ট্রল, গণমাধ্যম ও অর্থনীতি

প্রতীকী ছবি। রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। রয়টার্স

একটি কথা আজকাল খুব শোনা যায়। সেটি হলো ‘ট্রল’। এটা নিয়ে ট্রল হচ্ছে, ওটা নিয়ে ট্রল হচ্ছে। এর সঙ্গে গুজব বা রটনা আছে। প্রায় সবকিছু নিয়েই এসব চলছে। মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই মুহূর্তে একটি বিশেষ ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। নানা কারণে আজ মনে হচ্ছে, ট্রলের একটি অর্থনীতি আছে, সেটা নিয়ে আলাপ করা প্রয়োজন। বিষয়টির ভেতরে যে শুধু কতিপয় মানুষের অনৈতিক উপার্জন জড়িত তা নয়। বরং তার সঙ্গে আরও অনেক বিষয় সম্পর্কিত।

আমরা শুনেছি, একটি কুকুর যদি মানুষকে কামড়ায়, সেই ঘটনা সংবাদ নয়। কিন্তু মানুষ যদি কুকুরকে কামড়ায়, তার সংবাদমূল্য আছে। সংবাদ আসলে কোনটি? আর কোনটি দুঃসংবাদ? এই সময়ে, এই করোনাকালে, যখন মানুষ ঘরে বসে দিন গুনছে, তখন এই দুইয়ের মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এখন মানুষের প্রধানতম সঙ্গী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মূলধারার গণমাধ্যম এখন নতুন প্রোডাকশন তৈরি করতে পারছে না। শুরুতে কিছুদিন আমরা পুরোনো চলচ্চিত্র-গানই উপভোগ করছিলাম। ভালোও লাগছিল। কিন্তু ওই সব পুরোনো ছবি আর গান আবারও পুরোনা হয়ে গেল।

এখন মানুষ নতুন কিছু খুঁজছে এবং সেই জায়গাটিতে বড় বড় টেলিভিশন স্টেশনগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম–ভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজনে নেমে পড়েছে। এর পেছনে বড় ধরনের বিনিয়োগও হচ্ছে। অনলাইনে চলছে বিচিত্র ধরনের কর্মকাণ্ড। সেগুলো মানুষের মনের ক্ষুধাও মেটাচ্ছে! সেই ক্ষুধা কতটা নৈতিক, কতটা অনৈতিক, কতটুকু প্রয়োজন-অপ্রয়োজন সেটি নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকতে পারে। ভাবনার বিষয় হলো, পৃথিবী যখন নানা ধরনের চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে ট্রল মানুষের মগজের ক্ষুধা মেটাতে ভূমিকা রাখছে। খাদ্য যেমন মেটায় পেটের ক্ষুধা। মানুষ আসলে গুজবের ভক্ষক। মানুষ গুজব পছন্দ করে, সেটি আসলে কতটা বুঝে বা না বুঝে, সে বিষয়টিও ব্যাখ্যার দাবিদার।

মানুষ যখন কোনো বিপদে থাকে, তখন মানুষ হাতড়ে ফেরে কোনো একটি অবলম্বন। মানুষ যখন পানিতে ডুবে যায়, তখন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়। অনেক সময় কুমির ধরেও মানুষ বাঁচতে চায়—এমন রেকর্ডও রয়েছে। মানুষ যা অবলম্বন করে বাঁচতে চায়, সেটি তাকে বাঁচিয়ে রাখবে নাকি মেরে ফেলবে, সেই বোধও মানুষ অনেক সময় হারিয়ে ফেলে।

