তাৎপর্যপূর্ণ বুদ্ধপূর্ণিমা, করোনাময় উদ্যাপন

আজ মহান বুদ্ধপূর্ণিমা, ২৫৬৩ বুদ্ধবর্ষ। আজকের দিনটি দেশের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব। এদিনে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক মহামানব গৌতম বুদ্ধ কপিলাবস্তুর লুম্বিনী কাননে (নেপালে) জন্মগ্রহণ করেন, বুদ্ধত্ব লাভ (বুদ্ধগয়া) এবং মহাপরিনির্বাণ (কুশিনগরে) লাভ করেন। তাই ত্রিস্মৃতিবিজড়িত দিনটি বৌদ্ধদের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্রের দিন বটে।

বুদ্ধপূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রতিবছর জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউইয়র্কে মহাসমারোহে পালিত হয় ভেসাক ডে। ফলে, বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধ প্রতিনিধি ও জাতিসংঘে নিযুক্ত প্রতিনিধিরা এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে দিনটি যথাযোগ্য সম্মান, ভক্তি ও জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমে প্রতিবছর পালন করা হয়। ফলে, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আনন্দের সঙ্গে বিহারে গিয়ে আয়োজনটি উপভোগ করেন।

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী প্রদান করেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বৌদ্ধ সংগঠনগুলো পূর্ণিমা উপলক্ষে র‍্যালি, সভা-সেমিনারের আয়োজন এবং ম্যাগাজিন প্রকাশ করে থাকে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে থাকে। বিহারে করা হয় ধর্মীয় সভা ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দিনটিতে বৌদ্ধরা ঘরে নানা আয়োজন করেন এবং সুচিবস্ত্র পরিধান করে বিহারে যান। যেহেতু সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশে কোভিড-১৯, যা করোনাভাইরাস মহামারির মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হচ্ছে, সেহেতু সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। ভাইরাসটি ছোঁয়াচে, তাই সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঘরে বসে বুদ্ধপূর্ণিমা উদ্‌যাপনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সংগঠনগুলো।

এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শুধু বৌদ্ধবিহারে অবস্থানরত ভিক্ষু সংঘরা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পূজা, বন্দনাসহ ধর্মীয় কার্য সমাধান করবেন। শুভানুধ্যায়ীরা, ভক্তবৃন্দ এবং উপাসক-উপাসিকাগণ শুধু নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করে ধর্মীয় কার্য পালন করবেন। অনাকাঙ্ক্ষিত করোনা মহামারির কারণে এবার প্রথম বৈশাখী পূর্ণিমা বা বুদ্ধপূর্ণিমা ঘরোয়া আয়োজনে উদ্‌যাপন হচ্ছে।

বর্তমান সময়ে বুদ্ধের বাণীর প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। তথাগত বুদ্ধের জীবদ্দশায় বিত্তশালী বৈশালী নগরে হঠাৎ অনাবৃষ্টির কারণে শস্য নষ্ট হয়ে যায় এবং সে সময়ে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। ফসল হারিয়ে ও খাদ্যের অভাবে অনেকের প্রাণহানি হয়। মৃত্যুর সংখ্যা ছিল অগণিত, যা সৎকার করা কঠিন ছিল! মৃতদেহ এখানে-সেখানে পড়ে থাকত, এ কারণে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছিল। বুদ্ধ তখন এ রকম সংবাদ শুনে বৈশালী নগরে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। সে মুহূর্তে নগরে ভারী বর্ষণ হয়ে সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার পরে বুদ্ধ তাঁর সেবক আনন্দকে রতন সূত্র আবৃত্তি করতে এবং বুদ্ধের ভিক্ষাপাত্র থেকে জল ছিটিয়ে দিতে বলেন। বুদ্ধের কথামতো সেবক আনন্দ কাজ করলে তখন বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের গুণের কারণে ওই সময়ে বৈশালীর দুর্ভিক্ষ, রোগমুক্ত হয়েছিল। এখানে লক্ষ করলে বোঝা যায়, যেকোনো মহামারিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা প্রয়োজন। সেটার ইঙ্গিত রয়েছে রতন সূত্রের প্রেক্ষাপটে। যেমনটা করোনা থেকে বাঁচতে হলে অন্যতম কাজ নিজেকে ও চারপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার রাখা। সুতরাং সবার প্রয়োজন সুরক্ষিত ও সচেতন থাকা।

