মেঘের দেখা মিললে, মানুষের দেখা মেলে না

মাটির রাস্তায় ৭২ বছর বয়সের আব্দুল গণি সানা। ছবি: লেখক
মাটির রাস্তায় ৭২ বছর বয়সের আব্দুল গণি সানা। ছবি: লেখক

৭২ বছর বয়সের আব্দুল গণি সানা। ভরদুপুরে রাস্তা দিয়ে ঘোরাফেরা করছিলেন। হঠাৎ পশ্চিম আকাশে প্রচণ্ড মেঘ জমে। কালো মেঘে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফেরার উদ্বেগ তাঁর। কালো আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে আর রাস্তায় থাকার কোনো উৎকীর্ণ থাকে না।

এটি খুলনার দাকোপ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল সুতারখালী গ্রামের একটি দৃশ্য। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা অবহেলিত ওই গ্রামে বসবাস আব্দুল গণির। পেশায় ট্রলারচালক।

আজ সোমবার ভরদুপুরে দেখা হলে কথা হয় আব্দুল গণির সঙ্গে। চোখেমুখে তাঁর অনিশ্চিতার ছাপ। একদিকে করোনাভাইরাসের প্রভাব আর অন্যদিকে সংকটময় জীবন। তিনি বললেন, পুরো এলাকা জুড়ে কাঁচা রাস্তা হওয়ায় আকাশে মেঘ জড়ো হলে, রাস্তায় আর কেউ দাঁড়াতে চায় না। সংকীর্ণ হয়ে পড়ে মানুষ। করোনার প্রভাবে শহর ছেড়ে গ্রামে এসেছে অনেকেই। কিন্তু বর্ষা হলে রাস্তায় আর কারোর দেখা মেলে না।

সুতারখালী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল গণি সানার সঙ্গে দেখা হয় উপজেলার তেলিখালী বাজার থেকে কেওড়াতলা বাজার যাওয়ার পথে মাটির রাস্তায়। খুলনা শহর থেকে প্রায় ৪৪ কিলোমিটার দক্ষিণে ওই জায়গা। তিনি বলেন, আইলা কবলিত এই এলাকায় এক ফুট জায়গাতেও পিচঢালা রাস্তা নেই। খুবই কম সংখ্যক ইটের রাস্তা। সব রাস্তাই কাঁচা, এবড়োথেবড়ো গ্রামীণ মেঠোপথ। এই কাঁচা রাস্তা দিয়েই পায়ে হেঁটে মানুষকে চলাচল করতে হয়। বর্ষাকালে পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়। এই সময় মানুষ আর চলতে পারে না। ছেলেমেয়ে স্কুলে যেতে পারে না। ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হয় সাধারণ মানুষের।

ওই গ্রামের শাহিনা বেগম নামের একজন গৃহবধূ বলেন, গ্রাম থেকে জেলা শহর খুলনায় যেতে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা লাগে। মাছ পরিবহনের ট্রলারযোগে খুলনা যাওয়ার অন্যতম ভরসা। মাটির রাস্তা হওয়ায় যাতায়াতের সমস্যা তুলে ধরে বললেন, গ্রাম থেকে উপজেলা সদর পর্যন্ত যেতে জনপ্রতি খরচ পড়ে গাড়িতে ২০০ টাকার বেশি। অসুস্থ রোগী নিয়ে সবচেয়ে বড় বিপদ হয়। আশপাশে কোনো হাসপাতাল, ডাক্তার না থাকায় উপজেলা হাসপাতালে নিতে নিতে পথেই অনেক রোগী মারা যান।

বৃদ্ধ আব্দুল গণি জানান, তার বয়স যখন আট বছর, তখনকার সময় বাপ-দাদার সঙ্গে বনের গাছপালা পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করেছিল গ্রামে। বয়স যখন ১২ হয়েছিল তখনও কোনো বেড়িবাঁধ হয়নি। পরে ১৯৬০-এর দশকে পোল্ডার করার সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়। তিনি আরও জানান, বেড়িবাঁধ হলেও এলাকায় ভালো কোনো রাস্তাঘাট নেই। কোথাও একটা ভ্যান চলে না। উপজেলা সদরে যেতে একদিন আগেই মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হয়। নদীপথের ট্রলারই একমাত্র ভরসা। তারপরও সকাল নয়টার পর আর ট্রলার যায় না। খুলনা যেতে হলেও সেই ট্রলার। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা পরিত্যক্ত কোনো জনপদের বাসিন্দা।

সুতারখালী ইউনিয়ন সুত্রে জানা যায়, প্রায় ৫০ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে গঠিত সুতারখালী ইউনিয়ন। এরমধ্যে ৯ হাজার ৩০০ পরিবার নিয়ে ৪০ হাজারেরও বেশি লোকসংখ্যা এই ইউনিয়নে বসবাস করে। ইউনিয়নে ২৫ কিলোমিটার ইট সোলিংয়ের রাস্তা রয়েছে, বাকি ২৫ কিলোমিটার রাস্তা মাটির। তবে কোথাও পাকা রাস্তা নেই।

সুতারখালী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির বলেন, প্রত্যন্ত এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ অতিদরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। এখানে কর্মস্থানের সুযোগ না থাকায় বর্ষাকালে মানুষের বিপর্যয়ে পড়তে হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা যাতায়াত ব্যবস্থা। ইউনিয়ন জুড়ে কোথাও কোনো পাকা রাস্তা নেই। বেড়িবাঁধের ভিতরের সড়কগুলোই ইট সোলিংয়ের রাস্তা। তবে চারপাশের ওয়াপদার রাস্তা এখনো কাঁচা রয়েছে। তিনি দাবি করে বলেন, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বেড়িবাঁধের মাটির রাস্তা যদি পাকা হয়, তাহলে এলাকার উন্নয়ন ঘটবে। একই সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন আসবে।