মানুষের এখন বিনোদন প্রয়োজন। যাঁরা বিনোদনের কনটেন্ট তৈরির জন্য কাজ করেন—তারকা থেকে প্রায় সবাই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ঘরে বসে বিনোদন তৈরির চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেই বিনোদন হয়তো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারছে না। যদিও অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও সেটি হয়তো কিছুটা আবেদন তৈরি করছে। কিন্তু সেটা যদি অনেক দিন ধরে চলতে থাকে, তখন মানুষের ভেতরে একটি একঘেয়ে ভাব চলে আসে এবং সে জায়গাটি ভেঙে দেওয়ার জন্যই কিছু মানুষ নতুন নতুন ‘ফান’ তৈরি করে। এতে হয়তো দোষের কিছু নেই। ফান জীবনেরই অংশ, মানুষের জীবনে বিনোদন থাকবে, কৌতুক থাকবে। তবে সেটি করতে গিয়ে যদি মানুষের বিপদ বাড়ে, অন্যকে অপদস্ত করা হয়, প্রয়োজনে–অপ্রয়োজনে, তখন সেই ফানকে কেন্দ্র করে একধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় এবং নষ্ট হতে পারে সামাজিক সংহতি।

ট্রলের যে অর্থনীতি, সেটি নিয়ে গুগলে সার্চ দিলে নানা কিছু দেখা যাবে। আলোচনা, তর্ক, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, খোঁচাখুঁচি ইত্যাদি। ট্রলকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আগেই ছিল। কিন্তু এখন সেটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে যদি মানুষের মাঝে এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি না হয়।

ট্রলকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার বিষয়ে আমাদের কথা বলতে হবে। আমরা যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করি, তারা এই বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীলও। কিন্তু বিষয়টি যদি এমন হয় যে এই ট্রলের সঙ্গে অনেকেরই ব্যবসা জড়িত, ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের অর্থ জড়িত, যারা স্যোশাল মিডিয়ার নানা কর্মকাণ্ডে জড়িত, এসব নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের মার্কেটিং, অর্থনৈতিক প্রাপ্তি জড়িত, তখন এই পরিস্থিতিতে মানুষকে অবশ্যই বুঝতে শিখতে হবে আসলে কোনটা ফান আর কোনটা সামাজিক ও মানবিক স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না। তারা ঘরে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছে আবার এই দূরশিক্ষণকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া কাজ করছে। আমরা বলছি না এগুলো অন্যায়। যেকোনো নতুন বিষয় নিয়ে শুরুতে এমনটি হতেই পারে। সেখানে প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, ছাত্র, সমাজ ও কমিউনিটি অর্থাৎ আমাদের সবার প্রস্তুতির বিষয় রয়েছে। আবার প্রস্তুতিপর্বে অনেক ভুল হতে পারে, সেই ভুলত্রুটি নিয়ে আমরা যদি সব সময় এ ধরনের দুঃসংবাদ চর্চা করি, সেটি একসময় আমাদের মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। এ ধরনের ট্রল বা সংবাদের গ্রাহকসংখ্যা যদি বেড়ে যায়, তবে একদল মানুষ সেখান থেকে অর্থনৈতিকভাবে ফায়দা লুটবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। তখন শিক্ষার চেয়ে কুশিক্ষা-অশিক্ষা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। এই পরিস্থিতির দায় বর্তায় তখন আমাদের সবার কাঁধে। এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করে একদল মানুষ টাকা কামিয়ে যাচ্ছে, আমরা যতই এ ধরনের ট্রল বা ফানকে ফ্রি মনে করি না কেন, আসলে ‘নাথিং ইজ ফ্রি’। পকেটের টাকা চলে যাচ্ছে ইন্টারনেটে।