মহাকারুণিক বুদ্ধ ৪৫ বছর ধর্মপ্রচার করেছিলেন। তাঁর জীবন-দর্শনে ছিল অহিংসা, ক্ষমা, দয়া, সাম্য, মৈত্রী, প্রীতি, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ। এসব আদর্শকে ধারণ করতে তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যদের নির্দেশ প্রদান করেন। ধর্মপদের যমকবর্গে উল্লেখ আছে,
‘ন হি বেরেন বেরানি সম্মন্তীব কুদাচনং,
অবেরন চ সম্মতি এস ধম্মো সনন্তনো’

অর্থাৎ, জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়। বুদ্ধের অমিয় বাণী থেকে স্পষ্ট ধারণা পাই, মানবজীবন থেকে যদি লোভ, হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, পাপ, মোহ, মিথ্যা যাবতীয় কলুষিত বিষয়গুলো দূর করা যায়, তাহলে প্রকৃত সুখ লাভ করা সম্ভব হবে এবং সুন্দর ও শান্তিময় পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হবে। বৌদ্ধ নীতিশাস্ত্রের মূলভিত্তি হলো পঞ্চশীল। বুদ্ধগৃহীদের জন্য শীল পালনে গুরুত্বারোপ করেন। পঞ্চশীলে বলা হয়েছে, প্রাণী হত্যা থেকে বিরত, চৌর্যবৃত্তি না করা, মিথ্যা কথা থেকে বিরত, অবৈধ কামাচার হতে বিরত থাকা এবং কোনো ধরনের নেশাদ্রব্য সেবন না করা। যেকোনো ধর্মের মানুষের নৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য এ কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে হয়। বর্তমান সময়ে যেন সবকিছু উল্টো পথে চলছে, যা কিছুতে নিষেধ দেখা যাচ্ছে, সে কাজ উৎসাহের সঙ্গে হারহামেশে করে চলছে। মিথ্যা, পরনিন্দা, পরচর্চা, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, অন্যকে হেয় করা ও গিবত করে অনেকে নিজেকে পুতপবিত্র ভেবে অন্যের কাছে ভালো রাখার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠছে। অন্যকে অপমান ও লাঞ্ছনা করতে বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধা আসে না। এ রকম অবস্থায় এসে পৌঁছেছি আমরা যে ভালো কাজের জন্য সাধুবাদ দেওয়ার লোকের সংখ্যা সমাজে কমে যাচ্ছে। মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি ও তর্ক করে জেতার আপ্রাণ চেষ্টা। মুখে বলি একটা, কাজ করি আরেকটা। এসব অপকর্ম পরিণাম যে ভয়াবহ, তা অনেকে জানে আবার অনেকে জানে না। চলুন এ দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসি। ভগবান বুদ্ধের অসাধারণ বাণী থেকে শিক্ষা নিয়ে সব ধরনের অশালীন কর্ম থেকে দূরে থাকি, সব প্রাণীর প্রতি মহত্ত্ববোধ সৃষ্টি করি, পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হই, তাহলে ব্যক্তি থেকে বিশ্বে শান্তি বর্ষিত হবে। সবাইকে বুদ্ধপূর্ণিমার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমরা সবাই নিরাপদ ও সুস্থ থাকি, নিজ নিজ বাসায় থাকি এবং সরকারের সব নির্দেশনা মেনে চলি।
*লেখক: খণ্ডকালীন শিক্ষক, পালি অ্যান্ড বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]