করোনার পরবর্তী পৃথিবী কেমন হবে

জিয়ানলুকা দে সান্তিসের টুইট। ছবি: টুইটার
জিয়ানলুকা দে সান্তিসের টুইট। ছবি: টুইটার

গত তিন দিন পাখির ডাকে ঘুম ভাঙছে। জি, আপনি সত্যি শুনছেন। এই ঢাকা শহরের বাসিন্দা হয়েও তিন দিন ধরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙে। এর মধ্যেই আবার ফেসবুকে ভিডিও দেখলাম যে পর্যটকবিহীন কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ডলফিনের আনাগোনা!

কোনো কোনো গ্রুপে, কারও কারও টাইমলাইনে আবার কপি-কালেক্ট করা পোস্টও দেখতে পেলাম যে মাসখানেকের লকডাউনে নাকি পৃথিবীর পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কেউ কেউ তো আবার অতি আবেগপ্রবণ হয়ে বলছেন, করোনার প্রভাবমুক্ত হওয়ার পর ভঙ্গুর অর্থনীতির পৃথিবীর পরিবেশ হবে শতবর্ষ আগের পৃথিবীর মতো নির্মল!

এসব ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিবেশের পরিবর্তন নিয়ে অনেক আবেগি পোস্ট চলে এসেছে। কিন্তু আসল ঘটনা কী?

সম্প্রতি ভারতের নয়াদিল্লির কাবেরী নামের একজন অধিবাসী কয়েকটি ছবি দিয়ে একটি টুইট করেন। যার একটি লাইন, ‘ভেনিসের খালে আবারও রাজহাঁস ফিরে এসেছে!’ মজার ব্যাপার হলো, তিনি ভেনিসেই যাননি! ছবিগুলো নেট থেকে নিয়েছেন। অথচ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বলছে, ওই ভাইরাল হওয়া পোস্টের রাজহাঁসগুলো ভেনিসের নিকটবর্তী বুরানো দ্বীপের খালে প্রতিনিয়তই দেখা যায়!

পরবর্তী সময়ে ওই টুইটটি ডিলিট করার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে কাবেরী বলেন, যেহেতু পোস্টটিতে এক মিলিয়নের বেশি লাইক পড়েছে, তাই সেটি ডিলিট করার ভাবনা তাঁর নেই!

নয়াদিল্লির কাবেরীর টুইট। ছবি: টুইটার
নয়াদিল্লির কাবেরীর টুইট। ছবি: টুইটার

এবারে আসি খোদ ইতালিরই এক বাসিন্দার কথায়। জিয়ানলুকা দে সান্তিস নামের এই ব্যক্তি ডলফিনের ভিডিও টুইট করে আবারও ভেনিসের সেই স্বচ্ছ খালের কথা জানান দেন, যা কিনা এক মিলিয়নের বেশি ভিউ পেয়ে যায়। কিন্তু আবারও বাদ সেধেছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক! তাদের সূত্রমতে, ভেনিশিয়ান ওই ডলফিনের ভিডিও আসলে সারডিনিয়া বন্দরের। আর সারডিনিয়া হলো ভূমধ্যসাগরীয় একটি দ্বীপ, যা ইতালির অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র, যেখানে কিনা প্রায়ই এই ডলফিনের দেখা মেলে!

তবে যা–ই হোক, নিউইয়র্কের খোলা আকাশ কিংবা চীনের বায়ুতে কার্বন ডাই–অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইডের মাত্রা কমে আসাটা কিন্তু সত্যি। যদিও পরিবেশবিদরা বলছেন, পরিবেশের এ পরিবর্তন ক্ষণস্থায়ী।

এবার আসি মানুষের কথায়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজারের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। উল্লেখ্য, বায়ুদূষণে প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ প্রায় ৮০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বায়ুদূষণের ফলে মানুষের হার্ট ও ফুসফুস সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাস তিনেকের লকডাউনে (বিশেষত চীনের) পৃথিবীতে বায়ুদূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। পৃথিবীর উৎপাদিত মোট কার্বন ডাই–অক্সাইডের প্রায় ৩০ শতাংশ চীন থেকে উৎপাদিত। আরেক বিষাক্ত গ্যাস নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড নির্গমনেও তাদের অবদান কম নয়! মার্কিন মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের (নাসা) এক চিত্রে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে চীনে ব্যাপকহারে কার্বন ডাই–অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা কমেছে।

ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’–এর মতে, চীনের এই পরিবেশগত পরিবর্তন অন্তত ৫০ হাজার মানুষকে বায়ুদূষণজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করা থেকে বাঁচাতে পারে।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্শাল ব্রুকও বলছেন একই কথা। তাঁর মতে, দূষণমুক্ত বায়ু সম্ভবত পাঁচ বছরের কম বয়সী ১ হাজার ৪০০ শিশুকে এবং ৭০ বছরের বেশি বয়সী ৫১ হাজার ৭০০ জনকে অকালমৃত্যু থেকে বাঁচাবে।

চীনের এই ছবি নাসার। ছবি: সংগৃহীত
চীনের এই ছবি নাসার। ছবি: সংগৃহীত

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে বছরখানেক বা তারও বেশি সময় লাগবে। এর মধ্যে দফায় দফায় আঘাত হানার আশঙ্কাও রয়েছে। এতে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটবে, তবে কিছু নিয়ম রপ্ত করতে পারলে তা ভবিষ্যতে অন্য কোনো মহামারি হওয়ার আশঙ্কা যেমন কমাবে, তেমনি পরিবেশদূষণের মাত্রাও কমাবে। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, পর্যটন এলাকাগুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ ধরে রাখতে সহায়তা করা এবং শিল্পোন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশের কথা মাথায় রেখে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।