এমন বাংলাদেশ কখনো দেখিনি

শনিবার সকাল থেকে রাজধানী অভিমুখে ছিল শ্রমজীবী মানুষের ঢল। তাঁদের অধিকাংশ ছিল পোশাক কারখানার শ্রমিক। রোববার কারখানা খুলবে, তাই যে যেভাবে পেরেছে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছে। ছবি: প্রথম আলো
শনিবার সকাল থেকে রাজধানী অভিমুখে ছিল শ্রমজীবী মানুষের ঢল। তাঁদের অধিকাংশ ছিল পোশাক কারখানার শ্রমিক। রোববার কারখানা খুলবে, তাই যে যেভাবে পেরেছে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছে। ছবি: প্রথম আলো

এমন বাংলাদেশ কখনো দেখিনি। দেখিনি এমন নিস্তব্ধ নীরবতা। থেমে গেছে প্রিয় শহর বন্ধ হয়ে গেছে জীবিকার অন্বেষণে শ্রমিকের মজুরের এবং খেটে খাওয়া মানুষের কর্মের চাকা। গোটা বাংলাদেশের মানচিত্র নীরবতার চাদরে মোড়ানো এক বিষাদ চিত্র যেন। এর একমাত্র কারণ, নভেল করোনা ভাইরাস, যা আজ বিশ্বজুড়ে এক আতঙ্কের নাম। 


এক ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় করোনাভাইরাস সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে বৃদ্ধকে বললেন, ‘চাচা কিছুদিন ঘরে নামাজ পড়ুন, করোনা চলে গেলে আবার মসজিদে নামাজ পড়বেন।’ উত্তরে চাচা বললেন, ‘প্রথম যার করোনা হইছে তার কার কাছ থেকে হইছে? আল্লাহ গজব পাঠাইছে, কাজেই আল্লাহ করোনা দিলে ঘরে থাকলেও হবে, বাহিরে গেলেও হবে।’

বুঝলাম, যাঁরা প্রাচীন মানুষ, স্বল্পশিক্ষিত, ধর্মভীরু, তাঁরা এমন কথা বলবেন সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু যাঁরা রাষ্ট্রের শাসক, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কর্ণধার, দেশের সার্বিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁরা কী করে পারেন দেশের এমন সংকটপূর্ণ সময়ে এমন নাদান সিদ্ধান্ত নিতে?

সরকার বলছে ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন। বিভিন্ন সংস্থা, মিডিয়া, কাগজ, অনলাইন প্রতি মুহূর্তে সতর্কতার সঙ্গে বলছে ঘরে থাকুন, নিরাপদ থাকুন। পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার পুলিশ এবং সেনাবাহিনী পর্যন্ত মাঠে নামিয়েছে। চায়ের দোকানির দোকান ভেঙে ফেলা হচ্ছে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটলে। অকারণে রাস্তায় নামলে পথচারীদের গুনতে হচ্ছে জরিমানা।

এসব কি তবে দেখতে পান না পোশাক ব্যবসায়ীরা? দেখতে পেলে ঠিক এ অসময়ে পোশাক কারখানা খোলার ঘোষণা দিয়ে স্বেচ্ছাবিপর্যয় ডেকে আনতেন না। সারা জীবন শুনে আসছি পোশাকশ্রমিকদের ঠকানো হয়, অত্যাচার করা হয়। এই অমানবিক চিত্র দেখে মনে হলো, পোশাক কারখানার এসব মালিক নিজেদের কর্মীদের নিয়ে আসলে তেমন ভাবেন না। অথচ এসব শ্রমিকের পরিশ্রমের টাকায়, ঘামের টাকায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন।

এমন ধূসর পৃথিবী কে দেখেছে কবে! এমন বিবর্ণ বাংলাদেশ কখনো দেখিনি আগে। সারা পৃথিবী সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধনে এক সুতোয় বাঁধা পড়েছে শুধু প্রাণঘাতী করোনার কারণে। অথচ সৌহার্দ্য ভুলে গেছি কেবল আমরা, মানবতার কথা বলি সভা সেমিনারে আর ক্ষমতার দাপটে অন্যায়ভাবে জুলুম করি গরিব অসহায় মানুষের প্রতি।

পৃথিবীজুড়ে মহামারি আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে কোভিড-১৯। ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ছে অর্থনীতির চাকা। মন্দাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে দৈনন্দিন জীবন। সবচেয়ে বেশি দুরবস্থার মধ্যে আছে শহরের ছিন্নমূল আর গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলো। কারণ দিন এনে দিন খাওয়া এসব মানুষের নেই কোনো জমানো অর্থ, নেই কোনো ব্যাংক ব্যালান্স।

টিভির পর্দা এবং খবরের কাগজে আমরা রোজ দেখছি হতদরিদ্র পরিবারকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও দলীয়ভাবে যাঁদের নাম আছে তাঁরাই কেবল ত্রাণ পাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।

বারবার প্রশাসন বলছে দূরত্ব বজায় রাখুন, সামাজিকতা থেকে দূরে থাকুন কিন্তু প্রশাসনের লোকজনই আবার এমনভাবে ত্রাণ বিতরণ করছেন যেখানে শৃঙ্খলার লেশমাত্র নেই। জনসমাগম থেকে করোনা ছড়াতে পারে, এটা জেনেও তাঁরা ছুটি উপেক্ষা করে যে বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে গরিব-অসহায়দের দান করছেন, তা আসলেই না করাই উচিত।

শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি ফিল্মি স্টাইলে গাড়ি থেকে টাকা ছিটিয়ে ত্রাণ দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা। এটা সত্যি অমানবিক এবং অপমানজনক। আমরা দানের নামে ত্রাণের নামে করছি ফটোশুট। অথচ সবাই আমরা শিক্ষিত বিবেকবান মানুষ। এ কেমন মানবতা !

