আম্পান, করোনা ও অনিরাপদ পানি: স্বাস্থ্যঝুঁকিতে সোনার বাংলা

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

পরিবার-পরিজন থেকে দূরে, তারপরও দেশজুড়ে উৎসবের আমেজে মাতোয়ারা বাঙালি জাতি। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর দোরগোড়ায়। করোনার ভীতি প্রায় চাপা পড়েই গিয়েছিল ঈদের আমেজে, এরই মধ্যে এ বছরের সবচেয়ে ভয়ংকর দিনটির সাক্ষী হতে হলো বাংলাদেশকে। করোনা ও আম্পানের সম্মিলিত তাণ্ডবে একই দিনে ৩৪টি মৃতমুখ আছড়ে পড়ল দেশের মাটিতে। করোনাভাইরাসের সঙ্গে সামান্তরালে যুক্ত হলো সুপার সাইক্লোন আম্পান। ৭ জেলায় একই দিনে কেড়ে নিল ১২টি তাজা প্রাণ,আপাতদৃষ্টিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি।

নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশকে সম্মুখীন হতে হয় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের। চলমান করোনাভাইরাসের প্রকোপে শুরু থেকেই ত্রাসের মুখে রয়েছে দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ, এরই মধ্যে আম্পানের কবলে পুনরায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দেশের লাখো মানুষ। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হলেও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি—এমন অভিযোগের পাশাপাশি বর্তমানে ভীতির সঞ্চার করছে ঘূর্ণিঝড়–পরবর্তী বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের আশঙ্কা।

পানির অপর নাম জীবন হলেও দূষিত পানি হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে জীবননাশের কারণ। আবহমানকাল থেকে কলেরা, ডায়রিয়া, জন্ডিসের মতন বিবিধ পানিবাহিত রোগের সঙ্গে পরিচিত বঙ্গদেশের মানুষ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজির তথ্যমতে, ক্যানসারের মতন মারাত্মক রোগও হতে পারে দূষিত পানির কারণে। তাদের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, দূষিত পানিতে উপস্থিত কিছু রাসায়নিক উপাদানের কারণে মানুষের অগ্ন্যাশয়ের কার্যক্ষমতা কমে যায়। ফলে ইনসুলিনের নিঃসরণ কমে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে ডায়াবেটিসে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে অনিরাপদ পানি পানে শরীরে জমা হয় বিষাক্ত পদার্থ, যা ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় কিডনি ও লিভারকেন্দ্রিক বিভিন্ন রোগের।

মানবদেহের শতকরা ৬০-৬৬ ভাগই পানি। দৈনিক প্রয়োজনমতো পানি না পান করলে বিঘ্নিত হয় আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ পরিপাকপ্রণালি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমিক অব সায়েন্সের গবেষকেরা মনে করেন, মানুষের পানি চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশই পূরণ হয় স্বাস্থ্যকর খাবারের মাধ্যমে। এরপরও একজন পূর্ণ বয়স্কের রোজ ২-৩ লিটার পানি খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করেন অনেকেই।

বিশুদ্ধ পানি বলতে স্বচ্ছ, বর্ণহীন, গন্ধহীন, ভাসমান জৈব ও অজৈব পদার্থের উপস্থিতিবিহীন এবং রোগজীবাণুমুক্ত পানিকে বোঝায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সম্মিলিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের নাগালে পানির উৎস থাকলেও তার সব পানের যোগ্য নয়। শতকরা ৫৬টি উৎস থেকে সুপেয় পানি পাওয়া যায় এবং প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মাত্র ৩৬ ভাগ মানুষের কাছে নিরাপদ পানি পৌঁছায়। ভূপ্রকৃতির গভীরে বিশুদ্ধ পানি সঞ্চায়িত থাকলেও ঘূর্ণিঝড়, খরা, বন্যার মতো নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে দূষণের কবলে পড়তে পারে ভূগর্ভস্থ নিরাপদ পানিকেও। ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও বর্তমান করোনা–বিধ্বস্ততার কারণে আশঙ্কাজনক স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় বর্তমানে নিরাপদ ও পরিমিত পানি পান করার বিষয়টি এখন বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।

বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের গৃহব্যবস্থাপনা ও গৃহায়ণ বিভাগের প্রভাষক শারমিন সুলতানার মতে, ‘পানি পরিচ্ছন্ন রাখাটা যতটা সহজ, বিশুদ্ধকরণ অতটাও সহজ নয়। আমাদের দেশের অনেকেরই একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, মাত্র ফিল্টার করলেই পানি বিশুদ্ধ হয়ে যায়। সাধারণত ফিল্টারের মাধ্যমে পানিতে বিদ্যমান ক্ষতিকর ধাতু পরিশুদ্ধ হলেও মাইক্রো–অর্গানিজম বা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস থেকে যায় বিধায় ফিল্টারকৃত পানি পানেও হতে পারে জটিল-কঠিন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়াবাহিত রোগ।

ফোটানো, ছাঁকন, পটাশ, ফিটকিরি, আয়োডিন প্রভৃতি বিশুদ্ধকরণের পদ্ধতি বিদ্যমান থাকলেও সব থেকে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক পদ্ধতি উচ্চতাপে ১০-২০ মিনিট ফুটিয়ে ছেঁকে পানি পান করা। এতে ক্ষতিকর রোগজীবাণু ধ্বংস হয়ে যায় এবং বিদ্যমান ধাতব লবণ থিতিয়ে পড়ে যায়, সঙ্গে দ্রবীভূত গ্যাসও বের হয়ে যায়। আবার শহর অঞ্চলে প্রাপ্ত ট্যাপের পানি মূলত ব্লিচিং পাউডার ও ক্লোরিন দিয়ে পরিশোধিত করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চুল পড়া ও ত্বক খসখসে হওয়ার অন্যতম কারণ। এ কারণে পানি সর্বদা ফুটিয়ে পান করাই উত্তম রোগব্যাধি এড়ানোর জন্য।

সুপার সাইক্লোন আম্পানের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে। ইতিমধ্যেই করোনা পরিস্থিতিতে দেশীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা নাজুক। এই মুহূর্তে অনিরাপদ পানি পান জনগণকে ঠেলে দিতে পারে স্বাস্থ্য অনিরাপত্তার দিকে। সরকারি ব্যবস্থার পাশাপাশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে সাধারণ মানুষকেও। তবেই দুর্যোগগুলো মোকাবিলা করে পুনরায় প্রাণখোলা নিশ্বাস নেওয়া সম্ভব হবে সোনার বাংলার মাটিতে।

* লেখক: শিক্ষার্থী: এমএস ইন ফার্মাকোলোজি, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর