গোটা ভারতে অধিনায়কের নাম একটাই

আপনার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, প্রথমবার এভারেস্ট জয় করেন কে? মস্তিষ্ক একঝটকায় ছোটবেলায় পড়া সাধারণ জ্ঞান বইয়ে নিয়ে যাবে। জবাব আসবে, শেরপা তেনজিং। আপনাকে যদি আবার জিজ্ঞেস করা হয়, প্রথমবার এভারেস্ট জয় করার চেষ্টা করেন কে? কিংবা কে প্রথম অর্ধেক বা তার চেয়ে বেশি উঠেও ব্যর্থ হোন? নিশ্চিতভাবে জবাবটা আপনার জানা নেই। আমিও যে জেনে বসে আছি তেমন নয়। আমাদের চিরাচরিত অভ্যাস, আমরা দ্বিতীয় হওয়া বা চেষ্টা করে ব্যর্থ কিংবা লড়াইয়ের মন্ত্র জপে দেওয়া লোকদের খুব একটা মনে রাখি না অথবা রোজকার জীবনে নাম নেই না তাঁদের।

শিরোনামে ‘অধিনায়ক’ আর শুরুতে এভারেস্ট, সাধারণ জ্ঞান, ভুলে যাওয়ার অভ্যাস এসব কী? ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ মনে হচ্ছে? ফিরছি অধিনায়কেই।


ওয়াংখেড়ের সেই মায়াবী রাত মনে আছে? এই তো কিছুদিন আগে অমরত্ব পেয়ে যাওয়া অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির সেই মিড অনের ওপর দিয়ে মারা বিশাল ছয়ে ভারতের ২৮ বছরের আক্ষেপ মেটানো। ওয়েংখেড়ে পেরিয়ে সেদিন পুরো ভারতে উৎসবের রং হয়েছিল নীল। চোখ বন্ধ করুন একবার, আপনি ফিরে যাবেন সেই ছয়ে, সেই শচীন টেন্ডুলকার ভারতের পতাকা ওড়াচ্ছেন বিরাট কোহলিদের কাঁধে চেপে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন কিন্তু ‘সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না’ সেই পুরোনো প্রবাদ সত্যি করে ওয়েংখেড়ের ফাইনালের নয় বছর পেরিয়ে গেছে, পেরিয়ে গেছে আরও দুটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ২০১১ বিশ্বকাপ যাদের কাঁধে চড়ে জিতল ভারত, তাদের লড়াইয়ের মন্ত্রটা কে শিখিয়েছিলেন মনে পড়ে? মনে করা যায় তাদের পুরোনো এক অধিনায়ককে? মনে করাচ্ছি, নামটা সৌরভ গাঙ্গুলী।


ম্যাচ গড়াপেটায় যখন ভারতীয় ক্রিকেট আকাশে ঘোর অন্ধকার, তখনি একছিটে আলো হয়ে হাজির সৌরভ। দেশের মাটিতে জয় এলেও দল ব্যর্থ বিদেশের মাটিতে, টেস্টে তো লেজেগোবরে অবস্থা। এই পরাজয়ের বৃত্ত থেকে বের হতে শেখালেন সৌরভ। শেখালেন স্লেজিংয়ের জবাব দিতে হয় স্লেজিংয়ে, উইলোর টুকরো আর কোকাবুরা বল তো রয়েছেই জবাব দেওয়ার জন্য। যেন সবাইকে জানালেন, ‘আমি বিদেশের মাটিতেও জিততে চাই, তোমরা কে কে আছ লড়বে?’ যে স্বপ্নবাজ ক্রিকেটাররা ড্রেসিংরুমে পরাজয়ের হতাশায় ডুবে যেত, তাদের চোখে এঁকে দেন বিশ্বকাপ জয়ের রঙিন স্বপ্ন, বিদেশের মাটিতেও টেস্ট জয়ের তাড়না। পরে দলকে নিয়ে যান বিশ্বমঞ্চের ফাইনালেও।


আপনি ক্রিকেট ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্র হলে কিংবা টুকটাক ক্রিকেট রেকর্ডস জানা থাকলে, ইতিমধ্যে জেনে গেছেন ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে বিদেশের মাটিতে সর্বোচ্চ টেস্ট জেতা অধিনায়ক বিরাট কোহলি। মাসখানেক আগে যে রেকর্ড নিজের করেন কোহলি। রেকর্ডবুকের পাতায় নাম লেখা থাকে, হৃদয়ে থেকে যায় পারফরম্যান্স আর ম্যাচ জেতার তাড়না। সেই তাড়না ভারতকে শিখিয়ে গিয়েছেন সৌরভ। ভারতীয় ক্রিকেটে অধিনায়কের নাম ওই একটাই।


