আনিসুজ্জামান স্যারের স্বাক্ষরিত চিঠিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো হলো না

কিছু স্বপ্ন হারিয়ে যায় মৃত্যুর মিছিলে, কিছু স্বপ্ন বেঁচে থাকে বেদনার অন্তরালে। আবার কিছু স্বপ্ন বেঁচে থাকে গভীর মমতায়, কিছু স্বপ্ন বেঁচে থাকে পরম শ্রদ্ধায়। আনিসুজ্জামান স্যারকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে না পারার কষ্ট আমাদের আজীবন বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করাবে। 

এই ব্যথা আমাদের স্যারের কথা কোনো দিন ভুলতে দেবে না। তিনি দীপ্তিমান থাকবেন আমাদের অনুভূতিতে। চিরস্মরণীয়, বরণীয় হয়ে থাকবেন বাঙালির মানসপটে।
একজন মানুষ। একজন শিক্ষক। একজন লেখক। আনিসুজ্জামান স্যার পাহাড়ের সমান বড় ব্যক্তিত্ব। তাঁকে দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে।
মাত্রাজ্ঞানে, সাবলীলতায়, পরিমিতিবোধে, আন্তরিকতায়, আতিথেয়তায়, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন অনন্য।
তাঁর বাসায় বহুবার গিয়েছি। কখনো কোনো কিছু না খেয়ে আসিনি। কত কিছু যে খেয়েছি স্যারের বাসায়। কিন্তু স্যারকে কখনো একটি কাপ চা হাতে তুলে দিতে পারিনি। যতবার দিতে চেয়েছি, ততবারই থামিয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন, না না ঠিক আছে। তুমি নাও, আমি নিতে পারব। যদিও তিনি অসুস্থ, তবু কাউকে বুঝতে দেননি যে তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে।
অনেক সময় স্যারের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে খুব কষ্ট হতো। কিন্তু তিনি কারও কাঁধের ওপর ভর করে দাঁড়াননি।
কখনো কাউকে ডাকেননি যে আমাকে এই খাবার হাতে তুলে দাও কিংবা এক কাপ চায়ে চিনি মিশিয়ে দাও। স্যার কাউকে কথা দিলে সে কথা রাখতেন। অনেক অনুষ্ঠানে স্যারকে দেখেছি অসুস্থ শরীর নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনো অনুষ্ঠান শেষ না করে যাননি। বাঙালির চেতনা এবং মূল্যবোধের জায়গায় আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন বটবৃক্ষের মতো।
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের সহধর্মিণী সিদ্দিকা জামানের অমায়িক আচরণ আজীবন মনে থাকবে। কবীর মেহরাব ভাইয়ের সঙ্গে স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে আসার সময় তাঁর সহধর্মিণী সব সময় আমাদের লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন। অনেকবার অনুরোধ করে মেহরাব ভাই বলতেন প্লিজ ভাবি, আপনি কষ্ট করে আসবেন না, আমরা যেতে পারব। কিন্তু তিনি আমরা লিফট থেকে নিচে না নামা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতেন। স্যারের ছেলে আনন্দ জামান এত ভদ্র, এত বিনয়ী, এত মার্জিত সত্যিই এই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আনন্দ জামান একটি আদর্শ পরিবারের সন্তান।
শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান স্যারের মধ্যে কোনো অহংবোধ ছিল না। সরলতা ছিল, প্রাঞ্জলতা ছিল। তিনি কথায়, কাজে, চিন্তায় ছিলেন একজন আপাদমস্তক পরিশীলিত মানুষ। তিনি অল্পভাষী ছিলেন। কোনো অনুষ্ঠানে তাঁকে দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে শুনিনি। তিনি সব সময় কম কথায় মূল্যবান বক্তব্য প্রদান করতেন।
প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বাতিঘর আনিসুজ্জামান স্যার ‘দি মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দি ওয়ার্ল্ড সোসাইটি, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার’–এর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই সংগঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রূপকার রফিকুল ইসলাম।

