আইলার ক্ষতের মধ্যেই আম্পান আঘাত

শ্যামনগরে আম্পানে ভেঙে যাওয়া বাঁধ ভেঙে এলাকায় ঢুকছে পানি। ছবি: সংগৃহীত
শ্যামনগরে আম্পানে ভেঙে যাওয়া বাঁধ ভেঙে এলাকায় ঢুকছে পানি। ছবি: সংগৃহীত

১১ বছর আগে আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় আইলা। আইলায় দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়া এবং জলোচ্ছ্বাসে এলাকা প্লাবিত হওয়া। এ ছাড়া মানুষের ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি, মৎস্যসম্পদসহ অন্যান্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এমনকি মানুষের প্রাণহানিও ঘটে আইলায়।

আইলার সময়ে আশ্রয়হীন মানুষগুলো আশ্রয় গ্রহণ করে বেড়িবাঁধের ওপর, আশ্রয়কেন্দ্রে অথবা নিকট আত্মীয়সহ অন্যান্য স্থানে। এরপর আরও আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মহসিন, বুলবুল, ফণীসহ ছোটখাটো দুর্যোগ। এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করে উঠতে না উঠতেই আবার আঘাত হানল আম্পান (২০ মে)।

আইলায় অনেক পরিবার গৃহহীন হয়ে সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় গৃহনির্মাণ করলেও অনেকের স্বপ্ন ভেঙে দিল ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এলাকাবাসীর বক্তব্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের পাশাপাশি বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হওয়ায় অনেকে এবার ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পারেননি। বিশেষ করে একদিকে মহামারি করোনার প্রকোপ আবার অন্য দিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আস্ফালন।

শ্যামনগর প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন। দুর্গত মানুষের সংখ্যা ৭৬ হাজার ২৩১ জন, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ১৫ হাজার ৫১২টি, এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতি ৪ হাজার ৩২২টি। উপজেলার ‘সাদাসোনা’ খ্যাত চিংড়িঘের ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজারটি যার আয়তন ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর। সাদা মাছের ক্ষতি ৫৬৪ মেট্রিক টন, রেণু পোনা ক্ষতি সাধিত হয়েছে ৯ লাখ পিচ, গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্ষতি হয়েছে ৩ হাজার ২১০ টন, আমের ক্ষতি হয়েছে ৭২৮ টন। বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার।

উপজেলার আদিবাসী মুন্ডা সংগঠন সামসের নির্বাহী পরিচালক কৃষ্ণপদ মুন্ডা বলেন, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত মুন্ডা পরিবার হলো ৪১০টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ১ হাজার ৪১৫। এদের মধ্যে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৩১ জনের। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে ৮৩ জনের।

উপজেলায় এমনিতে সুপেয় পানির সংকট আছে। এর মধ্যে আইলা–পরবর্তী মিষ্টি পানির সংকট বেড়ে যায়। এমনিভাবে আম্পানের কারণে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে এলাকায়।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানায়, ২৩ মে পর্যন্ত এলাকাতে ৬০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। টিউবওয়েল সংস্কার করা হয়েছে ১৩৩টি, টিউবওয়েল জীবাণুমুক্ত হয়েছে ১৮৭টি, পানির জেরিক্যান ১০ লিটার বিশিষ্ট বিতরণ করা হয়েছে ৫০০টি। এ ছাড়া বিভিন্ন এনজিও পানি সরবরাহ করছেন দুর্গত এলাকাতে।

আম্পানে উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুর ও কাশিমাড়ী ইউনিয়নের ১৫টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এর মধ্যে ইতিমধ্যে এলাকাবাসী পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তায় প্রায় ১০টি পয়েন্ট বেঁধে ফেলেছেন। বড় ধরনের ভাঙনগুলো এখনো বাঁধা সম্ভব হয়নি, তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এলাকাবাসী।

উপজেলার পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করছেন লির্ডাসের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার। তিনি বলেন, আইলার পরও বেড়িবাঁধগুলোর বড় ধরনের কাজ হয়নি ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাঝেমধ্যে এবং আম্পানেও ভেঙেছে। এলাকাবাসীর দাবি ত্রাণ চাই না বাঁধ চাই।

প্লাবিত এলাকা। ছবি: সংগৃহীত
প্লাবিত এলাকা। ছবি: সংগৃহীত

এদিকে গত ২৩ মে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবেরা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী ভাঙনকৃত বাঁধ পরিদর্শন করেছেন। তাঁরা বলেছেন এই এলাকায় আগামী তিন বছরের মধ্যে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে ভাঙনকৃত স্থানগুলো বাঁধা হবে।

ইতিমধ্যে দুর্গত এলাকায় বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক পরিদর্শন করেছেন এবং দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন এবং করছেন। ঈদের আগের দিন সাইক্লোন শেল্টারে অবস্থানকারীদের মধ্যে উপজেলা প্রশাসন থেকে ঈদ উপহারসামগ্রীসহ অন্যান্য উপহার বিতরণ করা হয়েছে।

দুর্গত এলাকার মানুষের দাবি উপজেলায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের। এলাকাবাসী জানান, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের একদিকে করোনাভাইরাসের প্রকোপ অন্যদিকে আম্পন মোকাবিলা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। এ মুহূর্তে দুর্গতদের পাশে সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসা জরুরি।