আমার কথা, সারা দেশে যেখানে সাধারণ ছুটি, সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হকের অনুমতিবিহীন পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত মালিকপক্ষ কীভাবে নিতে পারে? আর কত টাকা তাঁদের চাই? সাধারণ মানুষের মতো পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা কি তবে মানুষ নন? নাকি ব্যবসায়ীরা নেতা হয়ে গেলে কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না তারা? কোনটা?

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলি,
‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’

কিন্তু হায় পূর্ণিমার আলো যেন আজ সত্যি অধরা আর ক্ষুধা হার মানাচ্ছে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসকেও। সম্প্রতি রাজশাহী চিড়িয়াখানায় খাঁচা ভেঙে জীবন্ত হরিণকে খেয়ে ফেলেছে কয়েকটি ক্ষুধার্ত কুকুর। উচ্ছিষ্ট খাবারটুকু দেওয়ার মানুষও আজ রাস্তায় নেই কেবল জীবনকে সুরক্ষিত রাখতে।

শুধু সুরক্ষিত জীবন পাওয়ার অধিকার নেই এসব পোশাক কারখানার নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর, তাই নয় কি?

কাজে যোগ দিতে ঢাকামুখী মানুষ।
কাজে যোগ দিতে ঢাকামুখী মানুষ।

মানুষও ক্ষুধার কাছে হেরে যায়। হয়ে ওঠে হিংস্র। সারা বিশ্ব আজ মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বেকার হয়ে যাবেন লাখো মানুষ। কর্মের সন্ধানে ছুটবেন দ্বিগ্বিদিক। করোনাভাইরাস-পরবর্তী এমনই এক পৃথিবীর মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। তাই যাঁরা এখনো একটুখানি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেকোনো কিছুর বিনিময়েই তাঁরা সেই কাজটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইবেন পেটের তাগিদে, জীবনের তাগিদে। হয়তো সেই অশনিসংকেত টের পেয়েই হাজারো মানুষ নিজের চাকরি বাঁচাতে বেতনটুকু নিতে পায়ে হেঁটে ছুটেছেন ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর থেকে রাজধানী ঢাকার পথে। অনেকের কোলে ছিল শিশুসন্তান। সত্যি, আমাদের দেশের ওপরতলার মানুষগুলো সার্কাস দেখাতে বড় পছন্দ করেন।

যেহেতু সারা দেশে একযোগে চলছে লকডাউন এবং গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে, সেহেতু পায়ে হেঁটে আসতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। এঁদের মধ্যে যাঁরা চরম সৌভাগ্যবান তাঁদের কেউ কেউ ট্রাক, লরি, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ নানা ধরনের যানবাহনে ভেঙে ভেঙে এসেছেন। অনেকেই আবার পুলিশের বাধার মুখে মাঝরাস্তায় নেমে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

যেসব মানুষকে চাকরি বাঁচাতে বেতন নিতে এত দূর আসতে হলো, খামখেয়ালিপনা সিদ্ধান্তের কারণে তাঁদের অনেককেই বেতন-ভাতাবিহীন আবার ফিরেও যেতে হয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিল (গত রোববার), কেউ ঢাকার বাইরে যেতে এবং আসতে পারবে না।
কী অদ্ভুত! তাহলে এই মানুষগুলো কি রাস্তার মাঝখানে আটকা পড়ে থাকবেন? কোথায় বাস করছি জানি না।

সারা পৃথিবীর মানুষ একসঙ্গে লড়াই করছে। মনে হচ্ছে মানবিকতার এটাই যেন শ্রেষ্ঠ সময়। আত্মশুদ্ধির বুঝি এক মহান সুযোগ। কিন্তু হায় হেঁটে হেঁটে আসা-যাওয়া করা ওই অসহায় পোশাকশ্রমিকদের দিকে তাকালেই মনে পড়ে যাচ্ছে আবুল হাসানের কবিতার পঙক্তিগুলো...

‘মৃত্যু আমাকে নেবে,
জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।
তাই আমি আমার মৃত্যুর আগে বলে যেতে চাই
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন,
গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন।
কি লাভ যুদ্ধ করে?
আধিপত্যে এত লোভ?’

তাই বলি কি, আপনারা যাঁরা ক্ষমতার উচ্চ শিখরে আছেন, দয়া করে তারা ভুলে যাবেন না, ঈশ্বর এখন লোকালয়ে। দেশের একমাত্র ভালো কেবল আপনারাই চান, এটা ভুল। জনগণই কেবল এ দেশের মহাজন কাজেই তাদের মতামতের গুরুত্ব দেওয়া রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আসুন মানবতার বন্ধন আরও দৃঢ় করবার অঙ্গীকারবদ্ধ হই।