করোনায় সচেতনতা বনাম মানবিকতা-অমানবিকতা

ছবিটি প্রতীকী।
ছবিটি প্রতীকী।

বিশ্বজুড়ে আজ করোনা মহামারি হঠাৎ পরিবর্তিত জীবনে সচেতনতা ও মানবিকতার মাঝে এক দ্বন্দ্ব ঢুকে গেছে। কখনো তা সূক্ষ কখনো তা বাস্তবতার দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। মানবিকতা বজায় রেখে সচেতন হওয়া আর অতি সচেতনতার নামে অমানবিক হওয়া—দুটো বিষয় পরস্পর মুখোমুখি আজ।

সবাই জানি, এই ছোঁয়াচে রোগ থেকে রক্ষার মন্ত্র হলো সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক ব্যবহার আর ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা। এই যে সবার মুখে মাস্ক, দূরে থাকার চেষ্টা, তা সচেতনতা থেকে। আর এই সচেতনতার জন্য দরকার প্রকৃত জ্ঞান। এই ছোঁয়াচে রোগ এক ক্ষুদ্র ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায়। একজনের হাঁচি–কাশি বা সংস্পর্শ থেকে অন্যজন আক্রান্ত হতে পারে। আর তা জানি বলেই এ সতর্কতা ও পদক্ষেপ নেওয়া।

আর কেউ যদি তা বুঝতে বা মানতে না চা,য় সে কখনো সচেতন হবে না। গোঁড়ামি, অন্ধত্ব, মিথ্যা, বানোয়াট তথ্য সামাজিক বিপদ বাড়ায় বহু গুণ। জন্ম নেয় অসচেতনতা, অতি সচেতনতা, অমানবিকতা ও বিবেকহীনতা। তখনই ঘটে নানা অমানবিক ঘটনা।

নিশ্চয়ই মনে আছে, কিছুদিন আগে করোনায় আক্রান্ত ধারণায় অসুস্থ মাকে তার ছেলেরা শফিপুরের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল! প্রশাসনের লোকজন তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এবং সেই মায়ের করোনা টেস্ট নেগেটিভ এসেছিল।

করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে আরেক প্রতিবন্ধী মহিলাকে পরিবারের সদস্যরা আইসোলেশনের নামে খেতের ঝুপড়িতে অনাহারে রেখেছিল।

এই দুঃসময়ে কিছু বাড়িওয়ালা স্বাস্থ্যকর্মী ভাড়াটিয়াদের বাসায় ঢুকতে দিতে চাইছেন না বা নোটিশ দিয়ে দিচ্ছেন। কিছু প্রতিবেশী করছে অমানবিক আচরণ, অত্যাচার, ঘৃণা। এই তো সেদিন এক স্বাস্থ্যকর্মীর বাসায় সারা রাত ঢিল ছুড়ে পরিবারসহ তাঁকে এলাকা ছাড়ানোর চেস্টা করেছিল।

ছবিটি প্রতীকী।
ছবিটি প্রতীকী।

ইদানীং হাসপাতালে বাবার লাশ রেখে ছেলেরা পালিয়ে যাচ্ছে। রাতের গভীরে নাম–পরিচয়হীন লাশ রাস্তায় পড়ে থাকছে। জানাজায় বা দাফনে আপনজন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। খবরের বাইরে আছে এমন বহু খবর।

তাহলে কি এসব ঘটনা প্রমাণ করে যে করোনা মহামারি আমাদের অমানবিক করে তুলছে? অথবা আমরা আসলেই অমানবিক জাতি!

অবশ্যই না, কক্ষনো না!

যারা এ আচরণ করছে, তাদেরও আছে স্বপক্ষ যুক্তি। তারা নিজের ও পরিবারের সুরক্ষায় শঙ্কিত হয়েই এসব করেছে। এই ঘটনাগুলোর পেছনে কাজ করেছে অতি সচেতনতা বা অসচেতনতা। আর এর জন্য দায়ী অজ্ঞানতা।

কত মহামারি গেছে, যুদ্ধ গেছে এ দেশে। সবাই সবাইকে আঁকড়ে ধরে বেঁচেছে, মরেছে। এই আমরা আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশীর মৃত্যু বা অসুখের খবর শুনলেই ছুটে যাই। হাসপাতালে স্বজন ও দর্শনার্থীদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। লাশবাহী গাড়ি, জানাজার মাঠে জায়গা পাওয়া যায় না। কেননা আমরা হচ্ছি সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, বিরহে ‘মরি বাঁচি একসাথে’—এই মন্ত্রব্রতে দীক্ষিত জাতি।

