বন্ধুরা মিলে পাহাড় ও সৈকতে

চন্দ্রনাথের পাহাড়ে। ছবি: সংগৃহীত
চন্দ্রনাথের পাহাড়ে। ছবি: সংগৃহীত

 ‘উফ! আর উঠতে পারছি না, চল নেমে যাই’, ‘আমি আর পারব না, আমাকে কেউ পানি দাও,’ ‘রাকিব, বেশি দূরে যাস না, এটা সমুদ্র... ’। এমনি কিছু মজার আর রোমাঞ্চকর মুহূর্তের সম্মুখীন হয়েছিলাম। কথা বলছি চন্দ্রনাথ পাহাড় আর বাঁশবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ নিয়ে।

গত বছরের জুলাই মাস। ক্লাস শেষে কয়েকজন বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমরা মাত্র প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। হুট করে কথার মধ্যেই একজন বলে বসল, বন্ধুরা মিলে দূরে কোথাও যাওয়া হলো না। তখন আড্ডায় উপস্থিত সবাই তার কথার সমর্থন করল। তাই তখনই সবাই মিলে প্ল্যান করলাম একটু দূরে কিন্তু এক দিনে ঘুরে আসা যায় এমন জায়গায় যাব।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে। আর এখানে যেহেতু ঘোরাঘুরির জন্য সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে তাই ভ্রমণের জন্য চট্টগ্রামকেই সবাই প্রাধান্য দিল। কিন্তু একেক জনের একেক মত। অবশেষে তথ্য হিসেবে গুগল থেকে কিছু সাহায্য নিয়ে স্থান নির্ধারণ করা হল চন্দ্রনাথ ও বাঁশবাড়িয়া। বলে রাখি, আমরা কেউ এ স্থানগুলোতে আগে যাইনি। তা ছাড়া ইউটিউব থেকে ভিডিও দেখে প্রত্যেকের মধ্যেই একটা কৌতূহল তৈরি হলো।

ভ্রমণের দিন
আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে মোট ১৬ জন ছিলাম। বাহন হিসেবে আমরা একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করলাম সারা দিনের জন্য। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। সবার মধ্যেই একটা আমেজ আমেজ ভাব। বন্ধুদের মধ্যে কথাবার্তা আর নানান বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে করতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এসে সকালের নাশতাটা সেরে নিলাম। তারপর বিভিন্ন গান ও মজার ছলে দুপুর ১২টায় আমরা সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। ততক্ষণে সূর্যের তাপও অনেক বেশি। গাড়ি থেকে নেমেই পানির বোতল ও কচি বাঁশ সঙ্গে নিয়ে শুরু হলো আমাদের পাহাড় অভিযান। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উচ্চতা ১ হাজার ১৫২ ফুট। গন্তব্য পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির।

এ পাহাড়ে ওঠা একটু পরিশ্রমের হলেও মোটামুটি এক ঘণ্টা ২০–৩০ মিনিটের মতো সময় লাগে। যাই হোক, কিছুদূর যাওয়ার পর প্রথম একটা মন্দির পেলাম। রোদের মধ্যে সেখানে গিয়ে অনেকের অবস্থা প্রায় নাজেহাল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার চললাম। তখনও আরও অনেক কিছু দেখার বাকি ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ছোট ঝরনার মতো পেলাম। এর একপাশে সিঁড়ির মতো রাস্তা আর আরেক পাশে খাড়া উঁচু টাইপের রাস্তা।

সমুদ্রে আড্ডাবাজির দল। ছবি: সংগৃহীত
সমুদ্রে আড্ডাবাজির দল। ছবি: সংগৃহীত

একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে, সিঁড়ির চেয়ে নাকি ওই রাস্তা দিয়ে ওঠা একটু কম কষ্টসাধ্য হবে। তাই আমরাও ওই খাড়া রাস্তা দিয়ে ওঠা শুরু করলাম। প্রায় ১০ মিনিটের মতো ওঠার পর একজনের অবস্থা প্রায় দেখার মতো ছিল। সবাই ঘামে গোসলের মতো ভিজে গেছে এবং অনেকেই ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছে। বিশেষ করে আমাদের সঙ্গে যাওয়া মেয়েদের অবস্থা ছিল প্রায় অজ্ঞান হওয়ার মতো। একটু বিশ্রামের পর সেখান থেকে ছেলে ও মেয়ে মিলিয়ে সাতজন না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর তাদের ছেড়ে আমাদের নয়জনের শুরু হলো বিচ্ছিন্নভাবে যাত্রা। অনেক কষ্ট ও চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমরা চন্দ্রনাথ মন্দিরে এসে পৌঁছালাম। মন্দিরে ওঠা অবস্থায় আমি প্রায় ১ দশমিক ৫ লিটারের মতো পানি খেয়েছিলাম এতটুকু মনে আছে। সেখানে উঠে আমরা স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলি। চারপাশের সৌন্দর্য এবং পাহাড়ের পর পাহাড় দেখে মনে হয়েছিল আমি যেন সবুজের এক লীলাখেলায় দাঁড়িয়ে আছি।

মন্দিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, ফটোসেশন এবং পুরোহিতদের সঙ্গে আলাপচারিতার পর আমরা আবারও নিচে নামার জন্য তৈরি হলাম। এবার আমাদের রাস্তা সিঁড়ির মতো। তবে তা যেনতেন সিঁড়ি নয়, খাড়া সিঁড়ি। একবার পা পিছলে পড়ে গেলে বাঁচার সম্ভাবনা একদম ক্ষীণ। এভাবে এক এক করে পা ফেলে এবং সাবধানে আমরা নিচে নেমে এলাম। তবে ওঠার তুলনায় আমরা অনেক তাড়াতাড়িই নামতে পেরেছিলাম। ততক্ষণে প্রায় দুপুর ঘনিয়ে বিকেল। রোদের তীব্রতা ও গরমে সবার জন্য এক হাহাকার অবস্থা। সবার মুখখানি যেন এক কালচে ভাব ধারণ করেছিল। পরে যদিও মাইক্রোবাসের এসির ফলে অনেকটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। সেখান থেকে আমরা সীতাকুণ্ড বাজারে এসে দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিকেল চারটায় রওনা দিলাম বাঁশবাড়িয়ার উদ্দেশে।

এর কিছু সময় পরই আমরা পৌঁছে গেলাম বাঁশবাড়িয়ায়। বিস্তীর্ণ জলরাশির এক অপূর্ব দৃশ্য দেখে এই ক্লান্তের মধ্যে সবাই যেন মুহূর্তেই আবার সতেজ হয়ে উঠল। আমরা সবাই মিলে নেমে পড়লাম পানিতে। এ যেন কক্সবাজারের এক অন্যরূপ। সবাই মিলে একজন আরেকজনকে পানি ছিটাছিটি শুরু করলাম। সেই সঙ্গে সঙ্গে থাকা ফুটবলটি নিয়েও সৈকতে খেলা শুরু করে দিলাম। এ যেন এক অন্য রকম অনুভূতি। আমরা থাকতে থাকতে সমুদ্রের ভাটাও দেখতে পেলাম। একটু আগেও যেখানে ঢেউ ছিল সেখানে পানি শূন্য হয়ে পানি অনেকটা নিচে নেমে গেছে। বিকেল ঘনিয়ে সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে এমন সময় সূর্য যেন এক লালচে ভাব ধারণ করেছিল। ওই সময় আমরা আবার গাড়িতে চেপে বসলাম ফিরে আসার জন্য এবং রাত আটটায় আমরা ফিরে এলাম।

* লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]