লোকসংস্কৃতিনির্ভর পর্যটন সম্ভাবনা

এমন একটি সময়ে লোকসংস্কৃতির সম্ভাবনা বিষয়ে লিখছি, যখন পৃথিবীজুড়ে এক ভাইরাস লাখ লাখ জীবনকে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর মিছিলে। এই তো সেদিনও আমাদের দিনগুলো ছিল উচ্ছলতায় ভরা। আমরা কি কখনো ভেবেছিলাম, আমাদের প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখে আমাদের ঘরবন্দী থাকতে হবে!

যা–ই হোক, শেকড়কে অস্বীকার করে শিখরে যেমন পৌঁছানো যায় না, ঠিক তেমনি দেশজ ইতিহাস–ঐতিহ্যসমৃদ্ধ জ্ঞানকে অবজ্ঞা করে টেকসই বাসযোগ্য প্রকৃতি ও পরিবেশ নির্মাণ করাটাও অসম্ভব প্রায়। সাম্প্রতিক এই দুর্যোগ হয়তো আমাদের ভবিষ্যতের আরও বড় কোনো মহামারির আলামত দিয়ে যাচ্ছে। সময় হয়তো এসেছে নতুন করে বিশ্ব বিনিমার্ণের পথ অন্বেষণের। বিজ্ঞানের তত্ত্ব–উপাত্তের সঙ্গে বংশপরম্পরায় অর্জিত লোকসমাজের জ্ঞানগুলোকে সমন্বয় সাধন করে যদি উন্নয়ননীতি গ্রহণ করা যায়, তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি টেকসই প্রকৃতি ও পরিবেশ বিনির্মাণের যে পথ, সেটা সুগম হবে।

সুজলা–সুফলা এই বাংলার যেমন রয়েছে নৈসর্গিক প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্য, তেমনি প্রতিটি অঞ্চলের রয়েছে আলাদা আলাদা বৈচিত্র্যপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী কৃষ্টি কালচার, সাংস্কৃতিক আবহ, ভাষা ও জীবনাচরণ। যা অনায়াসেই একজন ভ্রমণপিপাসু পর্যটকের মন জুড়াতে পারবে। বাংলাদেশের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলের ইতিহাসসমৃদ্ধ গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক এবং 'আমের রাজধানী' হিসেবে পরিচিত সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জকে আবহমান বাংলার সামগ্রিক চরিত্র খোঁজার জন্য এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতিকেন্দ্রিক পর্যটনশিল্প বিকাশের রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।

পর্যটক আর্কষক ও পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করতে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক নিদর্শনের পাশাপাশি লোকসাংস্কৃতিক বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। মানুষ এখন প্রাকৃতিক কিংবা ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে চায় সেই এলাকার মানুষের জীবন-প্রণালি এবং উক্ত অঞ্চলের স্বতন্ত্র কৃষ্টি কালচার। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাসসমৃদ্ধ ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছোট সোনা মসজিদ, তোহাখানা, তিন গম্বুজ মসজিদ, বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সমাধি, খনিয়াদিঘি মসজিদ, নাচোল রাজবাড়ী, কানসাটের জমিদারবাড়ি, শাহ নেয়ামতুল্লাহের মাজার, দারসবাড়ী মসজিদ, চামচিকা মসজিদ প্রভৃতি। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য হিসেবে দেখা যায় মহানন্দা নদী, নদীকেন্দ্রিক নৌকাবাইচ, বিস্তৃত আমবাগান, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কানসাটের আমের বাজার, বৈচিত্র্যময় বরেন্দ্রভূমি, আলপনা গ্রাম টিকইল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিখ্যাত বাবুডাইয়ং ইত্যাদি। আছে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক বৈচি,ত্র্য যেমন স্বতন্ত্র আঞ্চলিক ভাষা, কলাই রুটি, আদি চমচম, কাঁসা, পিতল, রেশম, তাঁত, নকশিকাঁথা, মৃৎশিল্প, লোকসংগীত গম্ভীরা ও আলকাপ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জকেন্দ্রিক ঐতিহাসিক নিদর্শনসমৃদ্ধ যে পর্যটন ব্যবস্থাপনা, সেটার সঙ্গে যদি আমাদের দেশজ সাংস্কৃতিক আবহকে যুক্ত করা যায়, তবে আশা রাখি এই অঞ্চলের পর্যটনশিল্প ক্রমবর্ধমান হবে এবং স্থানীয় লোকসমাজের জীবনমানের উন্নতির পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের জন্য সৃষ্টি হবে সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্রিক কর্মক্ষেত্রের। একই সঙ্গে লোকজসংস্কৃতির ধারক ও বাহক লোকপেশাজীবী সম্প্রদায় ও লোকশিল্পীরা তাঁদের ঐতিহ্যবাহী পেশাকে আঁকড়ে ধরে প্রকৃতি ও পরিবেশের পরিবর্তিত ধারায় বাঁচাঁর যেমন সুযোগ পাবেন, তেমনি লোকশিল্পীরা পাবেন শিল্পচর্চা করার অনুপ্রেরণা।