একই সঙ্গে আমাদের মূল্যবোধ ও স্বাধীন চিন্তা সঠিক পথ হারাচ্ছে। চলচ্চিত্র শিল্প নিয়েও এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। হলিউডের ব্যবসায় মোটামুটি ভেঙে পড়ার দশা হয়েছিল। পর্নোগ্রাফির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠলে মানুষ সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ পর্নোগ্রাফি অর্থনীতি একসময় চলচ্চিত্রশিল্পকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এখনো কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই ব্যবসার বাজার রমরমা। সেই বিবেচনায় আমাদের দেশে মানুষের যথেষ্ট সতর্ক থাকার কারণ রয়েছে। কেউ টাকা আয় করুন, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু সেই টাকা আয় করতে গিয়ে যদি আমাদের টাকা চলে যায়, আমাদের মূল্যবোধ, সম্মান, আত্মসম্মান—সবকিছু খোয়া যায়, তখন সেটি নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে।

অনেক সময়ই দেখি কোনো একজন উঠতি শিল্পীকে নিয়ে মিডিয়ায় তুমুল হইচই হয়। ভিন্ন একটি দেশের মিডিয়া আমাদের কোনো এক তরুণ শিল্পীকে প্রচুর স্পেস দেয়। আমরা অনেক সময়ই বুঝি না যে বাংলাদেশ থেকে কাউকে নিয়ে সেখানে স্টার বানানোর কারণ কী। এই স্পেসের পেছনে থাকে দর্শক ভাগিয়ে নেওয়ার কৌশল। তাদের ‘মিডিয়া টাইম’ এ দেশে অনেক দামে বিক্রি হয়। একই সময়ে ওখানের বিজ্ঞাপন পণ্য এখানে চালু করা হয়। একটা সময় বাদে ওই সব আর্টিস্টকে ছুড়ে ফেলা হয়। আবার শিল্পীরও অশিল্পীসুলভ আচরণ আমরা দেখি। শিল্পীকে মানুষ নিজের মনের ভেতরে নায়ক হিসেবে স্থান দেয়। সেই নায়ক যখন ভ্রষ্টাচারে লিপ্ত হন বা যেনতেনভাবে সমকালকে মোকাবিলা করতে চান, তখনই মূলত বিপত্তি দেখা দেয়। কেউ কেউ আবার অযাচিতভাবে শিল্পী হয়ে উঠতে চান, সমাজে উৎপাতের কারণ হয়ে দাঁড়ান। এই কথিত শিল্পী হয়ে ওঠার পথে তাঁকে শক্তি জোগায় তাঁর লোকবল ও অর্থ। অর্থ যে অনর্থের কারণ হতে পারে এসব শিল্পীকে দেখলে প্রমাণ মিলবে।

আমরা যখন কোনো সিনেমা দেখি, নাটক দেখি, আমরা কিন্তু জানি এসব ঘটনা বাস্তব নয়। অনেক সময় একথা বলেও দেওয়া হয় যে গল্পের প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক। আবার শিল্পী তৈরির জন্য রিয়েলিটি শোর আয়োজন দেখি। রিয়েলিটি শোতে সব সময় মানুষকে রিয়েলিটির নাম করে একটা নিরীক্ষা করা হয়—সেটি এসএমএস দেওয়ার জন্য হোক বা অন্য কিছু। সাম্প্রতিক সময়ে ওষুধের নানা কম্বিনেশনে করোনার চিকিৎসার কথাই ধরা যাক। আজ এই কম্বিনেশন, কাল ওই কম্বিনেশন। সুরসুর করে হাতের শেষ সম্বলে খাবারের বদলে ওষুধ কিনে মজুত বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে। একদিকে যেমন মানুষ শেষ সম্বল-সঞ্চয় খরচ করে ওষুধ কিনছে অন্যদিকে এই দুর্যোগে নতুন ওষুধ বা ভ্যাকসিনের খবরের সত্যাসত্য সন্ধ্যানে পুরো ইন্টারনেট দুনিয়া ঘুরে ফিরছে। আশা-নিরাশার দোলাচলে এ কেমন রিয়েলিটি অথবা শো? পৃথিবীর এই বিপদের দিনে এসব আনরিয়েল কর্মকাণ্ড নিয়েও আমাদের বিস্তর সচেতনতা প্রয়োজন।

লেখক: পরিচালক, স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি