সারির নীল পানিতে একদিন

প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি লালাখাল। ছবি: লেখক
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি লালাখাল। ছবি: লেখক

সকাল থেকেই ঝুম বৃষ্টি। সব প্লান ভেস্তে গেল ভেবে মন খারাপ। কিন্তু যেতে যে হবেই। কারণ, যাওয়ার জন্য আগে থেকেই সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করা হয়েছে। মাঝখানে এই বৃষ্টি বাগড়া দিল।

যা-ই হোক, ঘড়িতে তখন দুপুর সাড়ে ১২টা। বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে গেল। সেই সুযোগে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের অটোরিকশা ছুটে চলেছে সামনের দিকে—গন্তব্য লালাখাল, সিলেট। কখনো হালকা বা মাঝারি বৃষ্টি, আবার কখনো রোদ্দুর—এমন আবহাওয়া মন্দ লাগছিল না। সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখালে স্বচ্ছ নীল পানির নদী ‘সারি’। সারি নদী দেখার জন্যই আমাদের ছুটে চলা। সঙ্গে আমার বন্ধু সৌরভ।

রওনা দেওয়ার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর যখন লালাখালে এসে পৌঁছালাম, তখন বৃষ্টি আর নেই। কিন্তু হাঁটার সামান্য রাস্তা কাদায় একেবারে বেহাল। কাদা মাড়িয়ে যখন সারি নদীর প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম, তখন উঁচু থেকে নদীকে দেখে মনে হচ্ছিল, ফিরোজা রঙের শাড়ি পরা এক ষোড়শী বাতাসে আঁচল মেলে দিয়েছে। নদীপাড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো যেন আমাকে তাদের রাজ্যে স্বাগত জানাচ্ছে। মনটা উদাস হয়ে গেল। ইচ্ছে হচ্ছিল তাদের সঙ্গে গাছ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে কালের সাক্ষী হয়ে যাই, নতুবা ফিরোজা শাড়ির ওই আঁচলের নিচে ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিই।

প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি লালাখাল। প্রকৃতিকে একান্তে অনুভব করে শীতল হতে লালাখালের জুড়ি মেলা ভার। এই নদীর গা ঘেঁষে উঁচু-নিচু পাহাড়। পাহাড়ে ঘন সবুজ বন, পাখ-পাখালি। এক কথায় নদী, পাখ-পাখালি ও নানা জাতের বৃক্ষের সমাহার লালাখালজুড়ে। নীল পানি আর প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া এখানকার মানুষের জীবনযাত্রাও চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া বাড়তি পাওনা আদিবাসীদের সঙ্গে ভাব জমানোর সুযোগ!

নদীর গা ঘেঁষে উঁচু-নিচু পাহাড়। পাহাড়ে ঘন সবুজ বন, পাখ-পাখালি। ছবি: লেখক
নদীর গা ঘেঁষে উঁচু-নিচু পাহাড়। পাহাড়ে ঘন সবুজ বন, পাখ-পাখালি। ছবি: লেখক

ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই লালাখালের অবস্থান। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই সারি নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। যা-ই হোক, সৌরভের ডাকে জগতে ফিরে এলাম। নিচে সারি সারি নৌকা নদীর ঘাটে বেঁধে মাঝিরা খোশগল্পে ব্যস্ত। আমাদের দেখেই তাঁদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এল। হাঁকডাক শুরু করে দিলেন। আমরাও বেশ দামদর শুরু করে দিলাম। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। তাঁরা সবাই একজোট।

ছোট-বড় যে নৌকাতেই যান না কেন, ঘণ্টায় ৬০০ টাকা। অগত্যা রাজি হলাম। এখানকার নৌকাগুলোও যেন ছবির মতো সুন্দর। ইঞ্জিনচালিত এসব নৌকায় আছে রঙিন ছাউনি। রোদ বা হালকা বৃষ্টি আটকাবে। আমরা নৌকায় উঠতেই আবারও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। হালকা বৃষ্টির শব্দে নদীর পানিতে তখন এক মোহনীয় আমেজ। এরই মধ্যেই চলছে আমাদের নৌকা। সারির নীল পানি ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। নৌপথে যেতে যেতে যেদিকে চোখ যায়, মুগ্ধতায় মনজুড়ে নেমে আসে মগ্নতা। এমন অবস্থায় আপনি কিছুক্ষণের জন্য হলেও কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাবেন, এটা নিশ্চিত।

