৬৪ জেলায় করোনাযুদ্ধে সন্ধানীয়ানরা

সন্ধানীর সদস্যরা সারা দেশে কাজ করছেন। ছবি: সন্ধানী
সন্ধানীর সদস্যরা সারা দেশে কাজ করছেন। ছবি: সন্ধানী

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসজনিত মহামারির এই ক্রান্তিলগ্নে সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই নিজ নিজ সামর্থ্য নিয়ে এগিয়ে আসছেন। ভবিষ্যৎ চিকিৎসক হিসেবে তাই মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থীদের দায়িত্বটাও কম নয়। আবার যদি তা হয় স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সদস্য, তাহলে আর্তমানবতার সেবায় হোম কোয়ারেন্টিনে থেকেও এগিয়ে আসতে কোনো বাধা থাকে না।


বলছি মেডিকেল ও ডেন্টাল ছাত্রছাত্রী পরিচালিত জাতীয় পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান 'সন্ধানী'র কথা। দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে ৬৪ জেলায় করোনাযোদ্ধা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং সমাজের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছে সন্ধানী।

 সন্ধানী ক্র্যাক প্লাটুন ভলান্টিয়ার্স টিম গঠন

দেশে লকডাউন অবস্থা ঘোষণার পরপরই দেশব্যাপী হাসপাতালগুলোতে রক্তের চাহিদা পূরণ ও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে ২৫টি সন্ধানী ইউনিটের পাশাপাশি ৬৪ জেলায় গঠন করা হয়েছে ৪১টি 'সন্ধানী ক্র্যাক প্লাটুন ভলান্টিয়ার্স টিম'। সরাসরি কেন্দ্রীয় পরিষদের অধীনে এবং সন্ধানী ইউনিটসমূহের সহযোগিতায় পরিচালিত ক্র্যাক প্লাটুন ভলান্টিয়ার্স টিমসমূহে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নন মেডিকেল যে কেউ সদস্য হতে পারবে।

কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মির্জা মিনহাজুল ইসলাম হৃদয় বলেন, 'আমরা স্থানীয়ভাবে প্রচারণার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহযোগিতায় জেলাভিত্তিক ভলান্টিয়ার সংগ্রহ করি। এখনো কেউ চাইলে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সদস্য হতে পারবে। ইউনিটের সঙ্গে সমন্বয়ের লক্ষ্যে কিছু ক্ষেত্রে কয়েকটি জেলার সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। ক্র্যাক প্লাটুন ভলান্টিয়ার্স টিমের মাধ্যমে সন্ধানীর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫০০ পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী নগদ আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে।'

কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী টিমের সদস্য ওয়ালিউর রহমান বিজয় বলেন, ৪১টি জেলা টিমের মাধ্যমে মার্চ ও এপ্রিল মাসে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঁচ শতাধিক ব্যাগ রক্তের জোগান দেওয়া হয়েছে।

সন্ধানীর সৌজন্যে ফেসশিল্ড বিতরণ। ছবি: সন্ধানী
সন্ধানীর সৌজন্যে ফেসশিল্ড বিতরণ। ছবি: সন্ধানী

সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ
করোনাযুদ্ধে প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে সারা দেশের প্রতিটি হাসপাতালে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। লকডাউনে বহু অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে গেলেও হাসপাতাল বন্ধ হয়নি, বন্ধ হয়নি মানুষের সেবা প্রাপ্তি। প্রথম সারির এই যোদ্ধাদের সুরক্ষার জন্য সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ ও ২৫টি সন্ধানী ইউনিটের মাধ্যমে বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক তানজিমুল হাই রাফি বলেন, 'আমাদের ইউনিটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে প্রায় ১৪০০ জনের মধ্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়।'

সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি তানভীর হাসান ইকবাল বলেন, 'করোনা শুরুর পর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে মোট ৩৬১৫ বোতল ৫০ মিলি হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ২০০পি কেএন–৯৫ এবং ২৫০০ পিস সার্জিক্যাল মাস্ক, ২৫০টি পিপিই, ৫৮৫টি ফেসশিল্ড, ৩০০০টি গ্লাভস বিতরণ করা হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের অংশগ্রহণ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজন সবার সহযোগিতা এবং ক্রান্তিলগ্নে মানবসেবার সঠিক ইচ্ছা।'


ত্রাণ বিতরণ
দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত পরিবারেও নেমে এসেছে অন্ধকার ও অসহায়ত্ব। সন্ধানী ২৫টি ইউনিট ও ক্র্যাক প্লাটুন ভলান্টিয়ার্স টিম প্রায় দুই মাসব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ করে চলেছে।
সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিটের সভাপতি নাসরিন উর্মী বলেন, শুধু এপ্রিল মাসেই সন্ধানী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ইউনিট ও চট্টগ্রাম জেলা ভলান্টিয়ার্সদের মাধ্যমে পটিয়া, বাদুরতলা ও সাতকানিয়া, সন্দ্বীপ, হাটহাজারীসহ বিভিন্ন স্থানে পাঁচ শতাধিক পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত সন্ধানীয়ানদের কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে।


কেন্দ্রীয় পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান জানান, দেশব্যাপী প্রায় ৩২১০ অসহায় পরিবারের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে সন্ধানীয়ানরা। ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির পাশাপাশি রমজান মাস উপলক্ষে ইফতার সামগ্রীও প্রদান করা হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে সন্ধানীয়ানদের নিজস্ব সহায়তায় প্রতিটি ইউনিটের মাধ্যমে এতিম ও অসহায়দের মধ্যে ঈদসামগ্রী বিতরণ করা হবে।

