থেকে ৫০০ ডলার, যা আমাদের জন্য অনেক বেশি। আর ওয়াটার ভিলার ভাড়া ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার। অতএব মনকে সান্ত্বনা দিলাম যত গুড় তত মিঠা। গুড় যেহেতু কম দিয়েছি, মিঠাও একটু কমই খেতে হবে। তবে দমার পাত্র নই আমরা। বাঙালি যদি দমার পাত্রই হতো, তাহলে ইংরেজি না জানা, আধা শিক্ষিত কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাইমারি পাস ও কোনোরূপ ইংরেজি জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও এই হাজার দ্বীপের দেশে লক্ষাধিক বাঙালি রুটিরুজি করতে পারত না। আর আমরা সামান্য বেড়াতে এসে কম টাকায় (যদিও আমাদের কাছে কম না) বেশি আনন্দ লুটতে পারব না, তা তো হয় না। অতএব হ্যান্ড লাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়লাম দ্বীপের রহস্য উন্মোচনে। সমগ্র দ্বীপের চারদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। প্রথমেই গেলাম রুম থেকে সামান্য দূরে সি বিচে। যেখানে সারি সারি ওয়াটার ভিলা। সি বিচে বসে ভাবতে থাকলাম, কারা থাকে এই ওয়াটার ভিলাগুলোতে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার খরচ করে করে? তাদের মাসিক আয় কত? হঠাৎ মনে পড়ল আমাদের স্পিডবোট ছাড়ার আগে মধ্যপ্রাচ্যের এক যুগল নিয়ে একটি স্পিডবোট ছেড়ে এল। টাকায় কী না হয়! আমাদের সঙ্গে এল কিছু ইন্ডিয়ান, কিছু ইউরোপীয় এবং অন্যান্য দেশের লোক। ওয়াটার ভিলাগুলো থেকে দ্বীপে যাতায়াতের জন্য ব্রিজ দেওয়া আছে। প্রতিটি ওয়াটার ভিলা থেকে পানিতে নামার জন্য আলাদা আলাদা সিঁড়ি দেওয়া আছে। স্যানিটারি ব্যবস্থা এরকমভাবে করা তাতে কোনো ময়লা–আবর্জনা পানিতে মিশবে না। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য কতটা সচেতন হলে এটা করা সম্ভব। সি বিচে কোথাও কোনো ময়লা দেখতে পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতে বেইলি ব্রিজ দিয়ে সংযোগ করা পাশের ছোট দ্বীপে গিয়ে দেখলাম ওখানে স্পা সেন্টারে সমুদ্রের গর্জন শোনা, নীল সাগর দেখা আর অনতিদূরে রাজধানী মালে শহরের ভিউ দেখতে দেখতে আনন্দময় সময় কাটানোর মনোরম এক ব্যবস্থাপনা। ব্রিজের নিচে বিচিত্র বর্ণের রঙিন মাছ সাঁতার কাটছে মনের আনন্দে। মাছ ধরার কোনো রকম ব্যবস্থা কোথাও দেখলাম না। হয়তো মাছ ধরা নিষেধ।

পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখতে ৬০ থেকে ৭০ মিনিট সময় লাগল। আর বিচিত্র বর্ণের ফুল, চেনা-অচেনা ফুল-ফলের গাছ, প্রজাপতি, বড় বড় ঝুরিওয়ালা বটবৃক্ষ, আর পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এই দ্বীপ যেন কল্পনার স্বর্গরাজ্য। বুঝলাম মানুষ কেন এত টাকা খরচ করে আসে এখানে। ইউরোপীয়রা আসে বেশুমার। কারণ তাদের কাজ প্রযুক্তিভিত্তিক। দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে বসে তারা তাদের দাপ্তরিক কাজ করতে পারে। আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ এখনো বহুদূরের পথ। সমস্ত কাজ ডিজিটালাইজ করে এমন উচ্চতায় যেতে আমাদের আরও অনেক সময় লাগবে। দ্বীপ ভ্রমণ করে আমরা রুমে ফিরে শাওয়ার নিয়ে হালকা খাওয়াদাওয়া করে দেহ–মনে ভরপুর আনন্দ নিয়ে দিলাম এক ঘুম। চারদিকে পিনপতন নিস্তব্ধতা, মাঝেমধ্যে ভেসে আসা পাখির কলরব, চোখে লেপে থাকা নীল সাগরের ছবি আর সাগরের তলদেশের রঙিন জগতের আবেশে প্রশান্ত মন নিয়ে নিদ্রাদেবীর হাতে সমর্পণ করলাম নিজেদের।