নৌকা একটু একটু করে এগোচ্ছে আর মনে হচ্ছে নতুন একটা অধ্যায়ে প্রবেশ করছি। নদীর দুই পাড়ে বাড়িঘর তেমন নেই। শুধু আছে হরেক রকমের গাছপালা। যেন চারপাশে সবুজের হাতছানি। মাঝেমধ্যে কাশবনের ঝোপ চোখে পড়ে। তবে নদীতে অসংখ্য বাঁকের দেখা মেলে। প্রতিটি বাঁকই দেখার মতো সুন্দর। প্রকৃতির সৌন্দর্য কতটা নিখুঁত আর প্রাণবন্ত হতে পারে তা সারির দুপাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য না দেখলে বোঝানো যাবে না।

নৌকাগুলোও যেন ছবির মতো সুন্দর। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় আছে রঙিন ছাউনি। ছবি: লেখক
নৌকাগুলোও যেন ছবির মতো সুন্দর। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় আছে রঙিন ছাউনি। ছবি: লেখক

লক্ষ করলাম, সারির গভীরতা যেখানে একটু বেশি সেখানকার পানির রং গাঢ়। যেখানে পানি কম, সেখানে রং হালকা নীল। নদীর একেবারে তলার বালুকণাও খালি চোখে দেখা যায়। নদীপাড়ের মানুষের জীবনে কতই না ছন্দ-বৈচিত্র্যময়। দুপুরের এই সময়টাতেও তাদের কাজের বিশ্রাম নেই। সকালের নানা কাজ শেষে এই সময় অনেক রমণী সারির নদীতে গোসল সেরে নেন। এ যেন আমাদের চিরচেনা বাংলার আবহমান রূপ। এই যে সারি, আর একে ঘিরে যে কত মানুষের জীবন আর জীবিকা, বলা ভার। এ অঞ্চলের স্থানীয় জনগণ অনেক পরিশ্রমী। নৌকায় বসে দেখলাম কেউ কেউ কয়লা সংগ্রহ করছেন, আবার কেউ পানির মধ্যে ডুব দিয়ে বালি তুলছেন, কেউ নৌকা নিয়ে যাচ্ছেন সারিঘাটে। এখানে শীতকালে প্রচুর পরিমাণে সবজির উৎপাদন হয়। এর মধ্যে আছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো ও শিম। এখানে প্রচুর শিম উৎপন্ন হয়। নদীর জলে নৌকার ওপর বসে এসব দেখার মজাই আলাদা।

প্রায় মিনিট বিশেক পর আমরা লালাখাল জিরো পয়েন্টে এসে পৌঁছালাম। জায়গাটা কিছুটা নির্জন। কয়েকজন স্কুল বা কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়ে আর একজন নারী দোকানি ছাড়া আর তেমন কেউ নেই। এখানে পানি তেমন নেই বললেই চলে। নদী শুকিয়ে ছোট হতে হতে একপাশ দিয়ে সামান্য অংশে বয়ে চলেছে। সেখানে দুই চারটা ডিঙিতে মাঝিরা বালু তুলছেন। এদিক-ওদিক তাকানোর সময় তাঁদের নেই। মাথার ওপর তখন সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে। শুকিয়ে যাওয়া নদীর বালু তাই বেশ তপ্ত। আমরা সেই তপ্ত বালুতে পা ডুবিয়ে দ্রুত সামনে এগোতে থাকলাম। একটু এগোতেই সামনে এক সুন্দর বাঁক। বাঁকের পাশ দিয়ে সামনে যত দূর চোখ যায়, সারি নদী। নদী থেকে দূরে পাহাড় দেখা যায়। দেখলে যতটা কাছে মনে হয়, আসলে ততটা কাছে না। পাহাড়গুলো দেখলে মনে হয়, কেউ যেন নিজ হাতে থরে থরে একটির পর একটি করে সাজিয়ে রেখেছে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে লেগে আছে মেঘ। বাতাসে মেঘ ভেসে ভেসে এসে আবার পাহাড়ে জমা হয়। একটু চোখ মেলে দেখলে বোঝা যায়, মেঘেরা দল বেঁধে পাহাড়ের গায়ে ঠেস লাগিয়ে থেমে থাকে। আবার কখনো দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে যায়। মনে হয়, নীল সারির ওপর ধূসর মেঘ আর সবুজ পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা চলছে। কখনো মেঘ বেশি জমা হলে এখানে বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়।

