করোনা দুর্যোগে জনগণের কাছে পুলিশের প্রত্যাশা

সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে রাজধানীতে পুলিশের তৎপরতা। অপ্রয়োজনে যারা বাইরে বের হয়েছেন তাদের করা হয়েছে জরিমানাও। বংশাল, ঢাকা, ২৫ এপ্রিল। ছবি: দীপু মালাকার
সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে রাজধানীতে পুলিশের তৎপরতা। অপ্রয়োজনে যারা বাইরে বের হয়েছেন তাদের করা হয়েছে জরিমানাও। বংশাল, ঢাকা, ২৫ এপ্রিল। ছবি: দীপু মালাকার

সাধারণত জনগণের অনেক প্রত্যাশা থাকে পুলিশের সেবা পাওয়ার জন্য, যেমন জান-মালের নিরাপত্তা, অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা প্রদান, মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখা কিংবা নিরাপদ সড়কসহ সব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় পাশে থাকার। পুলিশ সেই লক্ষ্যে কাজ করে আসছে দক্ষতার সঙ্গেই।

করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। এর মধ্যেই জনগণের জীবনের নিরাপত্তার জন্য সরকার অনেক পরিকল্পনা করে অগ্রসর হতে থাকে। করোনা মোকাবিলায় চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যাংকারসহ জরুরি সেবার সবাই ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়। সদ্য সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী সাম্প্রতিক সময়ে জানান, পুলিশের ট্রেনিং নেই, তবু করোনাযুদ্ধে মাঠে আছে।’ স্বাভাবিকভাবে পুলিশের এই সময়ের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব গণজমায়েতে বাধা প্রদান ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। যেহেতু সংক্রামক ব্যাধি, তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় ঘরে থাকার জন্য।

কিন্তু দেশ দেখল সবাই প্রমোদ ছুটিতে গিয়েছে বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ! সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী জরুরি সেবার বাইরে যাঁরা, তাঁদের বাসায় থাকার কথা থাকলেও, তা না মেনে সবাই ঈদের ছুটির মতো গ্রামের বাড়ি ছুটে গেলেন বিশাল আয়োজনে। আবার প্রবাসী ভাই-বোনেরা প্রায় সময়ই কোয়ারেন্টিন বা ঘরবন্দী থাকাকে খুব বেশি পালন করেননি দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরায়। বরং তাঁরা অনেকেই অবাধে ঘোরাফেরা করেছেন নিজ গ্রাম, পাড়া-মহল্লায়, আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি। এমনকি বোঝাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে ভালো ব্যবহারও অনেকেই করেননি। যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে এই রোগ ছড়ায়, তাই ছড়িয়েছে কিছু মানুষের মধ্যে। নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব রক্ষার দায়িত্ব পালন করা মোটেও সহজ হয়নি বা হচ্ছে না পুলিশের জন্য। ফলে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সামাল দিতে বেগও পেতে হয়েছে বটে, কারণ অনেকেই অনেক হাস্যকর কারণ দেখিয়ে বা পুলিশের আড়ালে নিয়ম ভেঙেছেন এবং ঝুঁকি বাড়িয়েছেন। যা-ই হোক, পুলিশ বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য। যেমন গণজমায়েত করতে না দেওয়া, অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাঘুরি বন্ধ করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বাদে অন্য দোকান বন্ধ রাখা নিশ্চিত করা, সড়কে অপ্রয়োজনীয় যানবাহন বন্ধ রাখা এবং জরুরি সেবার যানবাহনের জন্য নিরাপদ রাস্তাঘাট সচল রাখা। তা ছাড়াও পুলিশে বিভিন্ন ইউনিট ২৪ ঘণ্টাই কাজ করে যাচ্ছে আগের মতোই, যাতে মানুষ নিরাপদ ও ভালো থাকে। আর পুলিশ এই কাজ দায়িত্বের সঙ্গে করে যাচ্ছে ব্যাপক ঝুঁকি নিয়ে।

এখন পর্যন্ত একক পেশাজীবী হিসেবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত পুলিশের সদস্যরা, যা দুই শতাধিক। প্রশ্ন আসতে পারে, এত পুলিশ কেন আক্রান্ত? কারণ হিসেবে দেখা যায়, পুলিশের সদস্যরা রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে মানুষ ও যানবাহন তল্লাশি করছেন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে সবার বাড়ি যাচ্ছেন, করোনাভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করছেন, হাটবাজারে টহল দিচ্ছেন। এ ছাড়া মানুষ কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গনিরোধ মানছে কি না, তার তদারকি করা, ত্রাণ দেওয়া, ত্রাণ প্রদানে স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা করা, নিরাপত্তার জন্য হাসপাতালের সামনে ডিউটি করা, মৃত ব্যক্তির দাফনের ব্যবস্থা করা এবং করোনা নিয়ে গুজব প্রতিহত করাসহ নানা কাজ করছে নিয়মিত। সুতরাং করোনায় আক্রান্ত হওয়ার নিশ্চিত আশঙ্কা থাকার পরও পুলিশ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে দেশের জন্য। পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ জানান, পবিত্র রমজানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কঠোরভাবে দায়িত্ব পালনে মাঠে থাকবে পুলিশ।’

