প্রিয় আনিসুজ্জামান স্যার: যে কষ্ট আমায় বইতে হবে

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ফাইল ছবি
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ফাইল ছবি

শৈশব থেকেই তাঁকে দেখছি। দীর্ঘদেহী, সৌম্য দর্শন একজন মানুষ। পাঞ্জাবি আর ঢোলা পাজামায় একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কী দারুণ জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর। প্রতিটি কথায় সব সময় যেন প্রজ্ঞা, জ্ঞান আর বিনয় মিশে থাকে। তিনি আমার বাবার শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান। আমার বাবা তাঁকে স্যার ডাকেন।

আমিও তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি কত বড় মানুষ, তা ভালোভাবে বোঝার আগে থেকেই তাঁকে স্যার বলে ডাকি। পারিবারিক ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের কারণে চাচা ডাকার সুযোগ থাকলেও কখনো স্যার বাদে অন্য সংবোধন মুখ থেকে বের হয়নি।

আমার বাবা ড. মাহবুবুল হক নিজেও বাংলাদেশের একজন ভাষা গবেষক। তাই তাঁর সঙ্গে আনিসুজ্জামান স্যারের যোগাযোগটা শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ক ছাড়িয়ে জীবনভর বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের উন্নয়নে কাজ করে যাওয়ার এক অনন্য সংকল্পে আবদ্ধ। সারা বছর নানা কাজের প্রয়োজনে তাঁদের দেখাসাক্ষাৎ, আলাপ-আলোচনা হয়। ছোটকাল থেকেই আমি তাই শুধু স্যার নন, বরং চাচি এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদেরও দেখেছি। আমরা স্যারের বাসায় গেছি। তাঁরা আমাদের বাসায় এসেছেন। যদিও স্যাররা ঢাকায় আর আমরা চট্টগ্রামে থাকার কারণে এই সুযোগগুলো কম হতো, তবে এখনো মনে পরে একবার স্যার পুরো পরিবারসহ কক্সবাজার যাওয়ার পথে হুট করে চট্টগ্রামে আমাদের বাসায় যাত্রাবিরতি নিলেন। বহু বছর পর হঠাৎ আমাদের বাসায় আনিস স্যার এসেছেন, তাও পুরো পরিবার নিয়ে, কী দারুণ ব্যাপার! আমরা খুব এক্সাইটেড হয়েছিলাম।

ব্যক্তিগতভাবে আমি শৈশব থেকে আনিসুজ্জামান স্যারের স্নেহধন্য। শুধু প্রিয় ছাত্রের মেয়ে বলে নয়, তিনি আমাকে ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও ভালোবাসতেন। আমার সাফল্যে আনন্দিত হতেন। তাঁর স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যের কারণে সেটা প্রকাশ করতেন না, তবে ঠিকই আমি তা টের পেতাম। এটা আরও বেড়ে যায় আমি এসএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বোর্ড থেকে খুব ভালো ফলাফল নিয়ে পাস করার পর। মনে পড়ে, সে বছর প্রথম আলো পত্রিকা থেকে প্রথমবারের মতো সারা বাংলাদেশ থেকে বোর্ড স্ট্যান্ড করা শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে আমার হাতে ক্রেস্ট তুলে দিয়েছিলেন খোদ আনিসুজ্জামান স্যার। কন্যা পুরস্কার নিচ্ছে তার বাবার শিক্ষকের কাছ থেকে, বিষয়টা জানতে পেরে পুরো অডিটরিয়ামে তুমুল তালি শুরু হলো। স্যার নিজেও সেদিন খুব খুশি ছিলেন।

একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। স্যারের তখন অবসরে যাওয়ার মাত্র দুই–এক বছর বাকি। ক্লাস শুরু হওয়ার পর আমি মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। স্যার এমনিতে খুবই স্বল্পভাষী, আমাকে টুকটাক প্রশ্ন করতেন। আমি উত্তর দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। এত বড় মানুষের সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলব, তা বুঝতে পারতাম না। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন তিনি যেভাবে আমার খোঁজ রেখেছেন, তার জন্য সত্যিই আমি আজীবন কৃতজ্ঞ।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত স্যারের সঙ্গে খুব কমই দেখা হয়েছে। তিনি ঢাকায় আমার এঙ্গেজমেন্ট অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। চট্টগ্রামে আমার বিয়েতে যেতে পারেননি তবে মনে করে ঠিকই শুভাষিস পাঠিয়েছিলেন। তবে একটি বিশেষ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। তবে স্বপ্নেও ভাবিনি এই দেখা শেষ দেখা হবে!