লেখক।
লেখক।

লালাখালের এই জিরো পয়েন্টে রয়েছে সুন্দর এক চা-বাগানসহ ফ্যাক্টরি। কাছেই আছে সুপারিবাগান। সময় স্বল্পতার কারণে আমরা আর সুপারি বাগানে যেতে পারিনি। বাগানের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ আপনাকে নিয়ে যাবে অচেনা এক দেশে। একটু এগোলেই ওপারে ভারতের সীমান্ত আপনাকে জানিয়ে দেবে, আর এগোনোর পথ নেই। চা-বাগান কিছুটা ঘুরে দেখতেই আকাশ নিকষ কালো মেঘে ঢেকে গেল। বৃষ্টি আসবে এই শঙ্কায় আমরা জলদি নৌকায় ফিরলাম।

ফেরার পথে মনে হলো, সারি ও এর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এখানকার মানুষ একটু বেশিই উদাসীন। সেই সঙ্গে এখানে যাঁরা ঘুরতে আসেন তাঁরাও পরিবেশসচেতন নন। সারির ওপর ভেসে চলা ইঞ্জিনচালিত নৌকা, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট এসবের প্রমাণ দিচ্ছে। তা ছাড়া সরকারের নীতিমালারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে মনে হলো। এসব কারণে সারির উদ্ভিদবৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। এ ছাড়া অনুমোদনহীনভাবে পাথর উত্তোলন নদী এবং নদী অববাহিকার ভূমিকে দিন দিন আরও হুমকিতে ফেলছে।

যেভাবে যাবেন
সিলেট আর জাফলংয়ের মাঝামাঝি সারিঘাট। লালাখালে যেতে হলে সিলেটের শিশুপার্কের সামনে থেকে লেগুনা অথবা জাফলংয়ের বাসে চেপে সিলেট-তামাবিল সড়ক ধরে যেতে হবে সারিঘাট। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া নিতে পারেন। নৌপথে যেতে চাইলে আগে সারিঘাট পর্যন্ত একই নিয়মে বাস বা লেগুনায় গিয়ে নৌযান ভাড়া নিতে হবে। ফেরার পথে এখান থেকে বাসে কিংবা লেগুনায় আসতে পারবেন। রাত আটটা পর্যন্ত যানবাহন পাওয়া যাবে। দল বেঁধে গেলে সুবিধা বেশি, কারণ নৌকা ভাড়াটা কমে যায়। ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করা যায় এবং সবাই মিলে হইচই করে আনন্দ ভাগাভাগি করা যায়। লালাখালে একটিমাত্র রিসোর্ট রয়েছে। তাই আগে থেকে বুকিং না দিলে জায়গা পাওয়া কঠিন। এ ছাড়া সিলেট শহরে রাত যাপন করে এক দিনেও লালাখাল ঘুরে আসতে পারেন অনায়াসে। অথবা সকালে বিছনাকান্দি হয়ে বিকেলে লালাখাল ঘুরতে পারেন। সন্ধ্যার দিকে নদীতে কোনো নৌকা থাকে না। তাই ভ্রমণ বা ঘোরাঘুরি সন্ধ্যার আগেই শেষ করতে হবে।

দেখে মনে হয় ফিরোজা রঙের শাড়ি পরা ষোড়শী বাতাসে আঁচল মেলে দিয়েছে। ছবি: লেখক
দেখে মনে হয় ফিরোজা রঙের শাড়ি পরা ষোড়শী বাতাসে আঁচল মেলে দিয়েছে। ছবি: লেখক

খরচাপাতি
সড়কপথে যেতে বেশি লোক হলে মাইক্রো বাস ভাড়া করলে খরচ কম হবে। সিলেট শহর থেকে শুধু লালাখালের জন্য মাইক্রো বাস ভাড়া ২ থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে পাবেন। প্রাইভেট কার নিলে ভাড়া দেড় থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে। বাস কিংবা লেগুনায় ৪০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে সারিঘাট যেতে পারবেন। সেখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা আর স্পিডবোটে যেতে চাইলে ভাড়া দেড় থেকে ২ হাজার টাকার মধ্যে হতে পারে। নৌযানে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে, ভাড়া একই।

সাবধানতা
ভ্রমণে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের জন্য দুর্ঘটনা এড়ানো প্রয়োজন। অদ্ভুত নীল পানি আর ঘন জঙ্গলবেষ্টিত লালাখালে গেলে তাই চাই বাড়তি সতর্কতা। পানিতে নামার সময় পানির গভীরতা খেয়াল রাখবেন। প্রয়োজনে গাইড কিংবা সঙ্গে যাওয়া কারও পরামর্শ নিন।