মায়েরা থাকবে পরম যত্নে

‘মায়ের এক ধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম,

পাপোশ বানাইলেও ঋণের শোধ হবে না
এমন দরদিভাবে কেউ হবে না আমার মা গো’

জনপ্রিয় এ গানটি মাকে ভালোবেসেই গেয়েছেন কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর।

সত্যিই তাই, জন্মদাত্রী হিসেবে আমার, আপনার, সবার জীবনে মায়ের স্থান সবার ওপরে৷ তাই তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিনের হয়তো কোনো প্রয়োজন নেই৷

গর্ভধারিণী মায়ের অনুগ্রহ বাদ রেখে কোনো সন্তানেরই ভূমিষ্ঠ হওয়া সম্ভবপর নয়। পরম মমতাময়ী মায়েরা নিজের সন্তানের ভালোর জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেন। সম্মুখ এ যুদ্ধে সব বয়সী মায়েদের অংশীদারত্বই সমান।

রাজধানীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনার্সপড়ুয়া শিক্ষার্থী সুমাইয়া জাহান ইজান। পরিবারের ইচ্ছাতেই কয়েক বছর আগেই বিয়ে হয়েছে। স্বামী চাকরি করে আর ইজান এখনো পড়ছেন। নিয়মিত ক্যাম্পাসে যাতায়াত করা লাগে। এর মাঝে ঘর আলো করে এক শিশু জন্ম নেয়। ঘরে কোলের বাচ্চা ফেলে প্রয়োজনে আগের মতো পড়তে পারেন না। ক্যাম্পাসেও একেবারে যেতে পারেন না। স্বামীর বাসা থেকে অনেকেই খোঁজখবর রাখেন তবে এসে থাকার মতো কেউ নেই। শ্বশুর-শাশুড়ি না–ফেরার দেশে গেছেন আগেই। তাঁদের অভাব পূরণ করে আছেন ইজানের বাবা-মা। সেই তাঁরাও থাকেন গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

গ্রামের সংসার ফেলে মা অনেক দিন ঢাকায় এসে থাকতে পারে না বলে ইজানের বাধে বিপত্তি। এদিকে স্বামীর অফিস, সে–ও থাকে না ঘরে। বাধ্য হয়ে ক্লাস না করার সিদ্ধান্ত নেন। শুধু পরীক্ষা দেবেন এই অপেক্ষায় থাকেন। আর অনলাইন ফ্রেন্ডদের থেকে সাজেশনপত্র নিয়ে ঘরে থেকেই চলছে পড়াশোনা। এভাবেই চলছে ইজানের জীবনযুদ্ধ!

জোরেশোরে বলাই যায়, মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও স্নেহের সঙ্গে অন্য কোনো সম্পর্কের তুলনা হয় না। ঠিক তেমনই এক মা সুখীরন নেছা। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। যিনি সন্তানের জন্য ৪৪ বছর রোজা পালন করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছেলের জন্য রোজা পালন করবেন বলে জানিয়েছেন।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বাজার গোপালপুর গ্রামের মৃত আবুল খায়েরের স্ত্রী সুখীরন নেছা। তাঁর তিন ছেলে, তিন মেয়ে। সুখীরন নেছা বলেন, তাঁর বড় ছেলে শহিদুল ইসলাম হারিয়ে যান। এ সময় তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, ছেলেকে ফিরে পেলে আজীবন রোজা রাখবেন। পরে ছেলেকে ফিরে পান, তাই তিনি গত ৪৪টি বছর রোজা রাখছেন।

এ তো গেল সুখের সংসারের কথা। তৃপ্তির গল্প। আমাদের চারপাশে এমনও কিছু গল্প থাকে, যা গোটা পরিবেশটাকে অন্য রকম করে তোলে। হারিয়ে দেয়, মুহূর্তের জন্য হলেও থামিয়ে দেয় আমাদের। গোটা বিশ্বজুড়ে চলছে মহামারি করোনাভাইরাসের আতঙ্ক। ছোঁয়াচে রোগ হওয়ার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার কড়া নির্দেশ করে বলছে, সবাই যাতে দূরত্ব বজায় রাখেন। পরিবারের কেউ আক্রান্ত কিংবা করোনার উপশম দেখা দিলে আলাদা কক্ষে থাকেন। পরিবারে সংকট থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে যান। আর বৃদ্ধদের ঘরে থাকার জন্য অনুরোধ-মিনতি করার কথাও হরহামেশা কানে আসে।

তবে এসব তোয়াক্কা না করে, অমানবিকতার বাহানা বুকে চেপে অনেকে বৃদ্ধ মাকে বনে–জঙ্গলেও ফেলে চলে আসছেন। ‘মা, তুমি এই বনে এক রাত থাকো। কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব’—এ কথা বলে ৫০ বছর বয়সী মাকে টাঙ্গাইলের সখীপুরে শাল-গজারির বনে ফেলে যান তাঁর সন্তানেরা। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে সন্তানেরা এমনটা করেন। পরে দিবাগত রাত দেড়টার দিকে উপজেলা প্রশাসন তাঁকে বন থেকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠায়।

মানুষ আমরা আর কবে মানুষ হব। মহামারি এই ভাইরাসের ভেতরেও জন্মদাত্রী মাকে জঙ্গলে ফেলে আসা ঠিক কতটা অমানবিক, তা আমার বোধগম্য হয় না। দিনকে দিন পৃথিবীর মানুষগুলো নিষ্ঠুর হচ্ছে। তবে মা কিংবা বাবাকে কেন্দ্র করে সাংঘর্ষিক কোনো কিছুতে মঙ্গল বয়ে আনে না। আনতে পারে না। এ যেন প্রাকৃতিক নিয়ম।

রত্নগর্ভা এই মা কর্মজীবী হয়, অনেকেই স্বামীহারা হয়। তারপরও নিজে তিল তিল করে বড় করে তোলে পরিবারের একমাত্র আদরের ধন সন্তানকে। মায়েদের এত কষ্ট, সাধনা সব যেন ফিকে হয়ে যায় একসময়।

এই মা-ই আবার ছেলের হাতে মার খায়, ছেলের বউয়ের চোখের বিষ হয়। শেষ কি এখানেই? অনেক মায়ের শেষ আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রম। হৃদয়ভাঙা আর্তনাদ আর চোখের পানিতে ভেসে ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। দিন গড়িয়ে রাত আসে, ভোর হয় তবু আসে না ছেলের দেখা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শহরের অনেক যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ার ফলেও এমনটা হয়। তবে এসবের শেষ হওয়া দরকার।

এক সমীক্ষায় জানা যায়, পারিবারিক সহায়তা, পেনশন ও বয়স্ক ভাতার আওতাধীন প্রবীণ ছাড়াও এ দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রবীণ জনগোষ্ঠী অযত্ন-অবহেলার শিকার। এ জনগোষ্ঠী তাদের জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম।

স্বস্তি ও শান্তিতে বেঁচে থাকুক মায়েরা। বৃদ্ধ হলে কেউ যাতে ভিক্ষাবৃত্তি না করে, কারও জায়গা যাতে বৃদ্ধাশ্রমে না হয় এসবও দেখা দরকার সমাজের দায়িত্বশীলদের। সব মায়েরা যেমন চায় তার সন্তান দুধে ভাতে থাক, সন্তানদেরও উচিত সব মায়েরা যেন শেষ বয়সে দুধে-ভাতে থাকে, তা নিশ্চিত করা। ভালোবাসা সব মায়েদের প্রতি।


* লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা। [email protected]