পানির সংকটে সাতক্ষীরার শ্যামনগর-আশাশুনির মানুষ

পানি সংগ্রহ করছেন এক নারী। ছবি: লেখক
পানি সংগ্রহ করছেন এক নারী। ছবি: লেখক

তীব্র গরমের সময় এমনিতেই পানির সংকট তার ওপর করোনা পরিস্থিতি সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলার সংকটকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। উপজেলাগুলোর অনেক জায়গার মানুষ পানি আনতে বাইরে গেলেই পড়তে হচ্ছে প্রশাসনের জবাবদিহির মধ্যে। আবার বেশির ভাগ মানুষের ঘরে সংরক্ষিত বৃষ্টির পানিও শেষ হয়েছে।

তীব্র গরমে বাড়ির আশপাশের পুকুরের পানি তলানিতে ঠেকেছে, পানি দিয়ে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। ফলে যেসব জায়গায় পুকুর ফিল্টার রয়েছে, তা অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
আশাশুনি উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের ভেতর কেবল দুটির ভূগর্ভস্থ পানি খাওয়ার উপযোগী। ওই সব এলাকায় টিউবওয়েলের পানি খাওয়ার উপযোগী। বাকি ৯ ইউনিয়নের কিছু জায়গায় টিউবওয়েল আংশিক সফল বলা যায়; পানির মান সেখানে আশানুরূপ নয়।
বৃহৎ এলাকার জনগোষ্ঠীকে খাবার পানির সংস্থানে একেক ঋতুতে একেক ধরনের উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়। বৃষ্টির সময় বাড়িতে বাড়িতে রিজার্ভ ট্যাংকে সংগৃহীত পানি (যা দিয়ে তিন–চার মাস চলে), বাকি সময়ে কখনো পুকুর ফিল্টার (যদিও লবণাক্ততার কারণে এ উৎসটি হুমকির মুখে) বা সরাসরি পুকুরের পানি অথবা ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত লবণ বিমুক্তকরণ প্ল্যান্টই (আর ও প্ল্যান্ট) হচ্ছে এখানকার মানুষের খাবার পানির উৎস। গরমের সময় প্রাকৃতিক উৎস বেশির ভাগ অচল থাকে। ফলে মানুষকে এই সময় পানি কিনে খেতে হয়। এই আশাশুনি উপজেলার সব কটি ইউনিয়নের মানুষের জন্য মাত্র ৭০টির মতো সচল আর ও প্ল্যান্ট রয়েছে। ফলে বেশির ভাগ মানুষকে পানি সংগ্রহের জন্য এমনকি চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়।
ঠিক এ রকম একটি অবস্থায় করোনা প্রতিরোধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংগত কারণে মানুষের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। ফলে দূর থেকে পানি আনা-নেওয়ার কাজে মানুষকে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনার মধ্যে; সৃষ্টি হচ্ছে একধরনের অস্বস্তি। বিশেষ করে বন্ধের আওতায় যেসব বাড়ির মানুষেরা পড়ছে, তাদের কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অনেককে তলানিতে ঠেকে যাওয়া পুকুরের পচা পানি পান করতে হচ্ছে। মানুষের এ রকম পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির আরও ব্যবসায়িক এবং পানি পরিবহনের কাজে যুক্ত কিছু ভ্যানচালক অতিরিক্ত দামে পানি বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
স্থনীয় সরকার এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলাই সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, বাজার মনিটরিং, ত্রাণ বিতরণসহ নানামুখী প্রসংশনীয় উদ্যোগ নেওয়া হলেও মানুষের নিরাপদ পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছে অবস্থানের কারণে সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং আশাশুনি উপজেলায় পানিসংকট অন্য উপজেলার থেকে বেশি। সুতরাং এসব এলাকায় করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি পানি সংকটকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে গেলে করোনা মোকাবিলার অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ যেমন সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার বিষয়টি প্রশাসনের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে বা হচ্ছে।
উপকূলীয় এসব এলাকায় পেটের ক্ষুধা এবং পানির তৃষ্ণা দুটি সমার্থক বিষয়। এমনিতে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আমাদের আবহাওয়া এবং ঋতুগুলোর মধ্যে যথেষ্ট তারতম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রলম্বিত গ্রীষ্মকালের ফলে উপকূলীয় এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার নিচে নেমে যাচ্ছে এবং ভূপৃষ্ঠের পানি এই সময় শুকিয়ে যায়। আবার গরমকালে যে পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে কয়েক বছর ধরে গরমের সময় এখানে পানির সংকট তিব্র মাত্রায় পৌঁছায়। সুতরাং সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে কর্তাব্যক্তিরা ত্রাণের মধ্যে পানির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। আশাশুনি ও শ্যামনগর এলাকায় সরকারি, ব্যক্তিগত এবং এনজিওদের উদ্যোগে অনেকগুলো লবণপানি বিমুক্তকরণ প্ল্যান্ট গড়ে উঠেছে। এসব প্ল্যান্টের পানি নামমাত্র দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। সমস্যা হচ্ছে এই প্ল্যান্টগুলো সবার হাতের নাগালে নয়। বেশির ভাগ মানুষকে অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়। এ ক্ষেত্রে একটি সমাধান হতে পারে যারা ত্রাণ দিচ্ছেন, তারা এই প্ল্যান্টের পানিকে পরিবহনের মাধ্যমে বিনামূল্যে হতদরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। এটাও ত্রাণ কার্যক্রমের মধ্যেই পড়ে। সুতরাং ত্রাণের মধ্যেই নিরাপদ খাওয়ার পানি অন্তর্ভুক্তকরণ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এর সরবরাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থাগুলো এই অঞ্চলে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যতিক্রমী এবং কার্যকর নজির স্থাপন করতে পারেন।

*লেখক: প্রকল্প ব্যবস্থাপক, রূপান্তর-পিসিআর ওয়াশ প্রকল্প, আশাশুনি