পিপিই বৃত্তান্ত

প্রায় দুই মাস ধরে আমাদের দেশে একটি বহুল চর্চিত শব্দ হচ্ছে ‘পিপিই’। মূলত দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর থেকে দেশজুড়ে এই শব্দটির চর্চা বেড়েছে। শব্দটি ছড়া, কবিতা এবং কার্টুনের মাধ্যমে ঢুকে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এর আগে অনেকে হয়তো এই শব্দটি ভাসা–ভাসা জানতেন; আবার অনেকের কাছেই এটি সম্পূর্ণ নতুন একটি শব্দ। তবে কিছু কিছু পেশার মানুষ আগে থেকেই এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত।

‘পিপিই’ বলতে আসলে ‘পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট’কে বোঝায়। সাধারণ ভাষায় কর্মক্ষেত্রে অথবা ব্যক্তিজীবনে বিভিন্ন স্বাস্থ্যজনিত ক্ষতি থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আমরা বিশেষ যেসব পোশাক বা সরঞ্জাম পরিধান করি, সেগুলোকেই সংক্ষেপে ‘পিপিই’ বলে।

যেমন ধরুন একজন শল্য চিকিৎসকের গায়ে গাউন, হাতে সারজিক্যাল গ্লোভস, মুখে সারজিক্যাল মাস্ক, চোখে গগলস; একজন নাবিকের পিপিই হতে পারে তার লাইফ জ্যাকেট এবং মাথার হেলমেট; একজন পুলিশের হয়তোবা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, পায়ে বুট এবং গায়ে অন্যান্য প্রটেক্টিভ গিয়ার; কনস্ট্রাকশনে কাজ করা প্রকৌশলীর জন্য মাথার হেলমেট, চোখে গগলস, পায়ে মেটাল বসানো বুট, গায়ে রঙিন উইন্ড ব্রেকার, ল্যাবরেটরিতে কাজ করা কোনো গবেষকের গায়ে অ্যাপ্রোন, হাতে গ্লোভস, পায়ে জুতা এবং চোখে গগলস ইত্যাদি। এই সবই ‘পিপিই’। সুতরাং আপনি যদি ভবিষ্যতে কোনো দোকানে গিয়ে দোকানিকে একটি ‘পিপিই’ দিতে বলেন এবং দোকানি যদি আপনাকে একটি রেইনকোট ধরিয়ে দেন, তাতে দোষ হবে না; এই বৃষ্টির মৌসুমে রেইনকোটের চেয়ে বড় ‘পিপিই’ আর কি হতে পারে। আপনার প্রয়োজনীয় পিপিই পেতে হলে আপনাকে আগে জানতে হবে আপনার জন্য কোন পিপিই অধিক কার্যকরী এবং প্রযোজ্য।

আবার কিছু কিছু পিপিই পরিধান এবং ব্যবহারের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। যেমন একজন ডুবুরির পিপিই অথবা একজন বোমা নিষ্ক্রিয়কারকের পিপিই অথবা যিনি সংক্রামক অণুজীব নিয়ে কাজ করছেন, তার পিপিই। এই বিশেষ ধরনের পিপিই পরে কাজ করতে যেমন বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়, তেমনি সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকলে এই পিপিই হতে পারে আপনার স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। এ ছাড়া পিপিই পরিধানের আগে ফিট টেস্ট খুব প্রয়োজনীয়। ফিট টেস্টের মাধ্যমে পিপিই আপনার শরীরে সঠিকভাবে ফিট হচ্ছে কি না, সেটা দেখে নেওয়া।

দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের পর থেকে একটি বিশেষ ধরনের পিপিই প্রচণ্ডভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেটা দেখতে অনেকটা স্পেসস্যুটের মতো। ছেলে-বুড়ো, ধনী-গরিব, পেশাজীবী-বেকার সবাই এই বিশেষ পিপিই পরে হাসপাতালে যাচ্ছেন, অফিসে যাচ্ছেন, বাজারে যাচ্ছেন, চায়ের স্টলে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছেন, সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দিচ্ছেন। এটা পরে থাকতে যে খুব আরামদায়ক তাও নয়, আবার দামটাও কিছুটা বেশি। এত রকমের পিপিইর মধ্যে এই বিশেষ পিপিইটাই কেন এত জনপ্রিয় হলো, সেটা আসলেই গবেষণার বিষয় হতে পারে। একটা বিশেষ কারণ হতে পারে সায়েন্সফিকশন মুভি বা টিভি সিরিজে আমরা সংকটপূর্ণ মুহূর্তে এ ধরনের পিপিইর ব্যবহার দেখতে পাই। আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, এই পিপিই পরা অবস্থায় নিজেকে কিছুটা অপরাজেয় মনে হয়। এ ছাড়া অন্য আরেকটি সম্ভাবনা রয়েছে, কয়েক বছর আগে যখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইবোলা সংক্রমণ হয়েছিল, তখন বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের এই বিশেষ পিপিই পরে থাকতে বেশি দেখা যায়।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

