করোনাকালে স্বাভাবিক মৃত্যুও বিড়ম্বনাময়

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনার ছোবলে সমগ্র পৃথিবী থমকে গেছে। খবর এখন একটাই তা হলো—করোনা। সমাজের নিচ থেকে উচ্চতর সব শ্রেণিই এখন করোনার আতঙ্কে ভুগছেন। সব চিন্তাভাবনা এখন করোনাকেন্দ্রিক। যেভাবে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছেন তাতে আতঙ্কিত না হওয়ার কোনো কারণ নেই।

করোনা আমাদের সবকিছু পরিবর্তন করে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে আমাদের ওপর।

আমরা সবাই একধরনের অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করেছি। সৃষ্টির সেরা জীব আমরাই বিবেক হারিয়ে ফেলছি। ধীরে ধীরে অসামাজিক হয়ে যাচ্ছি। জীবন রক্ষার তাগিদে সৌজন্যতা, ভদ্রতা, কুশলতা আমরা যেন ভুলতে বসেছি।

সামাজিকতা ভুলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছি। এ যেন এক অচেনা পৃথিবী। পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্কগুলো কেমন ফিকে হয়ে আসছে। প্রতিদিন পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক খবর দেখা যাচ্ছে, মাকে রাস্তায় ফেলে যাচ্ছেন ছেলেরা, বর আসার খবরে বউ চলে যাচ্ছে ইত্যাদি। করোনা নিয়ে মিডিয়ায় যেই ধরনের খবর প্রচার হয়েছে তাতে মানুষের আতঙ্কিত না হয়েও উপায় নেই। আর কোথাও করোনা রোগী পাওয়া গেলে কী যে অবস্থা হয়, তা বলার ভাষা নেই। করোনা রোগীরা যেন বড় অপরাধী-বড় পাপী। সমাজ তাকে প্রথমে এমনিতেই মেরে ফেলে। আর যদি কেউ করোনায় মারা যায় তাহলে তো সর্বনাশ। মৃতের লাশই দেখা যায় না ছোঁয়া তো বহু দূরের কথা। একইভাবে করোনাকালীন স্বাভাবিক মৃত্যুও এখন অনেক বিড়ম্বনার সৃষ্টি করছে।

বিগত এক মাসের ব্যবধানে দুজনকে খুব কাছ থেকে মারা যেতে দেখলাম। একজন নিকট আত্মীয় (বয়স ৪৫) ও আরেকজন প্রতিবেশী (বয়স ২২)। দুজনেই নারী। তাঁদের দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে অনেকটা হঠাৎ করে। দুটো মৃত্যুই অকালীন ও অপ্রত্যাশিত। প্রতিবেশী মেয়েটি (এলাকার ভাড়াটে) মারা যাওয়ার ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যে অনেকটা তড়িঘড়ি করে রাতের আঁধারে তাঁকে কবরস্থ করা হয়। অনেকটা কাউকে না জানিয়ে। তিন–চারজন লোক দাফনের সময় ছিলেন।

মেয়েটির পরিবার ভয়ে ছিল যে মানুষ হয়তো এটাকে করোনা ভেবে থানায় জানাতে পারে বা ঝামেলা করতে পারে। তবে মেয়েটির গায়ে জ্বর ছিল। তাই সবার সন্দেহ হয়তো করোনাতেই মারা গিয়েছে। এলাকার অনেকেই বলাবলি করতে থাকল যদি সত্যি করোনায় মারা গিয়ে থাকে তাহলে তো আমাদের সাবধান হওয়া উচিত। তাই সম্পূর্ণ ব্যাপার জানার পর আমি নিজে আইইডিসিআরের হট নম্বরে ফোন করি এবং অনেক প্রচেষ্টার পর অবশেষে তাদের পাই। তারা ঘটনা শুনে আমাকে জানায় মেয়েটির করোনা হয়নি কারণ তার বয়স কম। এই বয়সে সাধারণত করোনা হয় না। আমি তাদের জবাবে (সঠিক বললেও) সন্তুষ্ট হতে পারিনি। মনে হলো তাঁরা মুখস্থ কথা বলছেন। যাই হোক ওটা নিয়ে কেউ আর কিছু করেনি যেহেতু মেয়েটাকে কবর দেওয়া হয়ে গেছে।

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

গত ৬ মে আমার একজন নিকট আত্মীয় মারা গেছেন। তিনি আগে থেকেই বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস ছিল। কয়েক দিন ধরে হঠাৎ করে তিনি অসুস্থতা বোধ করতে থাকেন। শরীরে জ্বর আসে, কিছুটা শ্বাসকষ্টও হয়। তাঁর পরিবার ব্যাপারটা কাউকেই জানায়নি পাছে লোকজন করোনা ভেবে অনেক কিছু মনে করতে পারে। অবস্থা খারাপ দেখে অবশেষে তাঁরা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে কোনো হাসপাতালই এই রোগী ভর্তি নিতে রাজি হয়নি। সবার একটাই ভয় হয়তো করোনা রোগী। অবশেষে তাঁকে ভর্তি করানো গেল কোভিড ডেডিকেটেড কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। উনিও মারা গেলেন। তা–ও ভর্তির ৭-৮ ঘণ্টা পর। আর এতেই সবাই সন্দেহ করা শুরু করল হয়তো করোনায় মারা গেছেন। মানুষের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল যখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর লাশ রেখে দিল। হাসপাতালে মরহুমার সঙ্গে থাকা দুই ছেলে বাসায় ফিরলেন মাকে ছাড়া। তাঁদের আপাদমস্তক ঢাকা পিপিই দিয়ে। হাসপাতালের কড়াকড়ি নির্দেশে তাঁরা বাড়ি ফিরলেও সরাসরি ঘরে ঢুকলেন না, বাইরে গরম পানি ও সাবান দিয়ে গোসল করে বাড়িতে ঢুকলেন। আশপাশের সবাই এগুলো দেখে দূরে সরে যেতে লাগল। সবাই ধরেই নিল ওদের মা করোনায় মারা গেছেন। সবার আচরণ দেখে দুই ছেলে হতভম্ব হয়ে গেছে। কিসের মায়ের শোক আর কিসের কান্না, করোনার আতঙ্কই তাঁদের বেশি পর্যুদস্ত করেছে। তাঁদের মায়ের মৃত্যুর খবরেও কেউ কাছে আসেনি এতটুকুন সমবেদনা জানাতে। আশ্চর্যজনক সত্য হলো মরহুমার আপন মেয়েও কাছে আসেনি তার ভাইদের সমবেদনা জানাতে। দূর থেকে কথা বলে চলে গেছে। কী নির্মম, কী নিদারুণ পরিস্থিতি।

আমি নিজেও দুই ছেলের সঙ্গে দূর থেকে কথা বললাম এবং লক্ষ করলাম তাঁদের মুখে মায়ের সদ্য মৃত্যুর শোক অনেকটাই ম্লান। বরং ফুটে উঠেছে করোনার গুজব প্রতিহত করার বারবার প্রচেষ্টা। তাঁরা বারবার বলছেন, তাঁদের মায়ের করোনা হয়নি। কারণ তাঁর মা গত এক-দেড় মাস বাড়ির বাইরে যাননি। আবার তাঁদের কারও করোনার কোনো লক্ষণ নেই। মায়ের মৃত্যুতে তাঁরা পাথর হয়ে গেছেন ঠিকই কিন্তু করোনা তাঁদের নির্বাক থাকতে দেয়নি। শুধুই জবাবদিহি। হাসপাতাল থেকে কেন লাশ দেয়নি জিজ্ঞেস করতে দুই ভাই বললেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে তারা টেস্ট করে পরের দিন জানাবে। যদি করোনা না হয় তবে ফোন দেবে লাশ নেওয়ার জন্য আর পজিটিভ হলে তারা নিজেরাই লাশ দাফনের ব্যবস্থা করবে। এ কথা শুনে আমিও ভাবলাম হয়তো মরহুমার করোনা পজিটিভ হবে। ইতিমধ্যে এলাকায় রটে গেল ওদের মা করোনায় মারা গেছেন এবং সরকার ওদের মার লাশ দাফন করেছে। যাই হোক পরের দিন হাপাতপাতাল থেকে ফোন এল—তাঁদের মায়ের করোনা হয়নি, তাই লাশ নিয়ে যেতে বলল। হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে আসতেও পদে পদে বিড়ম্বনা। যাই হোক করোনা হয়নি শুনে তাঁদের কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন। অবশেষে হাতে গোনা ১০-১২ জনের উপস্থিতিতে মরহুমার দাফন সম্পন্ন হয়।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মৃত্যু তা যেভাবেই হোক না কেন, তা একটা মানুষের জীবনের সর্বশেষ ঘটনা। নিকট আত্মীয়েরা এ সময়ে ব্যথিত থাকেন। সমবেদনা পায়। বৈশ্বিক এ দুর্যোগে করোনাক্রান্ত হয়ে মারা গেলে আফসোসের সীমা থাকে না। এ মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো না। অথচ এভাবে মৃত্যুর পর তৈরি হয় আরও এক নির্মমতা। করোনা সতর্কতার নামে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ আর অবহেলা। উপরন্তু বিভিন্ন ধরনের গুজব তো রয়েছেই।

একইভাবে করোনাকালীন স্বাভাবিক মৃত্যুও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। বিভিন্ন ধরনের বিড়ম্বনার সৃষ্টি হচ্ছে। করোনার পরীক্ষা নেগেটিভ না আসা পর্যন্ত চলতে থাকে এই নির্মমতা। এখন সব মৃত্যুই যেন করোনাজনিত। করোনার ভয় আর আতঙ্ক আমাদের পুরোপুরি গ্রাস করেছে। আমাদের বিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে। আমাদের ভদ্রতা, সভ্যতা আর মানবিকতার মুখোশ খুলে ফেলেছে। তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি দয়া করে আমাদের মুক্তি দিন। একটা আশু উপায় বের করে দিন করোনা থেকে বাঁচার। আমরা যে আর পারছি না।

*লেখক: মশা গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক (কীটতত্ত্ব), পবিপ্রবি, বাংলাদেশ ও ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট, এনাসটাশিয়া মসকিটো কন্ট্রোল, ফ্লোরিডা, আমেরিকা