রোসেনবার্গের প্রবন্ধ, তিনটি ধাপ করোনায়ও প্রাসঙ্গিক

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

আমেরিকান মেডিকেল বিজ্ঞানবিষয়ক ইতিহাসবিদ চার্লস ই রোসেনবার্গ (১৯৩৬) ‘আমেরিকান একাডেমি অব সায়েন্স’ জার্নালে ১৯৮৯ সালে ‘হোয়াট ইজ় অ্যান এপিডেমিক? এইডস ইন হিস্টোরিক্যাল পার্সপেক্টিভ’ নামে এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল মূলত এইডস নিয়ে। তিনি এইডস রোগের মূল কারণ এইচআইভি ভাইরাসের (এইচআইভি) সংক্রমণ কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, সে আলোচনাই করেছিলেন প্রবন্ধে। শুরুর দিকে তিনি নাতিদীর্ঘ এক আলোচনায় বোঝাতে চেয়েছেন যে পৃথিবীর ইতিহাসে যেকোনো মহামারি বা ঘটনার গঠনতন্ত্রের গল্প আসলে একই রকম।

১. প্রোগ্রেসিভ রেভেলেশন

ওই লেখায় চার্লস ই রোসেনবার্গ বলেছিলেন, যেকোনো মহামারি যখন এপিসেন্টার বা প্রাথমিক সংক্রমণের এলাকা ছেড়ে গোটা দেশ ও পরবর্তী সময়ে গোটা দেশ ছাড়িয়ে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে ক্রমান্বয়ে বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হয়, তখন তা তিনটি ধাপের মধ্য দিয়ে যায়। তিনি প্রথম ধাপের নাম দিয়েছেন প্রোগ্রেসিভ রেভেলেশন। খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে এই ধাপে যেটা ঘটে, তা হচ্ছে আসন্ন বিপদের কথা আমাদের বোধগম্য হয় বেশ দেরিতে। অর্থাৎ আমরা খুব ধীরে ধীরে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি। এককথায় এই ধাপে আমরা বিষয়টিকে তেমন পাত্তা দিই না। চলমান করোনা মহামারির সংক্রমণের সঙ্গে এই প্রথম ধাপটি যে পুরোপুরি মিলে গেছে, তা অনায়াসেই বলে দেওয়া যায়। করোনার শুরু চীনের উহানে। উহান থেকে গোটা পৃথিবীর বাকি মানুষ ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর কোনো অঞ্চলই একে পাত্তা দেয়নি। এককথায় গোটা বিশ্বের জনসমষ্টি থেকে মানসিক, সামাজিক ও ভৌগোলিক দূরত্বে করোনার উৎপত্তিস্থল হওয়ার কারণে একে নিয়ে চিন্তা কারোরই মাথায় আসেনি। ধীরে ধীরে একসময় নিজের নিয়মে দূরত্বের দৈর্ঘ্য বদলিয়ে এটি ইরান এবং এরপর ইউরোপের দিকে গেল। ইউরোপে তাণ্ডবলীলা চালানোর সময় ব্যাপারটার ব্যাপকতা বুঝে ওঠার ধাপটা শুরু হয়।

আমরা আমাদের বাংলাদেশকে তখনো নিরাপদ ভাবছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল এটি দেশে আসবে না। চিকিৎসকসহ অনেককে বলতে শোনা গেছে করোনা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এমন কথাও বলা হয়েছে, গরম আবহাওয়ায় এটি ছড়াবে না। বিষয়টির গুরুত্ব পুরোপুরি অনুধাবন না করেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, এটি মোকাবিলার জন্য আমাদের সব প্রস্তুতি রয়েছে। একসময় বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে এই রোগ আমাদের দেশে প্রবেশ করল। এর কয়েক দিনের মধ্যেই আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রমণটিকে প্যানডেমিক ঘোষণা দিল। আর তখনই আমরা সজাগ হওয়া শুরু করলাম। এরপর ধীরে ধীরে রোগ ছড়িয়েছে। আমরাও তখন এটি নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম অনেকটা গুরুত্ব নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কারণে। প্রোগ্রেসিভ রেভেলেশনের শেষের ধাপ এটি। মহামারির ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখব, এই প্রোগ্রেসিভ রেভেলেশন অর্থাৎ ধীরে ধীরে বুঝে ওঠার এই ধাপটি সব মহামারিতেই ছিল।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

