চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিদের চিন্তা অফ ইয়ার আর করোনা

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের বাগান। ছবি: সংগৃহীত
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের বাগান। ছবি: সংগৃহীত

আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ। জেলার আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা করোনা মহামারির ছোবলে হতাশ। আম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাবাসীর প্রধান অর্থকরী কৃষিপণ্য। আম ব্যবসায়ী ও মালিকেরা সারা বছর ব্যস্ত থাকেন বাগান পরিচর্যার কাজে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আমের দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এই অঞ্চলের চাষি ও ব্যবসায়ীরা। এতে করে তাঁরা মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু চাষি ও ব্যবসায়ীরা বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আস্থা পাচ্ছেন না। কী হবে তাও তাঁরা বুঝতে পারছেন না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকাবাসীর কাছে আমের 'অন ইয়ার' এবং 'অফ ইয়ার' নামে দুটি শব্দ ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। যে বছর ফলন ভালো হয় তাকে 'অন ইয়ার' এবং যখন ফলন ততটা ভালো হয় না, তাকে 'অফ ইয়ার' বলা হয়ে থাকে। যদিও কৃষিবিজ্ঞানীরা এ ধারণাকে বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে মনে করেন। সবটাই নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর। তবে চলতি বছর আমের 'অফ ইয়ার'।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৩ হাজার ৩৫ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। এখান থেকে এবার আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধারা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এসব আমের মধ্যে ক্ষীরসাপাত (হিমসাগর), খুদি খিরসা, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি, আশ্বিনা, বোম্বে খিরসা, মধু চুষকি, সাটিয়ার কেড়া, বৃন্দাবনী, টিক্কাফারাস, কালিভোগ, রানিভোগসহ নাবী জাতের আম রয়েছে। তবে ক্ষীরসাপাত, ল্যাংড়া ও ফজলি আমের কদর রয়েছে দেশ পেরিয়ে বিশ্বে।

কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে আমচাষি বা ব্যবসায়ীরা কিছুটা শঙ্কায় রয়েছেন। এখনো বাজারে আম আসতে ২০-২৫ দিন সময় লাগবে। এরই মধ্যে রমজান মাস শেষ হয়ে যাবে। চলতি বছর ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও করোনা ভাইরাসের কারণে আম ব্যবসায়ী ও বাগানমালিকেরা হতাশ।

কানসাট বাজারের আম ব্যবসায়ী ও বাগানমালিক মো. রাসেল জানান, আমের ফলন মোটামুটি ভালোই হয়েছে। তবে আড়তদার ও বেপারিদের (পাইকারি ক্রেতা) মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য নেই। প্রতিবছর এ সময় এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ আমের বাজার কানসাটের আড়তে বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ক্রেতাদের আনাগোনা লক্ষ করা গেলেও এখনো চোখে পড়ার মতো নয়।

গাছে গাছে আম। ছবি: সংগৃহীত
গাছে গাছে আম। ছবি: সংগৃহীত

অনলাইনে আম বিক্রি করা তরুণ উদ্যোক্তা মো. তরিকুল ইসলাম জানান, ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজ রয়েছে আম বিক্রির জন্য। ওয়েবসাইটও রয়েছে আম বিক্রির জন্য। অন্যান্য বছর আমের ভালো ব্যবসা হলেও এ বছর শঙ্কিত। কারণ, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অনলাইনে আমের ব্যবসা কেমন‌ হবে, তা বলা মুশকিল।

অনেক আম ব্যবসায়ী বিদেশে আম রপ্তানির জন্য সারা বছর ধরে আমের পরিচর্যা করে আসছেন। কিন্তু চলতি বছর করোনা পরিস্থিতিতে বিদেশে আম রপ্তানি করা যাবে কি না, এখনো অনিশ্চিত।

আমকে কেন্দ্র করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সরকারিভাবে গড়ে উঠেছে 'আম গবেষণা কেন্দ্র' ও হর্টিকালচার সেন্টার। বেসরকারিভাবে আম ব্যবসায়ী ও মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে। কেউ আগাম কিছু বলতে পারছেন না। এতে আম ব্যবসায়ী ও মালিকদের পাশাপাশি শ্রমিকেরাও হতাশাগ্রস্ত। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে বছরের অর্ধেক সময়ের আহারের জোগান হয় শ্রমিকদের। কেউ আমবাগানের জোগানদার, কেউ আম পরিচর্যায় নিয়োজিত থাকেন, কেউ আম গাছ থেকে পাড়েন, কেউবা আমের ঝুড়ি বা টুকরি ও কার্টুন তৈরি করেন, কেউ হোটেল ব্যবসা করে পর্যাপ্ত আয় করে থাকেন।

শুধু তা-ই নয়, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আম পাঠানো জনপ্রিয় মাধ্যম হওয়ায় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। পাঁচ বছর ধরে অনলাইনে আমের ব্যবসা করে তরুণদের মধ্যে অনেকেই স্বাবলম্বী।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চার শতাধিক মানুষ অনলাইনের মাধ্যমে আমের ব্যবসা করেন। এঁদের বেশির ভাগই তরুণ উদ্যোক্তা। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাশাপাশি আমের ব্যবসায় জড়িত। লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে আম থেকেই। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার আম বিক্রি হয় এশিয়ার সর্ববৃহৎ আমের বাজার কানসাটে। তাই এখানে বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা রয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নজরুল ইসলাম জানালেন আশার কথা। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলের আম বাজারজাতকরণে যাতে কোনো রকম সমস্যার সৃষ্টি না হয় সে জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে।

একাধিক আমচাষি ও ব্যবসায়ী জানান, ঈদুল ফিতরের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে আম পাঠানো শুরু হবে।

করোনা মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা যেন প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ পান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে।

*লেখক: সহকারী শিক্ষক, হরিমোহন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