করোনাকালে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার ১০ প্রয়োগ

নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং অন্যের আবেগ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে। ছবি: প্রতীকী
নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং অন্যের আবেগ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে। ছবি: প্রতীকী

সত্যিকার অর্থেই করোনা মহামারি প্রতিনিয়ত আমাদের জীবন হুমকি এবং অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ অনিশ্চয়তাগুলো আমাদের আবেগকে ধৈর্যহীন ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। যেমন আগামীকাল কী ঘটবে, কবে স্কুল খুলবে, কবে সব জায়গায় অবাধ বিচরণ করব ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সময় আমরা ভীত ও অসহায় অনুভব করতে পারি, যা পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে।

কিছু কৌশল আছে, যা ব্যবহার করে আমরা করোনা উদ্বেগ প্রশমিত করতে পারি। যেমন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আমরা করেছি। এই কৌশলটি হলো ‘আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার (Emotional Intelligence, EQ)’ ব্যবহার করা। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং অন্যের আবেগ সম্পর্কে ধারণা করে সঠিকভাবে কোনো কার্য সম্পাদন করাই হলো ‘আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা’।

এখানে আমরা নিজ আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, মানসিক শক্তি ধরে রেখে এবং সহনশীলতা উন্নত করে কীভাবে করোনা সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, সেই কৌশলগুলো আলোচনা করব।

১. নিজের সঙ্গে থাকুন

আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার উন্নতি করা একটি চলমান দক্ষতা। তার মানে আপনি এটার সামান্য পরিমাণও ব্যবহার করতে পারেন যেকোনো সময়ে আত্মসচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং আত্মব্যবস্থাপনার দ্বারা। প্রতিটি অবস্থানে নিজেকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা, এটা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু যিনি পারেন, তিনি নেতৃত্ব দেন এবং তাঁকে লোকজন অনুসরণ করে। বর্তমান সময়ে আপনি, আপনার সহকর্মীরা, আপনার বন্ধুরা এবং আপনার পরিবার সবাই সম্ভবত মানসিক ধকল, উদ্বিগ্ন এবং ভয়ের অভিজ্ঞতা নিচ্ছেন। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ অন্য সময়ের চেয়ে। এটা আপনাকে পরিবর্তন, অনিশ্চয়তা এবং অস্পষ্টতা দূর করতে সাহায্য করবে।

২. নিজের যত্ন নিন
আপনি যদি অন্যদের সাহায্য করতে চান তাহলে আজ থেকেই নিজের প্রতি যত্নশীল হওয়ার অনুশীলন করুন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনি আবিষ্কার করতে থাকবেন যে কোন কৌশলগুলো আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব কৌশল হতে পারে শ্বাস-ব্যায়াম, মেডিটেশন, নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া, ভীতিকর খবর থেকে দূরে থাকা অথবা সীমিত খবর গ্রহণ এবং অস্বস্তিকর জিজ্ঞাসা অথবা কাজ কে না বলা ইত্যাদি।

৩. শিশু-কিশোরদের যত্ন নিন

শিশুদের অনুভূতি সত্যিই অদ্ভুত বড়দের মতো। আমরা বড়রা তাদের অনুভূতিকে সম্মান দেখিয়ে সাহায্য করতে পারি। যেভাবে আমরা বড়রা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করছি, সেভাবে শিশু-কিশোরদের আবেগ পরিচালনা করতে সাহায্য করতে পারি। সবকিছু তাদের সঙ্গে আলোচনার দরকার নেই যেমন ভীতিকর কোনো কিছু। যে বাস্তবিক বিষয়গুলো তাদের মানসিক বিকাশে সাহায্য করতে পারে তা আলোচনা করুন, তবে কাল্পনিক ও অসত্য বিষয় আলোচনা না করাই ভালো।

৪. আপনি কী কী নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সেখানেই দৃষ্টিপাত করুন

করোনা সংকট মোকাবিলার জন্য এমন অনেক বিষয় আছে, যা আপনার আমার ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেই বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত না করে সাধ্যের ভেতরে যে কাজগুলো করা যায়, তার ওপর গভীর দৃষ্টিপাত করি, তাহলেই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটাই প্রশমিত হয়ে যাবে। যেমন পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ দিতে পারেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য, উত্তম উপায়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন এবং সরকার কর্তৃক নির্দেশিত অন্যান্য সুরক্ষা মেনে চলার জন্য।

ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স
ছবিটি প্রতীকী। ছবি: রয়টার্স

