কোভিড-১৯: সব খবর থাকলেও, মনের খবর কই

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) নিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন রকম খবর সামনে এলেও, মানুষের মনের খবর কিছুটা হলেও দৃষ্টির অন্তরালে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সব শ্রেণির মানুষের মানসিক চাপের উর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত এবং কারও কারও ক্ষেত্রে এটি আকাশচুম্বী।

উদাহরণস্বরূপ, আমরা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কিছু গবেষক এ বছরের এপ্রিলে প্রায় ৯০০ বাংলাদেশির ওপর অনলাইন জরিপের মাধ্যমে দেখেছি, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের গড় মানসিক দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক সময়ের থেকে ১০ গুণ বেড়ে গেছে (https://www.evise.com/co-author/?dgcid=invite_email_coauthoroutreach01651781#/PSY/ submission/PSY_2020_1187)। করোনা মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে কেড়ে নিয়েছে। সামাজিক শ্রেণিভেদে ভিন্নতর অস্থিরতার উপস্থিতি সুস্পষ্ট। চলুন এবার কিছু বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক:

১.
কর্মসূত্রের কারণে নিজ বাড়ি থেকে বেশ দূরত্বে অবস্থান করায় দিন শুরুর বাক্যালাপ পিতৃদেবের সঙ্গে মুঠোফোনেই শুরু হয়। এটা এখন সর্বৈব নিয়ম, ভাঙলে পর্বতসম কৈফিয়ত। করোনাকালীন সময়ে প্রতিদিন তাঁর আড়ষ্ট কণ্ঠে শেষ কথা একটাই, ‘কবে যে তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে...।’ আমি হেসে বলি, ‘এই তো আর কিছু দিন।’ আমার বাবার মতো লাখো বৃদ্ধ মা-বাবা একই রকম আকুতি ও আশা নিয়ে দিন পার করছেন। হয়তো অনেকের আর্থিক বৈকল্য না থাকলেও, হৃদয়ে বিরাজমান।

২.
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন শ্রেণিকক্ষের লেখাপড়ার চুপচাপ অবস্থান পরিলক্ষিত। উন্নত দেশগুলো বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ক্যাম্পাস-অনুপস্থিত শিক্ষা কার্যক্রম (অনলাইন) চালু করলেও, আমাদের দেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো এখনো সেখানে মনোনিবেশ করতে পারছে না। এর মূলত দুটি কারণ থাকতে পারে: প্রথমটি, আর্থিক কারণে অনলাইনে পাঠদানের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে না পারার অক্ষমতা এবং দ্বিতীয়টি, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থাকলেও অথবা বিভিন্ন ডোনার সংস্থা থেকে পেলেও সেগুলোর ব্যবহারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব, যেটা সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে অনেকটা ‘cultural lag’ হিসেবে পরিচিত। আর এর সঙ্গে আমাদের কর্তাদের কেনাকাটার পাপদৃষ্টি যদি যোগ হয়...। যাইহোক, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যেই পিছিয়ে পড়েছে। কারণ, তারা এখন শ্রেণিকক্ষের পাঠদান থেকে বিচ্যুত। যেটা দীর্ঘ সেশনজটের উচ্চমাত্রার আশঙ্কা, যখন উন্নত দেশের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে তাদের নিয়মিত শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সময়মতো সার্টিফিকেটের হাতছানি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বাড়তি মানসিক চাপ হবে। কারণ, আপনি আন্তর্জাতিক বাজারের চাকরি এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদনে পিছিয়ে যাবেন। এ ছাড়া, বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধমিকে পড়ুয়াদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতি হতে পারে, যেটা হয়তো করোনার মতো খালি চোখে দৃশ্যমান নয়। শিশুদের দীর্ঘদিনের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি তাদের একটানা মোবাইল বা ট্যাব অথবা টেলিভিশনের সঙ্গ ও অতিরিক্ত ঘুমিয়ে থাকার অভ্যাস বাড়িয়ে দিতে পারে, যেটাকে স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষকেরা ‘sedentary behaviour’ বলে থাকেন এবং এই আচরণ ৩০–এর অধিক রোগের কারণ হতে পারে, এমনকি টাইপ-২ ডায়াবেটিসও।

৩.
‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ সেদিন প্রয়োজনীয় বাজার সেরে রিকশায় আসতে আসতে রিকশাওয়ালার কাছে জানতে চাইলাম, রোজা কি রাখতে পারেন চাচা? প্রতি উত্তরে তিনি বললেন, ‘আর রোজা... সব গেছ, মনে ছিল নাতিরে লৈ অন্তত জুমার নামাজ পড়ুম রমজানে, কিন্তু হেইডাও করোনা খাই দেছ..., খা।’ বাংলাদেশের মানুষ সব সময় ধর্মপ্রাণ। চিরাচরিতভাবে আল্লাহ/ঈশ্বরকে যেন সব সময় আপন করে নিয়েছে। পবিত্র রমজান মাসে মসজিদগুলো ধর্মপ্রাণ মুসল্লিতে ভরপুরের কমতি থাকে না। তবে বৃহস্পতিবার থেকে মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া হচ্ছে। তবে নিয়ম মেনে তা করতে হবে। সমরূপতা হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনালয়েও। ধর্মীয় বিশ্বাস থাকলেও মানুষ আচার-পর্বে ভূতপূর্ব অবস্থানে নেই । তাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাসে কিছুটা হলেও ভাটির টান দৃশ্যমান। এ রকম হতে থাকলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানবকূলের বিমুখতা সম্ভাব্য, যার ফলশ্রুতিতে মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়ে যেতে পারে।

