মেঘের রাজ্যে বৃষ্টির দর্শন

বন্ধুরা মিলে ঘুরত যাওয়ার মজাই আলাদা। ছবি: লেখক
বন্ধুরা মিলে ঘুরত যাওয়ার মজাই আলাদা। ছবি: লেখক

বছরটা ছিল ২০১৯ সাল। তখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী আমি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ও নতুন। ১ জানুয়ারি ক্লাস শুরু হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাস, বিভাগ থেকে শিক্ষাসফরে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। 

আমাদের বিভাগ থেকে একটি শিক্ষাসফরের আয়োজন করা হয়েছিল। স্থানগুলো ছিল সাজেক-খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি। জায়গাগুলোতে আমার ও কোনো দিন যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম শিক্ষাসফর। একধরনের কৌতূহল–উদ্দীপনা কাজ করছিল।

ভ্রমণের প্রথম দিন
২৭ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা। ‘অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে’ স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু হলো। শিক্ষক, সিনিয়র, ক্লাসমেট সবাই একসঙ্গে উঠে পড়লাম বাসে। গন্তব্য সাজেক। বাসে উঠে যার যার পছন্দমতো সিটে বসে পড়লাম। আমি বসলাম জানালার পাশে সিটে। সিটে বসার কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয়ে গেল কোলাহল। কোলাহলটা ছিল নাচ ও গানের। বাসে ওঠার সময়ই বিভাগের ঢোল, বাঁশিসহ সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে উঠেছিলাম। গানবাজনা করতে করতে কখন যে চট্টগ্রাম এসে পড়লাম টেরই পেলাম না। চট্টগ্রামের একটি হোটেল এসে হালকা বিরতি নেওয়া হলো। তখন বাজে রাত দুইটা। তবু সবার মধ্যে তখন ব্যাপক উদ্দীপনা কাজ করছিল। এখানে এই বিরতিতে আমাদের হালকা খাওয়ার পর্ব শেষ হলো। তারপর আবার বাসে উঠে পড়লাম। তারপর বাসে উঠে জানালার পাশে বসতেই শীতের রাতের ঠান্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগল। দেখলাম প্রকৃতি খুব নিস্তব্ধ। ভোরের সূর্য উঠাটাও স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম। যতদূর চোখ পড়ে, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এসব দেখতে দেখতে ঘুমের ঘোরে কখন যে চোখ লেগে গেল টের পেলাম না।

হঠাৎ বাস থামল। তখন সকাল আটটা বাজে। তখন আমরা খাগড়াছড়ি এসে পৌঁছালাম। শুনলাম বাস ছাড়তে হবে এবং একটি হোটেলে আমাদের সকালের নাশতার আয়োজন করা হয়েছে। ব্যাগ গুছিয়ে নেমে পড়লাম। নাশতা শেষ করার পরেই আমাদের শ্রেণি প্রতিনিধি এনামুল, সবাইকে শিক্ষাসফরের র্টি-শার্ট দিল। তারপর চান্দের গাড়ি দিয়ে আবার যাত্রা শুরু হলো সাজেকের উদ্দেশে। কী আনন্দঘন মুহূর্ত ছিল! গাড়ি শুধু ওপরেই যাচ্ছে। দূর থেকে চোখে পাহাড়ের মরীচিকা ভেসে এল এই বুঝি আর অল্পটুকু পথ! যেতে যেতে রাস্তার দুপাশে সবুজের সমারোহ দেখতে পেলাম। দেখতে পেলাম সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় ঘন কালো মেঘের রাজ্যটাকে। বেলা একটা নাগাদ রিসোর্টে পৌঁছে গেলাম। বাঁশের তৈরি দোতলা রিসোর্ট। আমাদের রুম ছিল দোতলায়। রুমে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার অভিযান।

পাহাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত
পাহাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে। ছবি: সংগৃহীত