৫. নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে নিউজ এবং আপডেট নিন

এই সময়ে অনেক আতঙ্কজনক বিষয় গুজব হিসেবে চারদিকে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। যা অপ্রয়োজনীয় মানসিক ধকল ও ভীতি সৃষ্টি করতে পারে। আপনি চাইলেই এই ধ্বংসকারী ভুল তথ্য থেকে দূরে থাকতে পারেন, এড়িয়ে চলেন। শুধু নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে নিউজ এবং আপডেটসমূহ গ্রহণ করুন। যেমন: মেডিকেল বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিজ্ঞানী এবং সরকার অনুমোদিত কোনো উৎস ইত্যাদি।

৬. কর্মসূচি সেট করুন এবং বাস্তবায়নের চেষ্টা করুন

আপনার জন্য প্রতিদিনের একটি সময় সূচি দরকার। বিশেষ করে আপনি এখন বাসায় থাকছেন এবং বাসায় থেকে কাজ করছেন, যেমন ঘুম থেকে ওঠা, খাবার গ্রহণ, মেডিটেশন, খেলাধুলা, কফি পান করা এবং সারা দিনের কাজের তালিকা থেকে ধাপে ধাপে সম্পাদন করা। এটাকে বলা হয় আত্মব্যবস্থাপনা। এটা আপনাকে উৎপাদনক্ষম রাখবে এবং কাজের প্রতি দৃষ্টিপাত বাড়িয়ে দেবে।

৭. ধৈর্যশীল হোন নিজের ও অন্যের প্রতি

আমরা এখন একটি সংকটময় সময় অতিবাহিত করছি, এই সময়ে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও ধৈর্যশীল হওয়া খুবই দরকার। একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বাস্তবতাকে গ্রহণ করা। তাহলে আমাদের মানসিক চাপ অনেকটাই প্রশমিত হয়ে যাবে। ধরে নিন, করোনা সংকট একটা স্বাভাবিক বিষয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ রকম ঘটনা অনেক ঘটেছে, বারবারই মানুষ সেই সংকটকে জয় করতে পেরেছে, এই সময়ও করবে। এভাবে চিন্তা করুন যে আমি নিশ্চিত খুব শিগগিরই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

৮. সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন

আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী ও সমাজের লোকজনকে আপনার সাধ্যের ভেতরে পরামর্শ ও সহযোগিতা করুন। এই সংকটময় সময়ে অনেক কিছুই স্থবির হয়ে পড়ছে। যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, বৈদেশিক রেমিট্যান্স ইত্যাদি। এই সময়ে অনেকেই অর্থনৈতিক ও মানসিক সংকটসহ অন্যান্য সমস্যায় পড়তে পারেন। তাই গড়িমসি না করে তাঁদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। আপনার নিজেরও যদি কোনো সাহায্য প্রয়োজন হয় অথবা মানসিক সংকট অনুভব করেন, কোনো প্রকার সংকোচবোধ না করে আপনার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করুন।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

৯. পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক গড়ুন

এই সময়ে প্রিয়জনদের বেশি করে খোঁজখবর নেওয়ার সুবর্ণ সময়। সম্ভবত আপনি তাদের থেকে দূরে আছেন, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের খোঁজখবর নেওয়া খুবই সহজ। অন্য সময় হয়তো আপনি মাসে একবার ফোন দিয়েছেন, কিন্তু এখন সেটা চারবার সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবিধার্থে, এই সময়ে ঘরে বসেই আপনার পুরোনো বন্ধুবান্ধব, যাদের সঙ্গে অনেক দিন যোগাযোগ নেই, তাদের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন করুন। 

১০. মহামারি সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে জীবনকে মূল্যায়ন করুন

এ সময় ঘরে থাকা অবস্থায়ই নিজেকে নিয়ে পুনরায় চিন্তা করার উপযুক্ত সময়। যেমন: আপনি কীভাবে বাঁচতে চান করোনা মহামারি–পরবর্তী সময়ে। আপনি যদি আগের মতোই কিছু অগ্রাধিকারভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন যেমন ই–মেইলের উত্তর দেওয়া, সবার সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ এবং শুধু প্রতিদিনের নিয়মিত কাজগুলো করে ইত্যাদি, তাহলে তো ব্যতিক্রম কিছু হলো না। করোনা মহামারিকে শাস্তি হিসেবে না নিয়ে আশীর্বাদ হিসেবে নিন। এই সময়ে কিছু স্বতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ গভীর কার্যসম্পাদনের পরিকল্পনা করতে পারেন। যেমন নতুন কিছু শেখা, স্বাস্থ্য, সম্পর্ক, ভ্রমণ এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করা ইত্যাদি।

*লেখক: গবেষক, মলিকুলার মেডিসিন