প্রেমের ছোঁয়ায় তাজমহল দর্শন

তাজমহলে মানুষের আনাগোনা। ছবি: লেখক
তাজমহলে মানুষের আনাগোনা। ছবি: লেখক

যেদিন তাজমহলের নাম শুনেছি এবং এ সম্পর্কে জেনেছি, সেদিন থেকেই তাজমহল দেখার আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে জিইয়ে রেখেছিলাম। অনেক দিনের সেই আশা এ বছর পূরণ হলো।

২ মার্চ ভোর ছয়টায় নিউ দিল্লি থেকে পানিকার বাসে করে উত্তর প্রদেশের আগ্রার উদ্দেশে রওনা দিলাম। দিল্লির আকাশ তখন হালকা কুয়াশায় ঢাকা। রাস্তায় যানজট নেই বললেই চলে। তাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দিল্লি পেরিয়ে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে গিয়ে উঠলাম। রাস্তায় কোনো যানজট নেই, হর্ন নেই, চালকদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা নেই কে কার আগে যাবে, গাড়ি তার আপন গতিতে আপন ট্র্যাকে ছুটে চলেছে।

রাস্তায় দোকানপাট, দাঁড়ানো গাড়ি, বিকল গাড়ি—কোনোটাই নেই। রাস্তা দখল করার মতো কোনো কিছুই নেই সেখানে। এমনকি ফিলিং স্টেশনও রাস্তা থেকে দূরে। রাস্তা মানেই শুধু রাস্তা। শুধু মাঝে দু–একবার থামতে হলো টোল দেওয়ার জন্য। পথে পানিকার ট্রাভেল এজেন্সির গাইড আমাদের জুতা ঢাকার জন্য ১০ রুপির বিনিময়ে কভার কিনতে বললেন। কারণ, এ কভার ছাড়া তাজমহলের ভেতরে অর্থাৎ সমাধিতে প্রবেশ করতে দেবে না। আমরা সকাল ১০টায় গিয়ে আগ্রায় পৌঁছালাম।

ট্যুরিস্ট গাইড বললেন, সেখান থেকে বিশেষ যানবাহনে যেতে হবে তাজমহল গেটে। জনপ্রতি ১০ রুপি দিয়ে বিশেষ যানবাহনে করে গেটে পৌঁছলাম। গেটে গিয়ে দেখি অনেক লোকের ভিড়। বাংলাদেশ সার্কভুক্ত দেশ হওয়ায় ৭৪০ রুপি দিয়ে টিকিট কেটে লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। টিকিট কাউন্টার থেকে আমাকে একটা টিকিট এবং একটা টোকেন দিল। সেই টোকেন একটা মেশিনে দিতেই গেট খুলে গেল। প্রবেশপথে সবকিছু চেক করা হলো। নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা তাজমহলের গেট পার হতেই ঘুরে বেড়ানোর এক স্বাধীনতা উপলব্ধি করলাম। কিন্তু তখনো তাজমহল দৃষ্টির অগোচরে, ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অন্য ঘরগুলো এমনভাবে তাজমহলকে আগলে রেখেছে, উঁচু গম্বুজ ছাড়া পুরো তাজমহলকে বাইরে থেকে দেখা যায় না, তার সৌন্দর্য দেখা যায় না। কয়েক মিনিট হেঁটে যেতেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছলাম। প্রবেশপথ অতিক্রম করতেই তামহলের দৃষ্টিনন্দন অপরূপ সৌন্দর্য চোখের সামনে মেলে দিল। দূর থেকে তাকিয়েই রইলাম। কী অপরূপ সুন্দর! কী মনোমুগ্ধকর! কী মনোহর!

তাজমহলের সামনে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
তাজমহলের সামনে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

আমাকে আরও কাছে এগিয়ে যেতে হবে, হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখতে হবে। সম্মুখে রয়েছে জলের ফোয়ারা ও ফুলের বাগান। এসব পার হয়ে কভার দিয়ে জুতা ঢেকে তাজমহলের ভেরে যাওয়ার জন্য এগিয়ে যেতে লাগলাম। যেতে যেতে তাজমহলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদী চোখে পড়ল। বয়ে চলেছে অমর প্রেমের এক অবারিত স্রোতোধারা প্রেম যমুনা। সেই যমুনার প্রেম স্রোতবিধৌত একটি নগরীর নাম আগ্রা।

দেখে মনে হলো যমুনার যৌবন হারিয়ে যাচ্ছে। এত দিন এ নদীর নাম শুনেছি, দেখার ইচ্ছা মনে পুষে রেখেছি কিন্তু দেখে মন ভরল না। সৌন্দর্যে ভাটা পড়েছে। নদীর জল শুকিয়ে গেছে। শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপরও নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, যমুনা নদী তাজমহলের সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দান করেছে। তাজমহলের সমাধিতে যাওয়ার জন্য টিকিটের প্রয়োজন হয়। টিকিট দেখিয়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম শাহজাহান ও মমতাজের সমাধি। শাশ্বত প্রেমের এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ এই তাজমহল। সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি হলো এই শ্বেতপাথরের তাজমহল।