এই পিপিইর একটি নাম আছে এবং এর পরিধানের একটি উদ্দেশ্য আছে, যার সঙ্গে হয়তো অনেকেই পরিচিত নন। এটি একটি বিশেষ পিপিই, যেটি পরিধান, খুলে ফেলা বা সংরক্ষণে বিশেষ নিয়ম মানতে হয়। প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য সহজ নয় নিশ্চয়। এই পিপিইটি কভারওল নামে পরিচিত। অনেকেই এটাকে গাউনও বলে থাকেন; কিন্তু এটি আসলে গাউন নয়। গাউন ভিন্ন একটি পিপিই।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ সংক্রমণকালে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের কী ধরনের পিপিই পরিধান করা প্রয়োজন, তার একটি সচিত্র তালিকা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তৈরি করেছে। এই তালিকায় স্থান পেয়েছেন কোভিড-১৯–এর আক্রান্ত অথবা সন্দেহভাজন রোগীকে সেবাদানকারী চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, নমুনা সংগ্রাহক, ক্লিনার, অ্যাম্বুলেন্সচালকসহ সাধারণ মানুষ। লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, কোভিড-১৯–এর জন্য সুপারিশ করা পিপিইগুলো কিন্তু পরিধান করার বিচারে বেশ সহজ-সাধারণ। এই পিপিইগুলো সুপারিশ করা হয়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য এবং তার সংক্রমণের প্রকৃতি বিবেচনা করে। কোভিড-১৯ যেহেতু শ্বসনযন্ত্রে আক্রমণ করে, তাই মুখ, নাক এবং চোখের সুরক্ষার প্রতি বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। পিপিইগুলো এমনভাবে বাছাই করা হয়েছে যেন এটা পরিধান করা বা খুলে ফেলা তুলনামূলক সহজ হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহারকারী নিজে ক্রস কন্টামিনেটেড না হন। ‘ইবোলা’র চেয়ে ‘কোভিড-১৯’–এর পিপিইগুলো কিছুটা ভিন্ন। ‘কেন ভিন্ন’, এই ভেবে আশ্চর্য হচ্ছেন? ইবোলা এবং কোভিড-১৯–এর সংক্রমণের ধরনটাও যে ভিন্ন ছিল, তাই।

মেডিকেল এবং বায়োসেফটি বিবেচনায় বেশ কয়েক রকমের পিপিই রয়েছে। এদের মধ্যে আবার স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় পিপিইগুলোর রয়েছে বিভিন্ন মাত্রা—লেভেল-১, ২, ৩, ৪; এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য—স্টেরাইল, নন-স্টেরাইল, ডিস্পজেবল, ওয়াটার রেজিস্টেন্স ইত্যাদি। তাই ব্যবহারকারীকে অবশ্যই জানতে হবে তার কোন পিপিই প্রয়োজন এবং সেটি কোন লেভেলের এবং কোন বৈশিষ্ট্যের। ব্যাপারটি যে খুব সহজ তা নয়। বিশেষ করে পিপিই–সংক্রান্ত তথ্যবিভ্রাট, সঠিক পিপিই না থাকা, মানহীন বা নকল পিপিই সহজলভ্যতা এবং দেশে পিপিই–সংক্রান্ত নীতিমালা না থাকা ব্যাপারটিকে বেশ জটিল করে তুলেছে। আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি বাংলাদেশে ঔষধ প্রশাসন ডব্লিউএইচও, জেআইসিএ এবং ইউএসএআইডির সহযোগিতায় কোভিড-১৯ সংক্রমণকে সামনে রেখে ডব্লিউএইচও–পিএএইচওর নির্দেশিকা অনুসরণ করে পিপিই প্রস্তুত এবং বাজারজাতের নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই পিপিইর গুণগতমান নির্ধারণে বিভিন্ন প্যারামিটারের মান নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন থেকে যারা দেশে পিপিই তৈরি করবেন অথবা আমদানি করবেন, তারা এই নীতিমালা মেনে ঔষধ প্রশাসন থেকে অনাপত্তি ছাড়পত্র নিয়ে দেশে পিপিই বাজারজাত করবেন। এ ছাড়া দেশের যেসব উদ্যোক্তা বিদেশ পিপিই রপ্তানি করতে চান, তারাও এই নীতিমালার সুবিধা নিতে পারবেন। আশা করছি, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে নীতিমালাটি আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।
সবাই নিজ নিজ প্রয়োজনে সঠিক ধরন এবং মানের পিপিই খুঁজে পান এবং পরিবার–পরিজন নিয়ে নিরাপদে থাকুন, এই কামনা করছি।

লেখক: শিক্ষক, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বুয়েট।