আমি নিজেও একটুআধটু লেখালেখি করি। আমার প্রথম বই ‘মননকথা ভ্রমণগাথা’–এ বছর একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের পাণ্ডুলিপি লেখা শেষ করে গত বছরের নভেম্বর মাসে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। খুব সংকোচ নিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম বইটার মুখবন্ধ লিখে দিতে। তিনি স্নেহবশত আমাকে নিরাশ করেননি। সেদিন আমরা পুরো পরিবার মানে আব্বু-আম্মু, আমার স্বামী ও কন্যা স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম। আমরা স্যার, চাচী এবং আনন্দ ভাইয়া আর ভাইয়ার পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে বহু বছর পর খুব সুন্দর সময় কাটিয়েছি। ছবি তুলেছি।

আমার প্রথম বইয়ের মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন ড. আনিসুজ্জামান। লেখক হিসেবে এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জনই বটে! বন্ধুরা বলেছিল, ‘তুই তো পরের বইয়ের মুখবন্ধ লেখার জন্য বাংলাদেশে আর কাউকে খুঁজে পাবি না।’ তবে আফসোস, ব্যক্তিগত নানা ঝামেলার কারণে বইমেলায় প্রকাশিত আমার বইটা স্যারের হাতে তুলে দিতে পারিনি। সারা জীবন এই না পারার কষ্ট আমাকে বহন করতে হবে। বইটার মুখবন্ধ লেখা–সংক্রান্ত কারণে পরেও বেশ কয়েকবার স্যারের বাসায় গেছি। স্যার যে শারীরিকভাবে খুব সুস্থ নন, তা বেশ বোঝা যেত। এই শরীর নিয়েই তিনি নিরন্তর কাজ করে চলেছিলেন। নিয়মিত বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যেতেন। তাই এ রকম একটা সংকটকালীন এভাবে হুট করে তিনি চলে যাবেন, তা সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না।

স্যার হাসপাতালে থাকাকালীন আমরা তাঁর অবস্থার খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু লকডাউন চলার কারণে হাসপাতালে যেতে পারিনি। চাচির সঙ্গে দেখা করে পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পাইনি—এই কষ্ট আমাদের পরিবারের সবার মনে রয়ে যাবে। গত বছর নভেম্বর কি ডিসেম্বর মাসে যখন স্যারের সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়, তখন আমার আব্বু বেশ অসুস্থ ছিলেন। স্যার খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে সব সময় তাঁর প্রিয় ছাত্রের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতেন। যিনি অন্যকে এত ভালোবাসতেন, তাঁর নিজের শারীরিক অসুস্থতার সময় পরিবার ছাড়া কেউ তাঁর পাশে থাকতে পারলেন না। তাঁকে সমাধিস্থ করার সময় সারা দেশের মানুষ শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পেল না। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো তাঁকে বাংলা একাডেমি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া সম্ভব হলো না—জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য এটা সত্যিই খুব বেদনার।

তারপরও আমাদের এই কষ্ট চেপে রেখে চলমান সংকট পার করতে হবে। আনিসুজ্জামান স্যার বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের একজন যোদ্ধা ও পথপ্রদর্শক ছিলেন। তিনি ছিলেন পুরো জাতির অভিভাবক। তাঁকে ছাড়াই আমাদের করোনার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। তাঁকে হারানোর শোক তাই শক্তিতে পরিণত হোক, এটাই এখন মনে মনে কামনা করছি। আর ব্যক্তিগত কষ্টের কথা কী আর বলব, শুধু বলি, জন্মের আগেও আলো, মৃত্যুর পরেও আলো। শুধু মাঝখানের অন্ধকারটুকুর নাম জীবন। প্রিয় আনিস স্যার, আপনি এই অন্ধকারে আলোর দিশা হয়ে ছিলেন। এখন আপনি যে আলোর মাঝে আছেন, সেই আলোতে দেখা হবে আবারও। সেই অপেক্ষায় রইলাম।

*লেখক: উন্নয়নকর্মী