লাঠি হাতে কংলাকের দিকে এগিয়ে চললাম। চূড়ায় ওঠার পর সেখানের মেঘগুলোকে যেন মনে হলো তুলোর মতো ভাসছে। সেখানে খানিকক্ষণ ফটোশুট করে নেমে এসে বসলাম হ্যালিপ্যাডে। শুরু হলো আবার গানবাজনা। ইতিমধ্যে সন্ধ্যার আধার ঘনিয়ে আসছিল। হঠাৎ নেমে এল বৃষ্টি। এ যেন মেঘের রাজ্যে এসেই বৃষ্টির দর্শন। তাড়াতাড়ি করে আশপাশের দোকানগুলোতে এসে ঠাঁই নিলাম। বৃষ্টি থামার পর রিসোর্টে এসে জামাকাপড় বদলে নিলাম। হঠাৎ আমরা বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম রাতের খাবার খাওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই মিলে আশপাশটা ঘুরে দেখব। তাই দেরি না করে রিসোর্ট থেকে নেমে পড়লাম। সবাই মিলে সাজেকের রাস্তাগুলো ঘুরলাম। দেখলাম স্থানীয় মানুষেরা বাঁশের মধ্যে বিভিন্ন খাবার তৈরি করছে। সাজেকের রাস্তাগুলোতে রাত হলে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের সোডিয়াম বাতি। সব মিলিয়ে হাঁটতে ভালোই লাগছিল। রাতে আমাদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল বারবিকিউ পার্টি। এভাবে ভ্রমণের প্রথম দিনটি এত দ্রুত কেটে গেল।

ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন
আগে থেকে প্ল্যান ছিল সকালে সূর্যোদয় দেখতে যাবে। তাই সবাই খুব ভোরের উঠে হ্যালিপ্যাডে চলে গেলাম। গিয়ে দেখলাম আকাশটা পুরো মেঘে ঢাকা। মনে হচ্ছিল হাত বাড়িয়ে দিলে মেঘগুলো ধরতে পারব। ধীরে ধীরে মেঘ সরে সূর্য উঠল। সূর্যোদয়ের সেই দৃশ্যটা অসম্ভব সুন্দর ছিল! তারপর সকালের নাশতা শেষ করে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। গেলাম আলুটিলাতে। টিলার গুহা ছিল অন্ধকারময়। আগুনের মশাল হাতে গুহার ভেতরে এগিয়ে চললাম খালি পায়ে। গুহাটি ছিল অতি পিচ্ছিল এবং এর ভেতরে ছিল পানি আর বড় বড় পাথর। আলুটিলা থেকে এসে রওনা হলাম ঝুলন্ত ব্রিজের উদ্দেশে। ঝুলন্ত ব্রিজে উঠে কিছুটা ভয় পেলাম, এই বুঝি পড়ে গেলাম নিচে! কিন্তু তা নয়। রাতে সবাই মিলে অবস্থান করলাম খাগড়াছড়ির একটা হোটেলে।

মেঘের রাজ্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
মেঘের রাজ্য কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

ভ্রমণের ৩য় ও শেষ দিন

রওনা হলাম কাপ্তাই লেকের উদ্দেশে। একটি বড় নৌকা সহযোগে শুরু হয়ে গেলে লেক ভ্রমণ। দুপুর ১২টার দিকে সবাই মিলে লেকে গোসল করল। গোসল সেরে আবার নৌকা সহযোগে দুপুরের খাবার খাওয়ার উদ্দেশে রওনা হওয়া। লেকের একাংশের একটি ছোট পাহাড়ের ওপর আসলাম খাবারের জন্য। খাবারের প্রধান আকর্ষণ ছিল সেখানকার স্থানীয় ব্যামবো চিকেন। খাবারদাবার শেষ করে সেখানের ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে গেলাম। ব্রিজে উঠে সবাই ইচ্ছেমতো ছবি তুলতে লাগল। আমিও সে সময়ের কিছু মুহূর্ত আমার ক্যামেরায় বন্দী করে নিলাম। তারপর চলে আসলাম আবার হোটেলে। হোটেল থেকে সেখানকার বার্মিস মার্কেটে ঘুরলাম ঘণ্টাখানেক।

ঘোরাঘুরির পর রাতের খাবার শেষ করে আবার ক্যাম্পাসের উদ্দেশে ফিরে আসা। আহ! কী রোমাঞ্চকর সময় ছিল। এদিনগুলো ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় তিনটি দিন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম শিক্ষাসফরের অভিজ্ঞতা। স্মৃতির পাতায় দাগ কেটে যায় সেই দিনগুলো। কোয়ারেন্টিনে বসে আজও মনে পড়ে যায় সেই সোনালি মুহূর্তগুলোকে!

*লেখক: শিক্ষার্থী,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]