কারুকার্য ও মূল্যবান পাথর দিয়ে নির্মিত এই সমাধিসৌধ তাজমহল। বলা হয়, মোগল সম্রাট শাহজাহান তাঁর তৃতীয় স্ত্রী মমতাজকে খুবই ভালোবাসতেন। তিনি স্ত্রীর স্মৃতির উদ্দেশে তাজমহল নির্মাণ শুরু করেন ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে আর সমাপ্ত হয় ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। ২০ হাজার শ্রমিক এই নির্মাণকাজে জড়িত ছিলেন। তাজমহল নির্মাণের জন্য পাঞ্জাব থেকে আনা হয় স্বচ্ছ মার্বেল পাথর, চীন থেকে সবুজ পাথর, তিব্বত থেকে স্বচ্ছ নীল পাথর এবং শ্রীলঙ্কা থেকে নীলমণি। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ২৮ ধরনের মূল্যবান পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হয় তাজমহল। হাত দিয়ে তাজমহল স্পর্শ করলাম, অনুভব করলাম প্রেমের ছোঁয়া। প্রেমের ছোঁয়ায় যেন শিহরিত হলাম। দেখতে দেখতে কখন যে সময় পার হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না।
ফিরে এসে প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় চোখ বুলিয়ে নিলাম। যেখানে লেখা আছে—
‘কেমনে জানিল শাহ্জাহান, প্রেম পৃথিবীতে মরে যায়!
(তাই) পাষাণ প্রেমের স্মৃতি রেখে গেল পাষাণে লিখিয়া হায়!
...তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ
অন্তরে তার মমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
মোমতাজ! মোমতাজ! তোমার তাজমহল
(যেন) বৃন্দাবনের একমুঠো প্রেম,
ফিরদৌসের একমুঠো প্রেম,
আজো করে ঝলমল।’

তাজমহল দেখতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভিড় জমান। ছবি: লেখক
তাজমহল দেখতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভিড় জমান। ছবি: লেখক

তাজমহলের অনতিদূরেই আড়াই কিলোমিটার দূরত্বে আগ্রা ফোর্ট বা আগ্রার দুর্গ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাঙা বেলে পাথরের তৈরি এই আগ্রা দুর্গ দেখে অভিভূত হলাম। এই দুর্গ মোগল রাজবংশের রাজকীয় আবাসস্থল ও মোগল স্থাপত্যের একটি নিদর্শন। এখানে থেকেই মোগল সম্রাট বাবর, আকবর ও তাঁর বংশধরেরা রাজত্ব করতেন। দুর্গের অভ্যন্তরে মোগল সম্রাটদের তৈরি প্রাসাদ, মিনার, মসজিদ, খাসমহল, সমাধি, বাগানসহ অনেক কিছুই দেখার আছে। আছে মুসলিম ও হিন্দু ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে তৈরি নানা স্থাপনা, কারুকার্য ও নিদর্শন।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেসকো আগ্রা দুর্গকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আগ্রা দুর্গ দেখার পর রওনা দিলাম কৃষ্ণের জন্মস্থান মথুরার উদ্দেশে। মথুরা স্থানটি আগ্রা-দিল্লি মহাসড়কের মাঝখানে। আগ্রা থেকে দুই ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে আমরা মথুরায় গিয়ে পৌঁছলাম। গাড়ির ভেতরেই ট্যুরিস্ট গাইড আমাদের বলে দিলেন, মন্দিরে টাকা ছাড়া কোনো কিছুই সঙ্গে নেওয়া যাবে না। গাড়ির ভেতরেই মোবাইল ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র রেখে মন্দিরের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে আমাদের চেক করা হলো। তারপরই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পেলাম।

যমুনা নদী। ছবি: লেখক
যমুনা নদী। ছবি: লেখক

মন্দিরে দেখলাম পূজারিরা কৃষ্ণের আরাধনায় ব্যাকুল। কেউ কীর্তন করছে, কেউবা নাম জপ করছে, কেউবা বসে ধ্যান করছে। এখানে তিনটি বড় বড় মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। এই স্থানে গিয়ে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, ঈশ্বর ও তাঁর ভক্তের প্রেমের কথা মনে পড়ে গেল। একদিকে শাহজাহান-মমতাজের প্রেম, অন্যদিকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম আমাকে আন্দোলিত করে তুলল। তাই মনের মধ্যে এই গান বেজে উঠল,
‘এই বুকে বয়ছে যমুনা নিয়ে প্রেমের অথৈ জল
তারই তীরে গড়ব আমি আমার প্রেমের তাজমহল।’


লেখক: খ্রিষ্টান যাজক, পরিচালক, মরো সেমিনারি, ২৮ জিন্দাবাহার ১ম লেন, ঢাকা।