২. ম্যানেজিং র‌্যান্ডমনেস

চার্লস ই রোসেনবার্গ সংক্রমণ ছড়ানোর দ্বিতীয় ধাপটির নাম দিয়েছেন ম্যানেজিং র‌্যান্ডমনেস। তাঁর মতে এই ধাপটি খুবই এলোমেলো। এই সময় মহামারির প্রকোপ যদিও বাড়তে থাকে, কিন্তু তা সমানভাবে সব মানুষের চিন্তাকে একইভাবে প্রভাবিত করে না। ফলে মানুষের মধ্যে এটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তখন। আর এই প্রতিক্রিয়ার ধরন এতটাই বিস্তৃত যে গোটা ধাপটাই এলোমেলো। এই ধাপে অনেক মানুষ তার ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে বিষয়টাকে দেখে। সেই বিশ্বাস অনুযায়ী খোঁজে প্রতিকারের। চলমান এই করোনা মহামারিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া অনেক ভিডিওতে আমরা দেখেছি, অনেকেই ধর্মবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে আমাদের কেন করোনা হবে না, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। আবার অনেক দেশে একই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট প্রাণীর মূত্রকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের ঘটনা এই ধাপে ঘটে।

রোসেনবার্গ আরও লিখেছেন, এই দ্বিতীয় ধাপে আরও যেটা ঘটে তা হচ্ছে দোষ চাপানো। দোষ চাপানো হয় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর ওপর, ভিন্ন খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত গোষ্ঠীর ওপর, এমনকি বিভিন্ন খাদ্যবস্তুর ওপর। করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটিই ঘটেছে। আমরা দোষ দিয়েছি চায়নিজদের খাদ্যাভ্যাসের ওপর। শুধু তা–ই নয়, এক দেশের সরকার অন্য দেশের সরকারের ওপর দোষ চাপানো শুরু করল। করোনা মহামারির আগে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ মহামারি ছিল স্প্যানিশ ফ্লু। ১৯১৮ সালের সেই মহামারির সময় চীন ও মার্কিন সরকার দোষারোপ করেছিল একে অপরকে। চলমান করোনা সংক্রমণেও সেই ঐতিহ্য বহাল তবিয়তে অটুট রয়েছে। আর এসব দোষারোপের ফলে তৈরি হয় সামাজিক বিভাজন। মানুষের মধ্যে তৈরি হয় মিথ্যা আশ্বাস। এই ধাপেই তাই সংক্রমণের ঘটনাগুলো আরও বিস্তৃত হয়।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

৩. নেগোশিয়েটিং পাবলিক রেসপন্স

রোসেনবার্গের দেওয়া তৃতীয় ধাপটির নাম নেগোশিয়েটিং পাবলিক রেসপন্স। এই ধাপে এসে মহামারি নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসে সরকার। এই ধাপে এসে শুরু হয় সরকারের আরোপিত ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যবিধি নির্দেশিকার সঙ্গে জনগণের ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ার। এই ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বকীয়তার ওপর। নির্ভর করে মানুষের জীবনধারণ ও তার দৈনন্দিন কার্যাবলির ওপর। যেমন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রুখতে সোশ্যাল আইসোলেশন বা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকের ঘরে বসে কাজ করার সুযোগও নেই। এইখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা ক্রিয়াশীল।

এই ধাপে আরও যেটা ঘটে তা হচ্ছে দেশের সরকারের সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র চেপে যাওয়া। পৃথিবীর সব মহামারির ক্ষেত্রেই তা যেমন ঘটেছে, করোনার ক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। করোনাতে চীন বা ইরানের মৃতের প্রকৃত সংখ্যা চেপে যাওয়ার কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে। এই ধাপে আরও যা ঘটে, তা হচ্ছে সংক্রমণ রুখতে স্বাস্থ্য বিভাগ কতটা তৈরি, সেই তথ্য চেপে যাওয়া। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এই তৃতীয় ধাপেও কিছু মানুষ মহামারির সংক্রমণ থেকে মানসিক, সামাজিক ও ভৌগোলিকভাবে দূরত্বে থেকে যায়। তারা সতর্কও হয় না। আমাদের চারপাশে এই রকম উদাহরণ অনেক দেখা যায়। রোসেনবার্গের এই আলোচনা কি করোনা মহামারির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক নয়?