সাগরপাড়ে টেবিলে ডিনারের ব্যবস্থা
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ ঘুম ভেঙে যায় দূর থেকে ভেসে আসা মিউজিকের সুরে। দ্রুত তৈরি হয়ে নেই ডিনারের জন্য। ডিনারে গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। সাগরের পাড়েই টেবিল–চেয়ার পেতে ডিনারের ব্যবস্থা সঙ্গে স্থানীয় সংগীত দলের সুর মূর্ছনা আর দল বেঁধে নৃত্যানুষ্ঠান চলছে। সঙ্গে অতিথিদের কেউ কেউ নাচে অংশ নিয়ে স্থানীয় ভাষায় গানের সঙ্গে তাল মিলাচ্ছে। আরেক পাশে বেহালার করুণ সুর ধ্বনিতে হৃদয় আকুল করা, কী হারানোর, কী না পাওয়ার এক বেদনাবিধুর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে নাম না–জানা এক শিল্পী।

আমরা বেহালাবাদকের সঙ্গেই যোগ দিলাম। মনে হচ্ছিল বেহালার সুর হৃদয়ের কোন সুতোয় যেন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। উদাস করে নিয়ে যাচ্ছে কোন সুদূর অতীতে যেখানে আমার একটা স্বপ্ন ছিল, আমার একটা ছবি ছিল, ছিল একটা বাঁধনহারা জীবন আরও ছিল কোনো এক স্বপ্নের মায়াবী মানবীর ছবি। বেহালাবাদকেরও কি এমন কোনো কিছু ছিল, যাকে বা যা হারিয়ে এই নীল বেদনা আর করুণ আর্তির সুর বাজিয়ে চলেছে। এরই নাম শিল্প ,একজন বাঁজায় অন্যজনকে কাঁদায় বা হাসায়। অন্য একজনের মনের ছবি আরেকজন আঁকে তার মনের মাধুরী দিয়ে। এরই নাম শিল্প আর যিনি এ রকম করেন, করতে পারেই তিনিই শিল্পী। শিল্প আর শিল্পী একাকার হয়ে শ্রোতা বা দর্শকের মনকে আনন্দে আন্দোলিত বা বেদনায় নীল করে তোলে।

সাগরের কল্লোল ধ্বনি, মৃদুমন্দ বাতাস, বেহালার করুণ সুর, সাগরের নীল পানিতে চাঁদের ঝিকিমিকি খেলা, মাথার ওপর আকাশের লাখো কোটি তারার মেলা এমন পরিবেশে প্লেটে সুস্বাদু খাবার আর হাতে পানীয় নিয়ে বসে আমরা দুই আদমসন্তান সাগরপাড়ের এক কোনায়। কারও মুখে কোনো কথা নেই, কথা যেটুকু হচ্ছে তা শুধু চোখের ভাষায়। কিন্তু কার মনে কী তুফান চলছে কেউ জানি না। আমরা কি মনের কোনো এক গহিনে জীবনের কোনো স্বপ্নের অপমৃত্যু দেখছি অতীতে গিয়ে? জীবনের কোনো অপ্রাপ্তিকে অতীতে গিয়ে কি আমরা নতুন করে উপলব্ধি করছি? জোর করে কি কোনো অশ্রু লুকোচ্ছি আধা আলো আঁধারে? হারিয়ে যাওয়া কোনো মুখ কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ছে বারবার? হবে হয়তো। মানবহৃদয় বড় জটিল। হৃদয়ের কোন কোটরে কি লুকায়িত থাকে তা অপর =জনের জানা হয়ে উঠে না দীর্ঘদিন একই ছাদের নিচে একই বিছানায় হরিহর আত্মা হয়ে জীবন যাপন করার পরও। আমরা মুক্ত মন, মুক্ত হৃদয়ের কথা বলি কিন্তু বেদনাহীন, দুঃখহীন, ক্ষতহীন হৃদয় কি মানুষের হয়? তাই তো জীবনানন্দ দাস লিখেছেন, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ তার মানে হৃদয়েবেদনা আছে, আমরা তাকে প্রকাশ করি না এই যা।