সাধারণত আমের রাজধানীখ্যাত এই এলাকায় আমবাগান এবং আমের আড়তগুলোতে আম পাকার মৌসুমেই লোকসমাগম বেশি দেখা যায়। আমের মুকুল গাছে আসা শুরু করে পাকা আম গাছ থেকে নামানো এবং সেগুলোর বিক্রয় পর্যন্ত যেসব প্রক্রিয়া, সেটাও বেশ মনোমুগ্ধকর। একেকটা আমবাগানে একেক জাতের বিশালাকার আমগাছ আর সেসব গাছের রকমারি সব আমের রূপ ও আকৃতি আপনাকে নিশ্চিত আকৃষ্ট করবে। সবুজের এই বিশাল সমারোহ ছেড়ে মন যখন চাইবে একটু হিমেল হাওয়া ও সিক্ত জলরাশিতে মন ভেজাতে, তখন দেখবেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে মহানন্দা নদী। আর নদীকেন্দ্রিক প্রাকৃতিক যে সৌন্দর্য, পেশাজীবী সম্প্রদায়ের জীবনাচারণের যে ধরন, সেটাও ভ্রমণপিপাসু যেকোনো পর্যটকের মন জুড়াতে সক্ষম। নদীকেন্দ্রিক ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ উৎসব, হরেক রকমের নৌকার নাম ও বাহারি সাজের নৌকা, জেলেদের মৎস্যশিকারের কৌশলাদি, মাঝিদের যাত্রী পারাপারকালে সুমধুর গান পর্যটকদের দেবে বাড়তি আনন্দ। চাঁপাই আসবেন আর চাঁপাইয়ের ঐতিহ্যবাহী হরেক রকমের ভর্তা দিয়ে কলাই রুটির স্বাদ নেবেন না, তা কেমন করে হয়। ভর্তার ঝাল আর কলাই রুটির স্বাদে আপনার জিহ্বা যখন একটু মিষ্টির খোঁজ করবে, তখনই স্বাদ নিতে পারেন ১৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী শিবগঞ্জের আদি চমচমের। রাত্রিবেলা যখন লোকসংগীত গম্ভীরা আর আলকাপের আসরে বসবেন, তখন কখন যে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন নিজেই হয়তো বুঝতে পারবেন না। প্রাসাঙ্গিক অর্থে একটি কথা না বললেই নয়, লোকসংগীতের আবর্তে গম্ভীরা ও আলকাপ কেবল নিছক আনন্দরসের খোরাকই জোগায় না, গানের কথাতে থাকে হাস্যরসের ছলে সমাজসচেতনতার বার্তা। মানসিক প্রশান্তি নিয়ে ঘুমানোর জন্য যখন বিছানায় আসবেন, দেখবেন চাপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথা, যার প্রতিটি নকশা আর সুতার বুননে খুঁজে পাবেন আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপ। পরের দিন আপনি যখন চাঁপাইয়ের বিখ্যাত রেশম, তাঁত, কাঁসা-পিতল, নকশিকাঁথা ও মৃৎশিল্প তৈরির সুনিপুণ কারিগরি দক্ষতা স্বচক্ষে দেখার জন্য বের হবেন; নিশ্চিত করে বলতে পারি আপনি এই ঐতিহ্যবাহী পেশাজীবীদের একেকটি নান্দনিক শিল্পকর্মে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকবেন।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এই জনপদকে নিয়ে গবেষণানির্ভর একটি মনোমুগ্ধকর প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে সাংস্কৃতিক পর্যটনকে এগিয়ে নেওয়ার একটি রোল মডেলের দিকনিদের্শনা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণারত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন। তাঁর পরিকল্পিত এই প্রামাণ্যচিত্র তৈরিতে সহযোগী হিসেবে ছিলেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রতন কুমার এবং উক্ত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাকিব আহমেদ।

আবদুল্লাহ আল মামুনের মতে, দেশজ বাণিজ্য টিকে থাকলে গ্রামীণ অর্থনীতি টিকে থাকবে, আর গ্রামীণ অর্থনীতি টিকে থাকলে গোটা বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আপনা–আপনিই আসবে। কেননা বাংলাদেশ হলো গ্রামপ্রধান বাংলাদেশ। সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য জেলার সংস্কৃতি ও ইতিহাস তুলে ধরতে পারলে দেশি –বিদেশি পর্যটক সহজেই আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ সরকার জেলাভিত্তিক পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেখানে লোকসংস্কৃতিনির্ভর পর্যটন ব্যবস্থাপনা রাখতে পারে কার্যত ভূমিকা। এ জন্য প্রয়োজন পর্যটন নীতিমালাসহ কাঙ্ক্ষিত সংস্কার, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সেগুলোর বাস্তবায়ন। লোকসংস্কৃতিনির্ভর পর্যটন সম্ভাবনার যে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে, সেটার যদি সফল বাস্তবায়ন করা যায়, তবে দ্রুতই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পর্যটন তথা সার্বিক পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসার ঘটবে।