কিন্তু সম্প্রতি সামাজিক দূরত্বের নামে যে অমানবিকতা হচ্ছে, এর পেছনে উতকণ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে অজ্ঞানতা। জানতে হবে, সর্দি–কাশি মানেই করোনা রোগ নয়। আর তা যদি হয়েই থাকে, তবে তার উপসর্গ অনুযায়ী ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে আইসোলেশন বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

লাশের জানাজা বা দাফনে শরিক না হওয়ার তেমন যুক্তি নেই। করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে করোনা ছড়ায় বলে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বলা হয়, মারা যাওয়ার তিন ঘণ্টা পর্যন্ত মৃতদেহের নাক বা মুখের নিঃসরণ বা সিক্রেশনে এই ভাইরাস থাকতে পারে। তবে উপযুক্ত প্রটেকশন নিয়ে লাশ ধুলে বা দাফন করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাই আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম নামের প্রতিষ্ঠানের যেসব স্বেচ্ছাসেবী দল করোনা রোগীর লাশ বহন করা, জানাজা, দাফন ইত্যাদি করে আসছে; তারা কেউ এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়নি।

সামাজিক দূরত্ব মানে সম্পর্কের দূরত্ব নয়, বন্ধনের দূরত্ব নয়। দায়িত্ব বা ভালোবাসার দায় থেকে সরে আসা নয়। বিশেষজ্ঞ কর্তৃক নিয়ম ও রাষ্ট্রনীতির ওপর আস্থা রেখে কিছুদিনের জন্য সহনশীল হতে হবে সবাইকে। নির্ধারিত শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সবার পাশে থাকতে হবে। ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। চলুন ঘরে থেকে সুস্বাস্থ্য, সৃজনশীল এবং মানবিকতার চর্চা করি।

ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সচেতনতা ছাড়াও সামাজিকভাবে সচেতন হতে হবে। করোনা প্যানডেমিক যখন ছড়াতে শুরু করেছে, দেখা গেল অনেক দেশে মাস্ক, গ্লাভস, হ্যান্ড স্যনিটাইজার, চাল, ডাল ইত্যাদি কিনে লোকজন ঘর ভর্তি করে ফেলছে। দোকান বা স্টোরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। আমরা একবারও ভাবলাম না অন্যের প্রয়োজনের কথা। যিনি হয়তো অবশিষ্ট এক টুকরো রুটি নিয়ে বাসায় ফিরতে পারবেন না। এটা শুধু অমানবিকতা নয়, স্বার্থপরতা। নিজে বাঁচার চিন্তা। আমাদের দেশেও যখন এমন ঘটনা ঘটেছে। মনে পড়ছিল এই দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে নিজের খাবার, নিজের ঘর, বিছানা ভাগাভাগি করেছে দীর্ঘ ৯ মাস।

সামাজিক অতি সচেতনতার আরেকটি উদাহরণ দিই। চীনের উহানে করোনা রোগটি মাত্র ধরা পড়েছে। তখনই এখানে সেখানে যত্রতত্র প্রয়োজন ছাড়া মাস্ক ব্যবহার শুরু হয়ে গেল। ফলাফল হলো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো। আর সত্যিই যখন দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হলো তখন মাস্ক দুষ্প্রাপ্য ও উচ্চমূল্যের হয়ে গেল। আর পুদিনাপাতা, কালোজিরা, লেবু নিয়ে অবৈজ্ঞানিক অপপ্রচারের প্রভাব বাজার থেকে ঘরে কেমন পড়েছিল, তা তো সবারই জানা।

এসব জাতীয় দুর্যোগে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে সঠিক তথ্য জেনে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়াটা জরুরি। উপসর্গহীন করোনাভাইরাস বহনকারী সদস্যকে ঘরের মধ্যেই আলাদা রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে নিজে ও পরিবারের সব সদস্যকে। সবাই দায়িত্ববান ও সহানুভূতিশীল হলে হোম কোয়ারেন্টিন নিরাপদ হবে। প্রতিবেশী যদি করোনায় আক্রান্ত হয়, তবে তাকে অচ্ছুত ভাবার কিছু নেই। তার সংস্পর্শে না গিয়ে ফোনে খবর নেওয়া, নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে খাবার সরবরাহ করে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করতেই পারি।

এবার কোভিড–১৯ রোগ ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসা প্রসঙ্গে আসি। আপনি আপনার নাগরিক অধিকার বা সচেতনতা থেকে চিকিৎসা, চিকিৎসক, সার্বিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন, ক্ষোভ, দুঃখ, অভিযোগ করতেই পারেন। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে, বিশ্বের শক্তিশালী ধনী অল্প জনসংখ্যার দেশগুলো যেখানে করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র সীমিত সম্পদের বাংলাদেশ এ প্রক্রিয়ার মধ্যে আসতে একটু সময় নেবে বা সাময়িক জটিলতার সৃষ্টি হতেই পারে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