হঠাৎ বেহালার সুর থেমে গেল। স্বপ্নের জগৎ থেকে ফিরে এলাম বাস্তবে। বেহালাবাদকের বেহালা বাজানোর সময় শেষ। বেহালাবাদকের বিদায়ের পর এক সুন্দরী এলেন গান করতে। আধুনিক ইংরেজি গান গেয়ে চললেন। রাত সাড়ে ১১টায় আমরা ফিরলাম হোটেলে। হোটেলে ফিরে সামান্য সময় বিশ্রাম নিয়েই আমাদের রুম থেকে সামান্য দূরের বিচের বেঞ্চিতে পা এলিয়ে দিয়ে নিস্তব্ধ এক প্রাকৃতিক পরিবেশে তারায় ভরা আকাশ দেখছি আর শুনছি শাহনাজ রহমত উল্লাহর মন ব্যাকুল করা গান—

‘সাগরের সৈকতে কে যেন দূর হতে
আমারে ডেকে ডেকে যায় আয় আয় আয়
পারি না তবু যেতে শিকল বাঁধা এই দুটি পায়
সাগরের সৈকতে কে যেন দূর হতে’

শুনছি এ গান আর জানি না কী কারণে চোখের কোনায় জল গড়িয়ে পড়ছে। মন কি এমনই ব্যাকুল আর অবুঝ, অশ্রু কি এমনই হঠাৎ বরিষন যে পরিবেশ পেলেই মানুষকে নিয়ন্ত্রণহীন করে ফেলে, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বেদনায় বা আনন্দে। ঘণ্টা দুয়েক এভাবে সময় কাটিয়ে রুমে ফিরে গেলাম আর নিজেকে সমর্পণ করলাম ঘুমদেবতার হাতে।

সকালে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার দ্বীপের কিছু অংশ ঘুরে ফিরে দেখলাম। আমি সুইমিং পুলে খানিকটা সময় সাঁতার কাটলাম আর কামাল আমার আর সুন্দরীদের ছবি তুলে সময় কাটাল। এরপর আমরা রুমে গিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রওনা দিলাম হুলহুলমালের হোটেলে ফেরার জন্য স্পিডবোটে ঘাটের দিকে। যথারীতি হুডখোলা গাড়ি এলে লাগেজসহ গাড়িতে উঠলাম। স্পিডবোট ছেড়ে দিল। ২০ থেকে ২৫ মিনিটেই স্পিডবোট বিমানবন্দর জেটি ঘাটে নামিয়ে দিল। সেখান থেকে আমরা একটি ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

হোটেলে লাগেজ রেখে আশপাশের মার্কেট থেকে টুকটাক কেনাকাটা করে আমরা খানিকটা সময় কাটালাম। বিকেলবেলাটা বের হলাম পায়ে হেঁটে রাজধানী মালে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। হুলহুলমালে থেকে মালে যাওয়ার ব্যবস্থা দুটি। একটি ফেরিতে করে যাওয়া অন্যটি হলো ট্যাক্সি করে যাওয়া। ট্যাক্সিতে সাধারণত ভাড়া নেয় ৬০ থেকে ৭৫ মালদ্বীপের রুপি সমপরিমাণ বাংলাদেশি ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। যেতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ মিনিট। আর ফেরিতে যাওয়া যায় মাত্র ১০ রুপিতে সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। আমরা দ্বিতীয় পথই বেছে নিলাম। ভিন্ন রুটে নৌভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন এবং অর্থ সাশ্রয় উভয় দিক বিবেচনায় আমরা এ পথ বেছে নিই। আমাদের হোটেল এক্সপ্রেস ইন থেকে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হেঁটে ফেরিঘাটে গেলাম। পথে লোকজনের সংখ্যা অত্যন্ত কম। পথে যতজনের দেখা পাই, বেশির ভাগই বাঙালি। সাগরপাড়ের এদিকটায় বেশ বিশাল বিশাল ভবন তৈরি হচ্ছে। হাঁটাপথে একটা পার্ক দেখতে পেলাম। বিশাল পার্ক কিন্তু এখানে–ওখানে দু– চারজন মানুষ বসে আছে, গুটিকয়েক ছেলেপেলে খেলাধুলা করছে। কোথাও সামান্যতম ময়লা–আবর্জনার লেশ মাত্র নেই। একটা জায়গায় রাস্তায় গাড়ি প্রবেশ ঠেকানোর জন্য ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে ফুলের টপ দিয়ে। আমাদের দেশের মতো কাঁটাতারের বেড়া কোথাও দেখতে পেলাম না। আমরা ২০ মালদ্বীপ রুপাইয়া দিয়ে দুজনের টিকিট কেটে এসি ফেরিতে উঠলাম। ফেরি চলতে শুরু করল। হাজারো বিভিন্ন আকৃতির জলযান সাগরে ভাসমান দেখলাম। ছোট, বড়, মাঝারি, একতলা, দুইতলা থেকে শুরু করে আট-দশতলায় লাক্সারি জাহাজ সাগরে অবস্থান করছে। আমাদের সড়কপথের বাস, ট্রাক, লরি, ছোট গাড়ির মতোই এদের জলযান। এরা জলপথকেই সড়ক পথের মতো কাছে, দূরে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করছে। কারণ প্রায় ১ হাজার ২০০ দ্বীপে যাওয়ার জন্য নৌপথ আর সি-প্লেন ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।