পুলিশ বাইরে থেকে সেবা প্রদান করছে মানুষকে ঘরে রাখার জন্য। কিন্তু মানুষ আসলে কি কাজ করছেন এই সময়ে? প্রায়ই কোয়ারেন্টিনে বা ঘরবন্দিত্বকে অনেকে মানছেন না, হাটবাজারে মানুষের মিলনমেলা হচ্ছে, প্রতিনিয়ত অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাফেরা করছেন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত না করে ত্রাণ দিচ্ছেন বা নিচ্ছেন, বিরাট সমাবেশ করছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না, কিছু মানুষ নিয়মিত ঢাকা আসছেন বা যাচ্ছেন, পুলিশকে নানা মিথ্যা নথিপত্র ও মিথ্যা পরিচয় দিয়ে রাস্তায় চলার চেষ্টা করছেন। অনেকে সাধারণ যাত্রী হয়েও অ্যাম্বুলেন্সকে যোগাযোগমাধ্যম বানাচ্ছেন পুলিশকে ফাঁকি দিতে। অনেকে করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে রাজধানীতে পুলিশের তৎপরতা। চকবাজার, ঢাকা, ২৫ এপ্রিল। ছবি: দীপু মালাকার
সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে রাজধানীতে পুলিশের তৎপরতা। চকবাজার, ঢাকা, ২৫ এপ্রিল। ছবি: দীপু মালাকার

মর্মান্তিক হলেও সত্য, দেশের এই করুণ পরিস্থিতিতেও অনেকে মহাসমারোহে বিবাহের আয়োজন করেছেন! কিছুদিন আগেই মৎস্যবাহী পিক আপের ড্রামের ভেতর থেকে অনেক যাত্রী আবিষ্কার করেন পুলিশের কিছু চৌকস সদস্য, যা জাতিকে বিস্মিত করে! এখন বিষয়টি হলো, করোনাভাইরাস যেহেতু মানুষের মাধ্যমে মানুষের মধ্যেই ছড়ায়, তাই মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা হতে হবে কিছুদিনের জন্য, নিজেদের বাঁচানোর জন্যই।

আচ্ছা, মানুষের জীবনের চেয়ে কি বাইরে ঘুরতে আসা জরুরি?

অবশ্যই তা জরুরি নয়। তবে কেন বারবার সরকার বলার পরও কিছু মানুষ কথা শুনছেন না? নিজের জীবনের জন্য হলেও ঘরে থাকা জরুরি। জেল-জরিমানা করেও মানুষকে থামানো যাচ্ছে না। দেশের এই মহামারি পরিস্থিতিতেও পরিবারের কাছে না যেতে পারা মানসিকভাবে কতটা কঠিন, তা আমদের প্রতিটি কর্মচারী-কর্মকর্তা জানেন। তবে পরিবারকে সময় না দিয়ে পুলিশের সদস্যরা বাংলাদেশ নামের বৃহত্তর পরিবারকে সময় দিচ্ছেন আগের মতোই। তাই জনগণের কাছে প্রত্যাশা, আপনারা ঘরে থাকুন, পরিবারকে সময় দেওয়ার এই সুযোগকে কাজে লাগান, পরিকল্পনা করুন আগামী দিনগুলোতে কী কী কাজ করবেন, প্রার্থনা করুন, বই পড়ুন, টিভি দেখুন ইত্যাদি।

আপনি যদি আজ করোনাকে সিরিয়াসভাবে নেন, তবে এই দুর্যোগ কাটিয়ে হয়তোবা ঈদুল ফিতর সবাই মিলে স্বাভাবিক সময়ের মতোই উদযাপন করতে পারব। মৃতের তালিকায় আমাদের পরিবারের কেউ যুক্ত হলে সেই ঈদ বিষাদে পরিণত হবে। তাই করোনা ভাইরাসকে পরাজিত করার সমাধান আপনার কাছে, আপনার ঘরে থাকাই সেই সমাধান। জনগণকে দায়িত্ববান হতে হবে, পুলিশের কাজে সহায়তা করতে হবে নাগরিক দায়িত্ববোধ থেকে।

সর্বোপরি সরকার নির্দেশিত আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিভাগের পরামর্শ মানতে হবে এই অদেখা শত্রু দমনে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো এই যুদ্ধেও জীবনকে বাজি রেখে আবারও মাঠে নেমেছে পুলিশ, জনগণ হিসেবে পুলিশকে সহযোগিতা করতে আপনি প্রস্তুত তো?

*লেখক: উপপরিদর্শক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। [email protected]