তারপরও ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার’। এ দেশের সম্মুখযোদ্ধারা উপযুক্ত মাস্ক, পিপিই ছাড়া লড়ে যাচ্ছে অক্লান্ত। শুধু দায়িত্ব পালনের জন্যই কি তারা নিজের জীবন তুচ্ছ করে এই যুদ্ধে নেমেছে? অবশ্যই না। যদি তাদের মানবিক বোধ না থাকত, তাহলে এভাবে নিজেকে, পরিবারকে তারা ঝুঁকিতে ফেলত না। আর এর ফলে বহু চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবী, পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মী আজ করোনায় আক্রান্ত। অনেকেই ঝরে গেছে অকালে। এমন চলতে থাকলে হাসপাতালের বিল্ডিং থাকবে, চিকিৎসাসরঞ্জাম থাকবে; কিন্তু আপনাকে চিকিৎসা বা সেবা দেওয়ার লোক থাকবে না। তাই যদি চেতনা থাকে, বোধ, বিবেক থাকে; তাহলে দোষারোপ নয়, তাদের ত্যাগকে, কর্মকে প্রশংসা করুন, কৃতজ্ঞ থাকুন।

আরও একটা অভিযোগ আছে যে এই লকডাউনে ডাক্তাররা প্রাইভেট চেম্বারে বসছে না। আপনি কি জানেন, বহু ডাক্তার এই প্র্যাকটিস করেই তাদের বাড়িভাড়া, পরিবার, সংসার, সন্তানের ব্যয় নির্বাহ করে? তাহলে কেন একজন সক্ষম মানুষ নিজের উপার্জন বন্ধ করে দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকবে? সে কি শুধু নিজের সুরক্ষার জন্য? অবশ্যই নয়। সে একজন সমাজসচেতন বলেই এখন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করাকে উৎসাহিত করছে না। বিভিন্ন রোগী বিভিন্ন জায়গা থেকে যখন ডাক্তার দেখাতে আসে, তখন কে এই ভাইরাস বহনকারী অথবা কে নয়, তা জানার উপায় থাকে না। অনেকে আবার সত্য লুকিয়ে মিথ্যা তথ্য দেয়।

আপনি ডাক্তার দেখাতে এসে করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন পথে, ট্রেনে, বাসে, হাসপাতালের রোগীদের বসার স্থানে, প্যাথলজিতে রক্ত দেওয়ার সময়, এক্স-রে রুমে ইত্যাদিতে। নিজেকে পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে ডাক্তার আপনাকে দেখে দেবে। কিন্তু রোগী ও রোগীর সঙ্গের দর্শনার্থীদের করোনাভাইরাসের সম্ভাবনা ডাক্তারের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। তাই ডাক্তাররা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সচেতনতা থেকেই চেম্বারে জরুরি রোগী ছাড়া সাধারণ রোগী দেখাকে উৎসাহিত করছে না। এখানে সমঝোতা করতে হয়েছে মানবিকতার সঙ্গে সচেতনতাকে।

সবশেষে বর্তমান ঘরবন্দী জীবনে দৈনন্দিন সাধারণ কিছু কথা! হোটেল, মার্কেট যা–ই খুলে দেওয়া হোক, তা নিজেরা এড়িয়ে চলি। বেঁচে থাকলে অনেক ঈদ আসবে, হোটেলের খাবার অনেক খাওয়া যাবে। সচেতন হই নিজেদের স্বার্থে, তা সরকার যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন!

সেদিন খবরে শুনছিলাম, বর্তমান পরিস্থিতিতে ওয়াসার পানির ব্যবহার অন্য সময়ের চেয়ে তিন গুণ বেড়ে গেছে। এ–ও এক অশনিসংকেত। ভাবুন তো, ঘরে আছেন কিন্তু পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ নেই; তাহলে কী হবে? আসুন এসব ব্যবহারে সাশ্রয়ী হই।

চলুন অভ্যস্ত হই সীমিত খাওয়া, সম্পদের সীমিত ব্যবহারে। তা না হলে করোনা–পরবর্তী দুর্ভিক্ষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে এসব সমস্যা আমাদের জীবনকে এমন কোনো অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে, তা হয়তো এখন চিন্তা করতে পারছি না।

সচেতনতা ও মানবিকতা একসঙ্গে যদি থাকে, তাহলে কি করোনার সাধ্য আছে আমাদের পরাজিত করার!

আসুন সচেতন হই। আসুন মানবিক হই।

*লেখক: চিকিৎসক, সেগুনবাগিচা, ঢাকা