গ্র্যান্ড ফ্রাইডে মসজিদ
আমরা পৌঁছে গেলাম রাজধানী মালেতে। ফেরি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। ফেরিঘাটের সন্নিকটে একটা ছোট শিশুপার্ক। শিশুপার্কটি পার হয়ে এগিয়ে চলতেই বিশাল আকৃতির মসজিদ। সংস্কারকাজ চলমান থাকায় আমরা মসজিদে প্রবেশ করতে পারলাম না। এ মসজিদটি মেল হুকুরি মিসকি নামে পরিচিত। ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সংস্থা মসজিদটিকে ২০০৮ সালে Sea culture Architecure স্বীকৃতি দিয়েছে। মূলত, ১১৫৩ সালে মালদ্বীপের প্রথম মুসলিম সুলতান মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর যে মসজিদ তৈরি করেন, তার ওপর ভিত্তি করে ১৬৫৮ সালে সুলতান ইব্রাহিম ইসকান্দার এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদের মিনার বহু দূর থেকে দেখা যায়। এ মসজিদে একসঙ্গে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারে। এটা গ্র্যান্ড ফ্রাইডে মসজিদ নামেও পরিচিত।

মসজিদের পাশেই চীন-মালদ্বীপ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ। এটা সাগরের মধ্যে তৈরি একটি ব্রিজ বা হুলহুলমালে দ্বীপও রাজধানী মালেকে সংযুক্ত করেছে। ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট এটি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সন্ধ্যার সময় বিজলি বাতির আলোয় এ ব্রিজের সৌন্দর্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে। অনেক পর্যটক এ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সাগরের পাড়ে সমবেত হয়। এ ব্রিজ ধরে মালে থেকে হুলহুলমালে যাতায়াতের সময় দুপাশে সাগরের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

মালে ঘোরার সময় চীন-মালে ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজের পাশের উন্মুক্ত জায়গায় একটি প্রতিবাদ সভায় নারী, পুরুষ, যুবক-যুবতীর হাতে ব্যানার–ফেস্টুন নিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখলাম। ব্যানার–ফেস্টুন পড়ে জানলাম দুই বছরের শিশুকে তার বাবা, দাদা, বড় দাদা মিলে রেপ করেছে। শরীর মন এ দেখে একেবারে গুলিয়ে উঠল। নীচতায় আর নিষ্ঠুরতায় মানুষ আসলে কোনো কোনো সময় যে ইতর প্রাণীকেও যে ছাড়িয়ে যায়, তারই নজির এসব ঘটনা। দেশে দেশে নারী ও শিশুর প্রতি এ জিঘাংসা এ নিষ্ঠুরতা কবে বন্ধ হবে? আদৌ কি বন্ধ হবে? একমাত্র অনাগত কালই তার জবাব দিতে পারে। হাঁটছি কিন্তু অজানা–অচেনা এক শিশুর মুখ, চেহারা বারবার ভেসে উঠছে মনের পর্দায়। মনে মনে এ নরপিশাচদের বিচার দাবি করলাম পরম করুণাময়ের কাছে।