রোসেনবার্গ তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, পৃথিবীর সব মহামারি এই তিনটি ধাপের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। তাই তিনি তাঁর প্রবন্ধে প্যানডেমিক রুখতে ও প্রাণহানি কমাতে আহ্বান করেছেন যেকোনো মহামারির ইতিহাসকে বুঝতে। আমরা যদি মহামারির ইতিহাসগুলো পড়ি তাহলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রেও রোসেনবার্গের বিবরণ যে সত্য, তাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা থাকবে না।

রোসেনবার্গকে এই প্রবন্ধ লিখতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল সাহিত্যিক আলবেয়ার কামুর লেখা ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি। আলবেয়ার কামু (১৯১৩–১৯৬০) ১৯৪৭ সালে এই উপন্যাসটি লেখেন। আলজেরিয়ার ওরানে ফরাসি উপনিবেশ স্থাপনের পর ১৮৪৯ সালে কলেরা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। ধারণা করা হয়, ১৮৪৯ সালের কলেরা মহামারির ওপর ভিত্তি করেই কামু এ উপন্যাস লেখেন।

যুগে যুগে মহামারি নিয়ে যেসব সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলো কিন্তু মহামারির সত্যিকার ঘটনা, বর্ণনা এবং ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই রচিত। তার মধ্যে ড্যানিয়েল ডিফোর (১৬৬০–১৭৩১) লেখা ‘আ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়া’ একটি। ১৬৬৫ সালে লন্ডনে যে প্লেগ আক্রমণ করে, তার ওপর ভিত্তি করে ড্যানিয়েল ডিফো লেখেন উপন্যাসটি। বইটি প্রকাশ করা হয় ১৭২২ সালে। এক ব্যক্তির চোখে দেখা মহামারির চিত্র দেখানো হয়েছে এখানে। উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে ডিফো তাঁর চাচা হেনরি ফোর জার্নাল থেকে তথ্য নিয়ে লিখেছেন উপন্যাসখানা। ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে লেখা এই উপন্যাসে আমরা মহামারির সময়ের যে বর্ণনা দেখি, তা এই করোনা সংক্রমণের সময়ে এসে একই রকম আছে। সেই সংক্রমণকে পাত্তা না দেওয়া, রোগের ক্রমশ বিস্তার, ভয়ভীতি, মজুতদারি, দোষারোপ, কুসংস্কার, স্বার্থপরতা, মৃতের সংখ্যার সঠিক হিসাব লুকানো, তথ্য গোপন, সামাজিক দূরত্ব এবং কোয়ারেন্টিন সবই যেন সব মহামারির সময় একইভাবে তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে।

ব্রিটেনের ১৭ শতকের বিউবনিক প্লেগ মহামারির কথা ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন স্যামুয়েল পিপস (১৬৩৩–১৭০৭) নামের এক ব্রিটিশ নৌ প্রশাসক। ডায়রিতে ১৬৬০ থেকে ১৬৬৫ সালের সময়কালে বর্ণনা রয়েছে মহামারির। তাঁর লেখায় রয়েছে সংকটের ভয়াবহতার কথা, মৃতের প্রকৃত সংখ্যা লুকানোর কথা, মরিয়া হয়ে চিকিৎসা আর ওষুধের খোঁজ, সামাজিক দূরত্ব, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের কথা।

এই করোনার দিনগুলোতে ঘটনা একই ঘটছে। কিন্তু আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি। হয়তো পারব না–ও কোনোদিন। ইতিহাস আরও বলে, মহামারি একদিন থেমে যাবে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ডুফো, পিপস কিংবা কামুর লেখাগুলো কিন্তু সেটাই বলছে। তাই একসময় করোনাও হয়তো থেমে যাবে। আর আমরা হয়তো সেই আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাব। আমরা মনে করব আমরা বেঁচে গেছি। ধীরে ধীরে ভুলে যাব কোভিড-১৯–এর কথা।

গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের লেখায় আমরা মহামারির বর্ণনা দেখি। তাঁর লেখায় আমরা দেখি খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ সালে পেলোপনোশিয়ান যুদ্ধ চলাকালে প্রাণঘাতী প্লেগ মহামারির কারণে এথেন্সের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ লোক মারা যান। কিন্তু মহামারির কারণে যুদ্ধ থেমে থাকেনি। এবং মহামারির পর যুদ্ধ চলতে থাকে। একই রকমভাবে, আমরাও হয়তো করোনা শেষ হয়ে গেলে মহামারির কথা ভুলে গিয়ে সেই পুঁজিবাদ, পপুলিজম আর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ব।

* লেখক: ব্যাংকার, আম্বরখানা, সিলেট।