অনলাইনে ক্লাস: কী ভাবছেন ইবি শিক্ষার্থীরা

বিশ্বব্যাপী নতুন আতঙ্ক এখন করোনাভাইরাস। বিভিন্ন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি কেড়ে নিচ্ছে লাখো মানুষের প্রাণ। এ ভাইরাস থেকে বাঁচতে ইতিমধ্যেই থেমে গেছে দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এ ছুটি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সেশনজট থেকে মুক্তি পেতে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) উপাচার্য হারুন-উর-রশিদ আসকারী।

অনলাইনে ক্লাস নিয়ে কী ভাবছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে পাঁচজন শিক্ষার্থীর ভাবনা জানার চেষ্টা করেছি।

জি কে সাদিক, বাংলা

অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার উদ্যোগটি ভালো। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার এটাই উপায়। কিন্তু দেশের প্রযুক্তিব্যবস্থা এখনো অনলাইনে ক্লাস করার মতো উপযুক্ত হয়নি। বিশেষ করে মুঠোফোনের নেট ব্যবস্থা এখনো উন্নত নয়। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নেট সংযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন দশা। এ ছাড়া আমাদের ইন্টারনেট–সেবার মানও তেমন ভালো নয়। একদিকে রয়েছে গতির সমস্যা, অন্যদিকে দামও তেমন সহজলভ্য নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষার্থী পরিবার নিয়ে খেয়েপরে বাঁচাতেই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে নেট কিনে ক্লাস করার বিষয়টা তাদের জন্য আভিজাত্যপূর্ণ কাজও হতে পারে।
অনলাইনে ক্লাস করার জন্য শিক্ষার্থীর একটা ল্যাপটপ বা ভালো স্মার্টফোন প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ নেই। অনেক শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ তো দূরে থাক, ভালোমন্দ কোনো ধরনের স্মার্টফোনও নেই। তাই অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি ভালো ফলপ্রসূ হলেও সেটা বাস্তবায়ন সহজ হবে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় সেটা অসম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনলাইনে ক্লাসের উদ্যোগ নিতে বলছেন। প্রশাসনের এই আন্তরিকতার জন্য ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশাসনের উদ্যোগ আলোর মুখ দেখতে পাবে বলে মনে করি না।

আখতার হোসেন আজাদ, লোকপ্রশাসন

পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেপ্টেম্বরের আগে সম্ভব হবে না বলে মনে হচ্ছে। এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক কারণেই উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকমণ্ডলী ও দেশের কর্তাব্যক্তিরা। বর্তমানে দেশের সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেশনজট নামে অভিশপ্ত শব্দটি নেই। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে না আসায় সেশনজট নামক বিষাক্ত শব্দটি চোখ রাঙানি দিচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক প্রযুক্তির সহযোগিতায় বিভিন্ন অ্যাপস বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (ফেসবুক, ইউটিউব) ব্যবহার করে পাঠদান কর্মসূচি পরিচালনা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এভাবে পাঠদানপদ্ধতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় বিরূপ মন্তব্যও করছেন। একদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের স্বাভাবিক অর্থনীতির চাকা স্তম্ভিত। আবার বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর ইন্টারনেট ডেটা প্যাকের মূল্য অতীব চড়া। গ্রাম পর্যায়ে ইন্টারনেটের গতি নাজুক। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। এ ক্রান্তিকালে অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে পুরো দেশ। ফলে ডেটা কিনে ইন্টারনেটে ঘণ্টাব্যাপী ক্লাস করতে বাধ্য করা শিক্ষার্থীদের প্রতি একপ্রকার জুলুম হবে।
তবে এমন ক্রান্তিকালে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে অবশ্যই বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মোবাইলে সরকার কর্তৃক বিনা মূল্যে ইন্টারনেট ডেটা উপহারস্বরূপ প্রদান করা যেতে পারে। অথবা ফ্রি বেসিক পদ্ধতির মতো পাঠদানব্যবস্থা চালু করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা কোন ইন্টারনেট ডেটা চার্জ ছাড়াই অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। অথবা ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় ই-তথ্য সেবা কেন্দ্রে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

আবু ইউসুফ, আরবি ভাষা ও সাহিত্য

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। যাদের ক্যাম্পাস–জীবন কাটে পাওয়া না–পাওয়ার দোলাচলতায়। আবার অনেকে টিউশনি অথবা পার্টটাইম কাজ করে উল্টো পরিবারে টাকা পাঠাতে হয়। দৈন্যতা কখনো ছুটি নেয় না। অনেকের স্মার্টফোন নেই। প্রশাসন মেগাবাইটের ব্যবস্থা করলে এটি বাস্তবায়িত হতে পারে, অন্যথায় সম্ভব নয়।

জারিন তাসনিম রাকা, আরবি ভাষা ও সাহিত্য

প্রায় ৪২ দিন ধরে ক্যাম্পাস বন্ধ। মূলত গত ২৫ এপ্রিল থেকে রমজানের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে আরও এক মাস আগেই ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়। আর এই দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। আবার সেশনজট নামক একটা চিন্তাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাথায় চলে এসেছে, যা গত কয়েক বছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না। এমন সময় ভিসি আমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা অত্যন্ত ভালো একটি সিদ্ধান্ত।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরূপ মন্তব্য এবং প্রতিক্রিয়া দেখে আমার মনে হচ্ছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। যেখানে স্কুল–কলেজের শিক্ষকেরা তাঁদের প্রাইভেট টিউশন ক্লাসগুলো অনলাইনে নিচ্ছে। সেখানে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে অনলাইন ক্লাস নেওয়া যেতেই পারে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই আসে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। এদের সবার পক্ষে অনলাইনে ক্লাস করার জন্য ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে না। এ জন্য কর্তাব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান সবার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, যেন একজন শিক্ষার্থীও বঞ্চিত না হয়।

মাসুদ রানা, ইংরেজি

লকডাউনের এই সময়ে শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নকে গতিশীল রাখতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। প্রায় ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের। অর্থনৈতিক সংকটকালে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ডেটা কেনা এবং ভালো ইন্টারনেট স্পিডের জন্য লকডাউন উপেক্ষা করে অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সেটা আলোচনার বিষয়। তাই সাকল্যে বিবেচনায় অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষাদান কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে, সেটি কর্তৃপক্ষের একটুখানি খতিয়ে দেখা একান্ত কাম্য বলে মনে করি।