রাস্তায় গোল্লাছুট খেলা দেখলাম
জেটিঘাট থেকে মালে শহরে চারদিকে চক্রাকারে পথ আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা ঘুরে মালে শহর পরিভ্রমণ শেষ করলাম। আবার জেটিঘাটে এসে ফেরিতে উঠলাম। হুলহুলমালেতে হোটেল ফেরার জন্য হাঁটা পথে প্রায় সব জায়গায় অনেক বাঙালির দেখা পেলাম। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম মালদ্বীপে তারা মোটামুটি ভালো আছেন। ফেরিতেও প্রায় সবাই বাংলাদেশি। এরা খরচ বাঁচানোর জন্য রাজধানী মালেতে কাজ করে আর বসবাস করেন হুলহুলমালেতে। ফেরি থেকে নেমে হোটেলের পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম এক জায়গায় ১০ থেকে ১৫ জন তরুণী আমাদের দেশের গোল্লাছুটের মতো একধরনের খেলায় মেতে উঠেছে। রাত ১০টা নাগাদ এ দৃশ্য বলে দিল নিরাপত্তার কোনো কমতি নেই রাস্তায়। হোটেলে ফেরার পথেই এক বাঙালি হোটেল থেকে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। হোটেলে ফিরে সবকিছু গোছগাছ করে নিলাম, হোটেলের বিল মিটিয়ে সি বিচে গেলাম সাগরের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য। পৃথিবীর বেশ কতগুলো সাগর মহাসাগর দেখার তৌফিক আল্লাহ তাআলা দিলেও মালদ্বীপের সাগরের পানি যেন একই অঙ্গে দুই রূপ। একই সাগরের পানি পাশাপাশি দুই ধরনের বর্ণ ধারণ করে অবস্থান করছে। এক জায়গায় নীল আরেক জায়গায় গাঢ় নীল। বহুদূর থেকেও পানির এ ভিন্ন ভিন্ন রং চোখে পড়ে।

পরের দিন সকালে ফ্লাইট ধরার জন্য সকাল ছয়টায় বিমানবন্দরে রওনা দিতে হবে। ঘণ্টাখানেক সাগরপাড়ে অবস্থান করেই হোটেল কক্ষে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে ফ্রেস হয়ে সময় মতো ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলাম বিমানবন্দরের দিকে। চেকইন, ইমিগ্রেশন শেষ করে বিমানবন্দরে বুক স্টল আছে কি না, খোঁজ করলাম কিন্তু কোনো বুক স্টল পেলাম না। অবাক হলাম। যে বিমানবন্দর দিয়ে বছরে ১৫ লাখ পর্যটক যাতায়াত করেন অথচ কোনো বুকস্টল নেই, অবাক করল আমাকে। সাধারণত বিদেশে গেলে দু–চারখানা বই কেনা আমার অভ্যাস। কিন্তু এ যাত্রা আর তা হলো না বলে একটু মন খারাপ হলো। আমাদের ফ্লাইট প্রায় ২ ঘণ্টা বিলম্ব ছিল। বোর্ডিং শেষে শুরু হলো নিজ দেশে ফেরার ক্ষণগণনা। একপর্যায়ে বিমানের ভোঁ–দৌড়ের মাধ্যমে মাটির সঙ্গে আমাদের বন্ধন ছিন্ন হলো। শেষ হলো দ্বীপের দেশে, নীল সাগরের দেশ মালদ্বীপ ভ্রমণ। হৃদয়ের তন্ত্রীতে আনন্দের আর নীল সাগরের ছবি নিয়ে ফিরে চলা শুরু হলো প্রিয় বাংলাদেশে। এ যেন কবির ভাষায়,

‘আর কোথা নয় মা, আর নয় কোনখানে,
বারে বারে আমি আসি ফিরে যেন
এই বাংলার নীড়ে।
মাগো, বারে বারে আমি আসি ফিরে যেন
এই বাংলার নীড়ে।
ডাহুক যেখানে ডাক দিয়ে যায়
বাতাস বাজায় বাঁশি...

হ্যাঁ, দেশের মাটিতে ফিরে আসাটাই তো চরম সত্য। বিদেশের রং আর চাকচিক্য তো ক্ষণিকের আর নিজের দেশ তো চিরকালের আপন ঠিকানা। এর মাটি, আলো, বাতাসেই আমাদের বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা এবং মৃত্যুও এর কোলে। সেই চিরকালের নাড়ির বন্ধনে জড়ানো নিজ দেশে ফিরে আসাতেই শান্তি আর স্বস্তি। শুধু পিছে পড়ে থাকে সুন্দর স্মৃতি, আনন্দময় মুহূর্তের ছবি।

*লেখক: সরকারি কর্মকর্তা