করোনা রোধে নিজের ভালো নিজেকেই বুঝতে হবে

এটিএম বুথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন মানুষ। ছবিটি ৩১ মার্চ তোলা।
এটিএম বুথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন মানুষ। ছবিটি ৩১ মার্চ তোলা।

কোথাও লাইনে দাঁড়াতে হলে আমরা বাঙালিরা বা বাংলাদেশের মানুষেরা আশ্চর্যজনকভাবে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ায়। পেছনে পর্যাপ্ত খালি জায়গা থাকার পরও একজনের গা ঘেঁষে আরেকজন দাঁড়ায়। এক মাসের বেশি সময় মাইকিং করে বলা হচ্ছে, ফেসবুকে সবাই লিখছেন-বলছেন, টিভিতে সারা দিন বলছেন, পত্রিকায় প্রতিদিন লিখছেন, করোনা রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। ফার্মেসি, এটিএম বুথ, মুদিদোকান, কাঁচাবাজারে কেনাকাটার জন্য দাঁড়াতে হলে একজন আরেকজন থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ানোর জন্য এত করে বলার পরও আমরা দাঁড়াচ্ছি একজন আরেকজনের গা ঘেঁষে।

মূলত ২৬ মার্চের আগে থেকে স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টিনে আছি। কোথাও বের হই না। ৩১ মার্চে ছেলেকে নিয়ে চাতরী চৌমুহনীতে শেভরনে গিয়েছিলাম ডাক্তার দেখানোর জন্য। পরে দুপুরের পর কিছু বাজারের জন্য চাতরী চৌমুহনী গেলাম। চাতরী চৌমুহনী প্রবেশ করেই দেখলাম ইউসিবি, ইসলামী ব্যাংক ও আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের এটিএম বুথের বাইরে লম্বা লাইন। বাকি পুরো চৌমুহনী খালিই বলা যায়। অনেকটা জনশূন্য। এটিএম বুথের বাইরে চাইলে গ্রাহকেরা এক মিটারের জায়গায় দুই মিটার দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে পারেন। কারণ, পুরো চৌমুহনী তো খালি আছেই। তারপরও তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন একজন আরেকজনের একেবারে গা ঘেঁষে। শীতকালও নয় এখন, গরমের দিন, একটু ফাঁক রেখে রেখে দাঁড়ালে গায়েও বাতাস লাগে। এই সামান্য ব্যাপারটি বাঙালি বোঝে না রে। এই দুঃখ কোথায় রাখি।

আমি কিছু বাজারসদাই করে ও ছবি তুলে আমাদের চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনওকে (যিনি তাঁর টিম নিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন আনোয়ারাকে করোনামুক্ত রাখার জন্য, তাঁকে ও তাঁর টিমকে ধন্যবাদ) মেসেঞ্জারে পাঠালাম, সঙ্গে সঙ্গেই উনি ফিরতি মেসেজ দিলেন পুলিশ যাবে। দুই মিনিটের মধ্যে পুলিশ সদস্যরা এসে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো গ্রাহকদের ফাঁক ফাঁক করে দিলেন। দিয়ে লাভ কী হলো। যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। যদি এখানে কারও সমস্যা থেকে থাকে (আল্লাহ মাফ করুক, কারও সমস্যা না হোক) সেটা সবার মাঝে ছড়াল।

পুলিশ ফাঁক ফাঁক করে দিয়ে সামনে যেতে না-যেতে আবারও তাঁরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করা শুরু করেছেন। গরু চরানো যায়, মানুষ কী আর চরানো যায়? তাঁদের সঙ্গে কি সারা দিন পুলিশ লেগে থাকবে। মানুষ নিজের ভালোটা নিজে না বুঝলে অন্য কেউ হাজার বোঝালেও কাজ হয় না। যদি বোঝানো যেত তাহলে আমরা এত দিনে বুঝতাম। কত করে, কতভাবে বোঝানো হচ্ছে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ানোর জন্য। অথচ আমাদের জনগণ করছেটা কী! সম্পূর্ণ বিপরীতটা।

মালয়েশিয়ায় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে দুইটা-আড়াইটা পর্যন্ত দুপুরের খাবারের সময়। সে সময়ে খাবারের দোকানগুলোতে থাকে লম্বা লাইন। টাকা দিয়ে কিনে খাবার নেওয়ার জন্য নারী-পুরুষ একসঙ্গে লম্বা লাইনে দাঁড়ান। ব্যাংক, বিমাসহ নানা রকম অফিসে কাজ করেন এমন নারী-পুরুষের সঙ্গে রাস্তায় কাজ করা মানুষেরাও। কোনো ভেদাভেদ নেই। তবে একজন আরেকজনের গা ঘেঁষে দাঁড়ান না। কখনো না। একেবারে কাছের বন্ধু পেছনে দাঁড়ালেও দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ান তাঁরা। এ বিষয়ে আগে লিখেছি, ছবিও দিয়েছি ফেসবুকে। মালয়েশিয়ায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা বিষয়টি নিয়মিত দেখেন, জানেন।

বহু বছর ধরে ভাবি, আমরা কখন এভাবে গড়ে উঠব। পরিচিত–অপরিচিত কারও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াব না। শুধু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকালে নয়, সারা বছরই যেকোনো জায়গায় ফাঁক করে করে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে আলো-বাতাস লাগানোর চর্চা শুরু হোক আমাদের। আর এ করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য এই সময়ে অবশ্যই নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়াই আমরা। মানুষকে করোনার হাত থেকে বাঁচাই।