বিনা মূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা
করোনায় আক্রান্ত চিকিৎসক এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সেবাবিষয়ক উপকমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. সাইমুম আরাফাত পান্থ অ্যাম্বুলেন্স সেবা সম্পর্কে বলেন, ঢাকা বা তার আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত কোনো চিকিৎসক বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য যদি করোনায় আক্রান্ত হন অথবা কোনো শিক্ষার্থী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্য কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তাঁদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিনা মূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেবে সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ। ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সেবার জন্য যোগাযোগ করতে হবে ০১৬৮২-৬৮৩৮১১, ০১৭২০-৬৮২৩৪৬, ০১৭৭১-৬২৫২৩২, ০১৬২৩-৭৩৭৬৪১, ০১৬৮৯-০৬২৯৭৩ নম্বরে।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। ছবি: সন্ধানী
হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়েছে। ছবি: সন্ধানী

প্লাজমা ফেরাতে জাতীয় পর্যায়ে প্রচার ও সহায়তা প্রদান
করোনা চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে শুরু হয়েছে প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। সন্ধানীর প্রচেষ্টায় স্বেচ্ছায় দেশের সর্বপ্রথম প্লাজমা দান করেছেন তাসনিম সোহেল আকাশ। কী কী শর্তে একজন করোনাজয়ী ব্যক্তি প্লাজমা দান করতে পারবেন, সে সম্পর্কে সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের সহসভাপতি নুরুল নবী আরাফাত বলেন, 'গাইডলাইন অনুযায়ী, কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর ২৮ দিন অতিবাহিত করতে হবে। অথবা আক্রান্ত ব্যক্তি উপসর্গ মুক্তির পর ন্যূনতম ২৪ ঘণ্টা ব্যবধানে পরপর দুটি নেগেটিভ আরটি পিসিআর টেস্টের ২য়টির ফলাফল নেগেটিভ আসার পর ১৪ দিন অতিবাহিত হতে হবে। এবং অ্যান্টিবডি টাইটার ন্যূনতম ১:১৬০ থাকতে হবে। তবে যেসব নারী কখনো গর্ভধারণ করেছেন, তাঁরা প্লাজমা দানের জন্য উপযুক্ত নন।


সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের সভাপতি তানভীর হাসান ইকবাল বলেন, ওপরের শর্ত সাপেক্ষে করোনাজয়ী ব্যক্তিরা হাজারো জীবন বাঁচাতে পারবেন শুধু প্লাজমা দানের মাধ্যমে। সন্ধানী প্রতিনিয়ত প্রচারণা চালিয়ে গেলেও প্লাজমা দান সম্পর্কে উচ্চপর্যায় থেকে প্রচারণা চোখে পড়ার মতো না। তাই সন্ধানীর মতো সব স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও ক্লাবকে প্লাজমা দান সম্পর্কে প্রচারণা ও ডোনার ব্যবস্থা করার প্রতি নজর দিতে হবে। প্লাজমা দানের জন্য সন্ধানীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৭৯১৯৫২৩৫৩, ০১৭৮৫৬৪৮৬২২ নম্বরে।


নিয়মিত অনলাইন প্রচারণা
বর্তমানে এই দুর্যোগকালীন সময়ে বাধ্যতামূলক বাসায় থাকা মানুষের সচেতন করতে অনলাইন প্রচারণা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করেছে সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ ও সন্ধানীর ইউনিটসমূহ। সন্ধানী কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সাকিব মাহমুদ বলেন, সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের প্রচার ও প্রকাশনা উপপরিষদের অধীনে একটি 'নিয়মিত করোনা আপডেট টিম' গঠন করা হয়েছে। ওই টিমের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, দেশের প্রতিদিনের করোনা আপডেট, জেলাভিত্তিক করোনা আপডেট, সাহ্‌রি ও ইফতারের সময় ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে পুষ্টিবার্তা এবং প্লাজমা দান সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সাহায্যে প্রচার করা হচ্ছে।


কেন্দ্রীয় পরিষদ ও ইউনিট সমূহের অন্যান্য কার্যক্রম
সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদের রোগীকল্যাণ সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ বলেন, দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীরা ঘরে বসে যেন সেবা পান, সে লক্ষ্যে সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ ও সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করা হয়েছে। ওই টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে প্রতিদিন কয়েক শ মানুষ সেবা গ্রহণ করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইউনিটের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সচেতনতা সম্পর্কিত প্রায় ৫০০০ লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মির্জা মিনহাজুল ইসলাম হৃদয় বলেন, সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ, সন্ধানীর ২৫টি ইউনিট এবং সন্ধানী করতে ইচ্ছুক মেডিকেল কলেজসমূহ করোনা সম্পর্কিত বিভিন্ন কার্যক্রমের পাশাপাশি তাদের নিয়মিত রক্তদান, ড্রাগ ব্যাংক, মরণোত্তর চক্ষুদানে উদ্বুদ্ধকরণ, মেধাবৃত্তি প্রদান, ঈদসামগ্রী বিতরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।


সভাপতি তানভীর হাসান ইকবাল বলেন, দেশ এবং সারা বিশ্ব বর্তমানে একটি কঠিন সময় পার করছে। এই মহামারির সময়ে দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই করণীয় রয়েছে। হয়তো নিজ বাসায় অবস্থান করার মাধ্যমে আপনি আপনার সেই দায়িত্ব পালন করছেন অথবা এগিয়ে এসেছেন অসহায় মানুষদের সহায়তায়। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের পাশাপাশি দায়িত্বশীল ও সামর্থ্যবান সবার এগিয়ে আসার মাধ্যমেই মহামারি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

*লেখক: চিকিৎসক, উপদেষ্টা, সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