দেশের স্বার্থে বলি হওয়া অন্যরকম টিএসসি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ১ম বর্ষের প্রথম দিকে দিনের প্রায় অর্ধেক সময় কাটতো ঢাবির প্রাণ খ্যাত টিএসসিতে। বন্ধুদের সাথে টিএসসিতে বসে চা খেতে খেতে টিএসসির অপরুপ সৌন্দর্য এর দিকে সবসময়ে তাকিয়ে থাকতাম। উপরে নীল আকাশ তার নিচে সারি সারি সবুজের সমারোহ একেবারে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত। শুধু আমি নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা শিক্ষার্থীর জন্যই প্রতিটা গাছের ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন। প্রতিটা গাছের সাথেই কারো না কারো স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। কেউ নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সাথে গাছের নিচে বসে নিজের অতীতের কথা চোখ ভিজিয়ে ভিজিয়ে তুলে ধরছে, কেউ নিজের প্রিয়তমা কে নিয়ে গাছের নিচে হাতে হাত ধরে সুখ দুঃখের গল্প করছে।

আবার দেখা যায় হঠাৎ কোন প্রতিবাদ মিছিল আসছে টিএসসির দিকে, গন্তব্য রাজু ভাস্কর্য। বাঙালীর আন্দোলনের প্রেরণা রাজু ভাস্কর্যেরর নিচে এসে স্লোগান দিচ্ছে কেউ, কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ভাষণ দিচ্ছে আবার যখন তীব্র গরমে তাদের নাজেহাল অবস্থা হয়ে যাচ্ছে টিএসসির গাছগুলোর নিচে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। চা খাচ্ছে পানি খাচ্ছে আবার যখন একটু শরীরটা ভালো হচ্ছে আবার রাজুতে দৌড় দিচ্ছে আবার সেই স্লোগান আবার জ্বালাময়ী ভাষণ। আমি এগুলো যতই দেখতাম ততই মুগ্ধ হতাম।


এগুলো তখনকার ঘটনা যখন ঢাবির বিষফোঁড়া মেট্রোরেলের কাজ শুরু হয় নি। এখন এগুলো যেন স্বপ্নের মতো, এখনকার ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীরা এগুলো আর দেখতে পারবে না। কীভাবে দেখবে? বর্তমানে। টিএসসি মানেই আবর্জনা, ধুলা ময়লার একটা স্তুপ। আগে য টিএসসিতে সবসময়ই একটা বিশুদ্ধ, শীতল বাতাস পাওয়া যেত। এখন এর বদলে পাওয়া যায় ধুলার গন্ধ, গাছের বদলে দেখা যায় উচু উচু মেট্রোর পিলার। আগে টিএসসিতে পাখির কলরোব শোনা যেত, শোনায যেত কোকিলের ডাক কিন্তু এখন সেটা শুধুইমাত্র সুন্দর স্বপ্নের মত হয়ে গেছে। এখন এখানে স্নিগ্ধ বাতাস পাওয়া যায় না, পাখির কলরোব শোনা যায় না, এখানে আন্দোলনরত নতুন বাংলাদেশের যোদ্ধারা পায় না বিশ্রাম নেওয়ার মত কোনন ছায়া।


বর্তমানে লকডাউনে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। তবে, লকডাউনে একদিন থেকে ভালোই হয়েছে পুরো বিশ্বের প্রকৃতি তার পুরনো আভা, জৌলুস ফিরে পাচ্ছে। লকডাউনের কারনে মিল কারখানা বড় বড় প্রজেক্ট বন্ধ থাকায়, নতুন করে গাছপালা নিধন বন্ধ থাকায় পৃথীবি ফিরে পাচ্ছে তার পুরানো জৌলুস। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠছে এতোদিন অসুস্থ থাকা ওজোন স্তর। প্রকৃতি তার নিজের প্রতিশোধ নিচ্ছে। পৃথীবি বুঝতে পারছে প্রকৃতির সাথে খেললে পরিণাম কি হতে পারে। পুরো পৃথীবি বর্তমানে যেখানে ভাবছে প্রকৃতির ভারসাম্য আর কীভাবে নষ্ট না করা যায় সেখানে হঠাৎ বাংলাদেশ হাটছে উল্টো পথে। এই লক ডাউনের ভিতরই টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সব কেটে ফেলা হয়েছে। নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে প্রকৃতির আশির্বাদকে। টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর এখন শুধু ধু ধু করছে। টিএসসির বুক থেকে প্রতিটা রক্তের বিন্দু চুষে চুষে বের করে নেওয়া হয়েছে। প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে বন্ধুদের সাথে আড্ডার প্রিয় জায়গাটা আর দেখা হবে না, দেখা হবে না প্রিয়তমার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গাছটা। হয়তো কাটার সময় গাছগুলো বলছিল আমি দাঁড়িয়ে থাকতে চাই, আমি বেঁচে থাকতে চায় এখানেই যেখানে জন্ম হয়েছিল নতুন একটা দেশের। সেই দেশের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গৌরবের সাথে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে চায় কিন্তু কোন পাষাণের কানে পৌছে নি সেই আওয়াজ। কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটিকে। জাতীয় স্বার্থে বলি দেওয়া হয়েছে তাকে।


সর্বোপরী মেট্রোরেলের কাজ শুরু হয়েছে অনেক আগেই। মেট্রোর বিরুদ্ধে আন্দোলনও কম হয় নি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর আঘাত এসেছে, গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আন্দোলন। নিজেদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে আপোষ করা হয়েছে ঐতিহ্যের সাথে, সৌন্দর্য এর সাথে। তবে, এখানে প্রশাসনের দুর্বলতা প্রথমেই ছিল। মেট্রো যখন ঢাবিতে রুট করবে বলা হয় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তাদের মতামত জানতে চায় সরকার কিন্তু নিজেদের স্বার্থে নো অবজেক্জেশন সার্টিফিকেট দিয়ে দেয় তখনকার ঢাবি প্রশাসন কোন বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা ছাড়াই। প্রশ্ন এখানে প্রথম থেকেই ছিল বুয়েট যদি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার রিজেক্ট করতে পারে ঢাবি কেন মেট্রো রিজেক্ট করে নাই তখন? তাহলে কি শুধু সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আকর্ষণ পাওয়ার লোভেই নো অব্জেকশন সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হয়? পঙ্গু করে ফেলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে?


হঠাৎ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আবার মাথাচারা দিয়ে উঠেছে নো মেট্রো অন ডিইউ স্লোগানে। হয়তো কিছুদিন আন্দোলন চলবে তারপর আবার আক্রমণের শিকার হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে আন্দোলন। তখন কোন বাধা ছাড়াই তৈরী হবে মেট্রো রুট, তৈরী হবে স্টেশন। লোকে গিজগিজ করবে টিএসসি স্টেশনে। টিএসসির সৌন্দর্য, একসাথে গল্পগুজব সবই হয়ে যাবে ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের নিকট। এমনিভাবেই দেশের স্বার্থে বলি হয়ে যাবে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ।

*লেখক: শিক্ষার্থী, ২য় বর্ষ ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়