ভীমের পান্টি কি হারিয়েই যাবে

ঐতিহাসিক ভীমের পান্টি। ছবি: লেখক
ঐতিহাসিক ভীমের পান্টি। ছবি: লেখক

অযত্ন অবহেলায় ৯ম, ১০ম বছরের ঐতিহাসিক ভীমের পান্টি। দিন দিন ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।

নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার পূর্ব প্রান্তে জয়পুরহাট জেলার সীমানা ঘেঁষে জাহানপুর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর হরগৌরী এলাকায় দেখা যায় একটি মাঝারি (বেড় ১৭০ মিটার এবং উচ্চতা ১০ মিটার) আকারের ঢিবি। সেখানে ১৪টি ছোট-বড় পুকুর রয়েছে। ধামইরহাট উপজেলা থেকে ৭-৮ কিলোমিটার পূর্বে মঙ্গলবাড়ী নামের বাজার থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দক্ষিণে মুকুন্দপুর গ্রামে হরগৌড়ি মন্দির বা ভীমের পান্টি অবস্থিত।
যুগের পর যুগ ধরে অযত্নে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ঐতিহাসিক ভীমের পান্টির ইতিহাস। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক ভীমের পান্টি।

মঙ্গলবাড়ী থেকে পাকা রাস্তাযোগে কাজীপাড়া যাওয়ার পথে ঐতিহাসিক ভীমের পান্টি পাওয়া যাবে। সেখানে পাকা রাস্তা থেকে ৪০০ মিটার ইট বিছানো আর বাকিটা মেঠো পথ দিয়ে ভ্যান, রিকশায় যেতে হয়। সেখানে চোখে পড়বে একটি পুকুর অমৃতকুণ্ড কোদালধোয়া। কথিত আছে, অমৃতকুণ্ড কোদালধোয়া পুকুরের মাঝখানে একটি সোনার লাঙল রয়েছে। এর আশপাশে পুরোনো অনেক ইটপাটকেল ও খোলাকুচির ছড়াছড়িসহ কোথাও কোথাও কাদায় গাঁথা ইটের গাঁথুনির পলেস্তরাবিহীন চিহ্ন দেখা যায়।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২০০০ বছর আগে বীরেশ্বর ব্রহ্মচারী নামের এক সাধক এ ঢিবিতে একটি কালো পাথর উৎকীর্ণ মাঝারি আকারের মূর্তি পেয়েছিলেন। তাই তিনি ওই ঢিবির ওপর ছোট আকারের চারটি মন্দির নির্মাণ করে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সে সময় ঢিবির ওপর উত্তর-পশ্চিম কোণে ২.৩৯ মিটার ও ৯১ সেন্টিমিটার পরিসরের এক কোঠাবিশিষ্ট একটি পূর্বমুখী স্থাপনা ছিল। ১৯৭৮ সালে ওই ঢিবি থেকে একটি চোকলাতলা কালো পাথরের উমা মহেশ্বর মূর্তি উদ্ধার করে তা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। ঢিবির দক্ষিণে ৫৮ সেন্টিমিটার দূরত্বে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা অনুরূপ আরও একটি ভাঙা দেয়াল ছিল। সেই দেয়ালের উচ্চতা ১.২২ মিটার। এগুলোকেই বীরেশ্বর ব্রহ্মচারীর স্মৃতিবিজড়িত নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমানে এগুলোর নিদর্শন নিশ্চিহ্ন করে সেখানে নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়। ঢিবির পাদদেশ থেকে চতুর্দিকে তাকালে দেখা যায় বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। দূরে একটি উঁচু পাড়ওয়ালা পুকুরও রয়েছে। তবে এ প্রত্নস্থলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক খণ্ড কালো পাথরের পিলার বা থাম্বা। এটির নামই ভীমের পান্টি, যা ঢিবিটি থেকে মাত্র ৮১ মিটার দক্ষিণে ফসলি জমির মাঝখানে সামান্য হেলে সম্পূর্ণ অরক্ষিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি ভীমের পান্টি আবার কেউ কেউ কৈবর্ত রাজার ভীমের লাঠি বলে থাকেন।

ভীমের লাঠিটি দেখতে অনেকটা মোচার মতো। এ থামের গা অত্যন্ত মসৃণ। পাদমূলে এর বেড় ১.৮০ মিটার, বর্তমান উচ্চতা ৩.৭৯ মিটার।

লোকমুখে শোনা যায়, অতীতে এর ওপর একটি বিষ্ণুর বাহন অর্ধ নর ও অর্ধ পাখির মূর্তি বসানো ছিল। কিন্তু বজ্রপাতের আঘাতে সেটি নিশ্চিহ্ন হওয়াসহ পিলার বা থাম্বার মূল অংশের মাঝামাঝি অর্ধেক ভেঙে গেছে। তবে অক্ষত থাকা অংশের ৫৬.৭ সেন্টিমিটার ও ৪৯.৩ সেন্টিমিটার পরিমাপের একটি চতুষ্কোণাকার ওপরের অংশে আজও ২৮ পঙক্তির একটি সংস্কৃত ভাষ্য উৎকীর্ণ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এ পিলার বা থাম্বাটি নাকি বরেন্দ্রর পাল রাজা নারায়ণ পালের মন্ত্রী ভটুগুরুভ ৮৯৬-৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এতে ওই রাজবংশসহ মিশ্র বংশপঞ্জি বর্ণিত রয়েছে। এটি দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসেন। বর্তমানে অযত্ন-অবহেলায় ৯ম, ১০ম বছরের ঐতিহাসিক ভীমের পান্টির সঠিক ইতিহাস উন্মোচন না হওয়ায় এর ইতিহাস যেমন বিলুপ্তির পথে, অন্যদিকে সরকারও বঞ্চিত হচ্ছে তার রাজস্ব আয় থেকে।

স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবা বলতেন এখানে রংপুর অথবা দিনাজপুরের কোনো এক রাজার রাজবাড়ির শাখা ছিল। তার একটা বরকন্দাজ ছিল, পাশের ওই উঁচু ঢিবিটি রাজবাড়ির মতো ছিল। সেই উঁচু ঢিবিতেই ছিল বরকন্দাজের বাসা। পাশেই তাঁদের একটি মণ্ডপ ছিল, বর্তমানে সেখানে মন্দির গড়ে ওঠে। ঐতিহাসিক ভীমের পান্টিটি ছিল তাঁদের নিশান।

ঐতিহাসিক ভীমের পান্টির এই লেখায় আসলে কী আছে, কেউ বলতে পারেন না । ছবি: লেখক
ঐতিহাসিক ভীমের পান্টির এই লেখায় আসলে কী আছে, কেউ বলতে পারেন না । ছবি: লেখক

এখানকার মানুষ এটিকে মহাদেবের ভীমের পান্টিও বলেন। ভীম রাজাদের এই নিশানের মধ্যেই অজানা অনেক ইতিহাস রয়েছে। পিলারের নিচের যে লেখাটি রয়েছে, তা আজও কেউ পড়তে পারেনি। অনেক বিদেশি লোকজন এখানে এসেছেন কিন্তু সঠিক ইতিহাস এখন পর্যন্ত কেউ বের করতে পারেননি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মজার বিষয় হচ্ছে বর্ষার মৌসুমে বিদ্যুৎ চমকালে এই নিশানের ওপরই এসে বিদ্যুৎ পড়ে। বিদ্যুৎ পড়ায় ভীমের পান্টির অর্ধেক অংশ ভেঙে ছোট হয়ে গেছে কিন্তু এর ভাঙা অংশ আজ পর্যন্ত কেউ খুঁজে পায়নি। এমনকি আমিও অনেক দেখার চেষ্টা করেছি কিন্তু পাইনি।

একদিন বর্ষায় গরু নিয়ে মাঠে যাই, হঠাৎ আকাশ খারাপ হয়ে এলে বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। মেঘের গর্জনে ভীমের পান্টির ওপর এসে বিদ্যুৎ পড়ে। বৃষ্টি থেমে গেলে এসে দেখি, ভীমের পান্টির অর্ধেক অংশ ভেঙে অনেকটা মাটির নিচে দেবে যায়। কিন্তু অবাক করার বিষয়, ভেঙে যাওয়া কোনো অংশ আমি মাটিতে পড়ে থাকতে দেখিনি। ভেঙে যাওয়া অংশ কোথায় গেল, কী হলো, ঘটনাটি আজও আমাদের কাছে অলৌকিক মনে হয়।’ ইতিহাসের সাক্ষী ভীমের পান্টিকে নিয়ে এমন অনেক অজানা ইতিহাস রয়েছে যা অনাবিষ্কৃতই থেকে গেছে।

বড় শিবপুর দিঘিপাড়ার বাসিন্দা যোগেন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় বাপ-দাদারা বলতেন, একসময় এখানে জোদ্দার ভীম হাল চাষ করতেন। একদিন ভীমের পিপাসা লাগলে সে তার হাতে থাকা গরু খেদার লাঠিটি মাটিতে পুঁতে রেখে পানি খেতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখে মাটিতে পুঁতে রাখা লাঠিটি বিশাল আকৃতির পিলার বা খুঁটির রূপ ধারণ করে। এই পিলারে অনেক চৌম্বকশক্তি আছে, যার ইতিহাস এখনো অনাবিষ্কৃত। সরকারের উদ্যোগে ভীমের পান্টির সঠিক ইতিহাস আর পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করা হলে এলাকার সঙ্গে সঙ্গে সরকারও লাভবান হবে।’