৪.
এবার আসি পেশাজীবীদের দিকে। করোনাকালে ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, ব্যাংকারসহ যাঁরা নিরলস পরিশ্রম করছেন, তাঁরা অনেকটা হলেও স্বতঃস্ফূর্ত কর্তব্য পালনে শঙ্কিত। স্বাভাবিকভাবেই নিজের জীবন বলে কথা। আর একজন মানুষ কি শুধুই একা? নিশ্চয়ই না উত্তর জিতবে। পরিবারের পরিজনেরা যে একে অপরের সঙ্গে বেঁধেছে প্রাণ। এটাই তো সমাজের আদি নিয়ম। আর আমাদের সমাজ তো পশ্চিমা সমাজের চেয়ে আরও বেশি পরিবারকেন্দ্রিক। কিন্তু পেশাজীবীদের পরিবারও যে এখন হুমকির মুখে। আমার এক নিকটাত্মীয় ডাক্তারের সঙ্গে কিছুদিন আগে ভিডিও চ্যাটিংয়ের সময় দেখলাম সে মুখমণ্ডল মাস্কে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। উৎকণ্ঠার সঙ্গে মাস্ক পরে ঘরে কেন জিজ্ঞেস করায় সে কিছুটা জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘আজ পাঁচজন রোগী দেখেছি, তার চারজনেরই করোনার উপসর্গ আছে। তাই ভয়ে আছি, আমার মধ্যেও ভাইরাস চলে এসেছে কি না!’ যদি রোগীদের করোনা হয়, তাহলে তো তাকেও কোয়ারেন্টিনে যেতে হবে। এর চেয়েও গুরুতর হলো তাঁর দুই বছরের শিশু ও পরিবারের অন্যরা। ছোট বাবু নাকি তাঁর সংস্পর্শে আসছে না। কারণ, মাস্ক পরিহিতা যেন তার মায়ের সদৃশ নয়। কিন্তু মাকে যে মাস্ক পরতেই হবে, আর সেটা হয়তো বিশেষ করে আরও বেশি তার শিশুর জন্যই। তাহলে সহজেই অনুমেয়, চিন্তার মাত্রা কীভাবে বহুমাত্রিক হয়েছে।

৫.
আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে। নিজ ব্যবসা বলেন অথবা অন্যের কারখানায় চাকরি, লকডাউনে সবই বন্ধ। সামাজিক দূরত্বের জন্য বাজারে ক্রেতার স্বতঃস্ফূর্ত সচেতন উপস্থিতি নেই। আর্থিক অসচ্ছলতা কর্মহীনদের দিন দিন গ্রাস করছে। এ যেন ‘চলিতে চরণ চলে না’র মতো অবস্থা। বুভুক্ষুর সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য নির্ভর করছে সরকারি সাহায্য ও অন্যান্য ছোট-বড় গোষ্ঠী বা ব্যক্তিপর্যায়ের দাতাদের ওপর। গরিবদের আবার এর মধ্যে কিছু কথিত ভালো লোকের দুষ্টুমিও সহ্য করতে হচ্ছে। কারণ, সরকারের প্রদত্ত অন্নহীনদের অন্নে যে কথিত ভালো লোকেরা ভাগ বসাচ্ছেন। বোঝেন তো, উনারা যে নেতা, সেটা বোঝাতে হবে না? তবে ব্যতিক্রমও অনেক। প্রান্তিক জনগণের এখন একটাই চিন্তা, বেঁচে থাকা। সেটা হয়তো অনেকের করোনাতে নয়, খাবারের।

পরিশেষে বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম বলেছেন, সমাজের ক্রান্তিকালে স্বাভাবিক নিয়মে যখন কোনো কিছু থেকে মানুষ দীর্ঘকালীন বিচ্যুত হতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। তবে করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সব মানুষের কায়িক হত্যা না হলেও, মনের হত্যা কি এড়ানো যাবে? আমি অবশ্য কলসের পানি অর্ধেক ফাঁকা থাকলেও সেটাকে সব সময় অর্ধেক ভর্তিই দেখি। আসুন যাঁরা বৃদ্ধ আছেন, তাঁদের সঙ্গে বেশি বেশি কথা বলি। তবে করোনার খবর একটু কম দিই। কথায় আছে, অজানাতেই সুখ। ক্লাসনির্ভর কার্যক্রম থেকে অনলাইন বা ওয়েবিনারভিত্তিক বিকল্প ভাবনা ও পেশাজীবীদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে অনেকটাই জনমনে স্বস্তি বাড়বে। এ ছাড়া সরকারের করোনা মোকাবিলা প্রচেষ্টার পাশাপাশি যদি অন্যান্য কল্যাণমুখী সংস্থা, যেমন ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’ অথবা আমার নিজ গ্রামে একদল যুবকের গঠিত ‘কামারকাঠী তরুণ সংঘের’ মতো সংঘগুলো যেভাবে প্রান্তিক মানুষের জন্য কাজ করছে, এভাবে সবাই এগিয়ে এলে কিছুটা হলেও মানুষ ভরসা পাবে। পাশাপাশি আমরা ঘরেও থাকি এবং অকারণে বাইরে ঘোরাঘুরি থেকে বিরত থাকি। আশা রাখি, মাইকেল জ্যাকসনের ‘Earth Song’ অথবা নচিকেতার ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে’ গানের মতো সত্যিই আমরা ঘুরে দাঁড়াব, আর করোনা তখন হাঁটু গেঁড়ে কাঁদবে।

*লেখক: পিএইচডি গবেষক, লিডস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য ও সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। Email: [email protected]