রফিকুল ইসলাম ২০ নভেম্বর ২০১৩ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশে আসেন এবং আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে দেখা করেন। পাশাপাশি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন, ভাষাসৈনিক ড. হালিমা খাতুন, ড. মালেকা বেগমকে নিয়ে ধানমন্ডির ২৭ বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে আনিসুজ্জামান স্যারকে দি মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দি ওয়ার্ল্ড সোসাইটির প্রধান উপদেষ্টা করার প্রস্তাব করেন কবীর মেহরাব। প্রস্তাবে সবাই সমর্থন করেন। কিন্তু আনিসুজ্জামান স্যার বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নয়, শুধু উপদেষ্টা রাখো আমাকে। কারণ, আরও অনেকেই তো আছে। আনিসুজ্জামান স্যার প্রস্তাব করেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবং রফিকুল ইসলাম তাঁর বন্ধু একাত্তরের সহযোদ্ধা কবীর মেহরাবকে জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে প্রস্তাব করেন।
কানাডার ভ্যাঙ্কুভার থেকে বাংলাদেশে শুরু হলো সংগঠনটির দীর্ঘ ২১ বছরের পথচলা। আনিসুজ্জামান স্যারের দিকনির্দেশনায় এবং কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের নেতৃত্বে আমরা প্রতিবছর ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠান আয়োজন করি। সর্বশেষ ২০তম বর্ষপূর্তি পালন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, সেগুনবাগিচায়।
এবার হয়তো আগামী ১৭ নভেম্বর ২১তম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান হবে। যেখানে থাকবেন না আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামান স্যার। আমরা হারালাম আমাদের সংগঠনের অভিভাবককে। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের চিৎকার করে কান্নার শব্দ এখনো কানে বাজে। মনে হয় তিনি হারিয়েছেন তাঁর পিতাকে। এখন থেকে আনিসুজ্জামান স্যারের বিশাল শূন্যতা অনুভব করব।
পৃথিবীর সব ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার ওপর একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণের কাজ চলছে। যেখানে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মাতৃভাষার ওপর প্রথম সাক্ষাৎকারটি আনিসুজ্জামান স্যারের নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাক্ষাৎকারটিও নেওয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার জন্য সময় চেয়ে একটি চিঠি লেখা হয়েছিল। সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সেই চিঠিতে আনিসুজ্জামান স্যারের স্বাক্ষর ছিল। আনিসুজ্জামান স্যারের স্বাক্ষরিত চিঠিটি করোনার কারণে আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানো হলো না।
আনিসুজ্জামান স্যার এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাক্ষাৎকারটির ভিডিও ধারণ করেছেন আবিদ রশিদ মামুন। পরিকল্পনা ছিল জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার। কফি আনান মৃত্যুবরণ করায় তাঁর আর সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হলো না।
অন্যদিকে করোনার কারণে থেমে গেল আমাদের তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ। আর করোনার কারণে জীবনপ্রদীপ নিভে গেল আমাদের আনিসুজ্জামান স্যারের।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অগণিত বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে আনিসুজ্জামান স্যারের গভীর সম্পর্ক ছিল। যোগাযোগ ছিল। আত্মিক বন্ধন ছিল। স্মৃতির অমলিন পাতায় হয়তো তারা তাদের প্রিয় মানুষটিকে খুঁজবে। একজন পুরোনো ছাত্র কিংবা ছাত্রী তার প্রিয় শিক্ষককে খুঁজবে। চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে উঠবে সেই চিরচেনা প্রিয় মুখ। মনে পড়বে ক্লাসরুমে কিংবা তার বাইরে স্যারের সঙ্গে কিছু প্রিয় মুহূর্তের কথা।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো একজন ভাষাসংগ্রামীকে আমরা শেষবিদায় জানাতে পারিনি। এটা একটা দুঃখবোধ। এই দুঃখবোধ থেকেই যেন আমরা তাঁকে স্মরণ করব আমাদের বাংলা ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে।
লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক, দি মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দি ওয়ার্ল্ড সোসাইটি, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।