অধিনায়ক সৌরভ সব সময় দল বানানোর সময় চাইতেন একাদশে যেন ম্যাচ জেতানো ক্রিকেটার থাকে, ড্র করানো বা ড্রয়ের চিন্তায় খেলা ক্রিকেটার ছিল অপছন্দের তালিকায়। জেতাই ছিল তাঁর শেষ কথা। প্রতিপক্ষ আপনার চেয়ে ভালো হতে পারে কিন্তু আপনি যেদিন প্রতিপক্ষ থেকে এগিয়ে থাকবেন, সেদিন জিততেই হবে আপনাকে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সময়টা নিয়ে নিতেন নিজের কাছে, যা বলতেন, তা–ই শুনত ক্রিকেটাররা।


মিডল অর্ডার থেকে বীরেন্দর শেওয়াগকে নিয়ে আসেন ওপেনিংয়ে। যে সিদ্ধান্ত ভারতীয় ক্রিকেটের খোলনলচে বদলে দিয়েছিল। শেওয়াগকে বলেছিলেন: ‘দেখ বীরু, কেউ ওপেনার হয়ে জন্ম নেয় না, খেলে হতে হয়। হেইডেন-ল্যাঙ্গার পারলে তুইও পারবি।’ শেওয়াগকে সুযোগ দিতে নিজের পছন্দের ওপেনিং পজিশন ছেড়ে নেমে যান ওয়ান ডাউনে। শুরুতে ভেবেছিলেন ওপেনারদের কাজ ছিল বল ছেড়ে ছেড়ে পুরোনো করা, শেওয়াগের ভেতরের আগুন দেখে বুঝেছিলেন এই ওপেনারের কাজ বল মেরে মেরে পুরোনো করা।


প্রায় একই গল্প বিশ্বকাপ নামক এভারেস্ট জয় করা অধিনায়ক ধোনির জন্যও। দলে এসে শুরুতে ব্যর্থ ছিলেন তিনি। অধিনায়ক সৌরভ দেখে বুঝেছিলেন, এর মধ্যে দম আছে। চেষ্টায় ছিলেন তা বের করে আনার। বিশাখাপত্তনমে পাকিস্তানের বিপক্ষে যথারীতি ধোনির ব্যাট করার কথা ছিল নিচের দিকে। টসের পর সিদ্ধান্ত নিলেন একে তিন নম্বরে পাঠানো যায়। ধোনিকে তিনে খেলানোর জন্য নিজে নেমে গেলেন চার নম্বরে। প্রতিদান হিসেবে পেলেন ধোনির শতক আর এক ভবিষ্যৎ ব্যাটিং কান্ডারির আত্মপরিচয়।


শুধু নিজে সতীর্থদের ভালোবাসতেন, তা–ই নয়, তারাও তাঁকে ভালোবাসতেন, সম্মান করতেন। এক ঘটনা বলা যাক, সবাই মিলে উৎসাহিত করার জন্য একবার মজা করেন সৌরভের সঙ্গে। সকালে অনুশীলনের আগে সৌরভ মাঠে গেলেন। ওই সময়ে সবাই তাঁকে ঘিরে দাঁড়ালেন। বললেন, খেলব না তোমার নেতৃত্বে। জহির বললেন, ‘আমি নাকি পরিশ্রম করি না।’ এরপরে যুবরাজ বললেন, ‘তুমি বলেছ আমি নাকি রাতে বেশি ব্যস্ত থাকি।’ দ্রাবিড় বললেন, ‘আমি নাকি তোমার নেতৃত্বে নিজের শতভাগ দিই না!’ সৌরভ অবাক সবার কথায়, বললেন, এসব কবে বললাম? হরভজন একটা নিউজের কপি দেখালেন। সৌরভ হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমি এসব কবে বলছি, তোরা রিপোর্টারকে কল দে।’ এরপর সৌরভের যখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা, তখন হরভজন আরেকটা কাগজ আনলেন। সৌরভ হাতে নিয়ে দেখলেন সেখানে লেখা, ‘উই লাভ ইউ দাদা। তারিখটা ভুলে গেলা?’ সৌরভ খেয়াল করে দেখলেন পয়লা এপ্রিল। তখন সবাই সৌরভকে জড়িয়ে ধরলেন। কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা সবার। এমনই ছিল অধিনায়কের সঙ্গে সবার সম্পর্ক।


অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ ওয়াংখেড়েতে জেতে জার্সি খুলে উদযাপন করলেন, সেই জার্সি খোলার জবাব দিয়েছিলেন বিখ্যাত লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জার্সি খুলেই। সেই ঔদ্ধত্য, সেই জবাব দেওয়ার তাড়না। একবার বলেছিলেন, ‘জীবনে যা–ই করো, যত টাকাই কামাও, ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পর একজন ক্রিকেটারের জন্য জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত দেশের জন্য খেলাটা, ব্যাট হাতে মাঠে নামাটা। একটা গতির পেসারের বলে তুমি যখন কাভার ড্রাইভ করো, ব্যাটের মাঝে যখন বল লাগে, কাভার আর মিড অফের মাঝ দিয়ে বলটা যখন যায় আর সবাই যখন তালি বাজায়; ওই আনন্দ আর তোমাকে কখনো দেবে না।’ সত্যিই তো তা–ই, একজন ক্রিকেটারের কাছে এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কীই–বা হতে পারে?


পরিসংখ্যানের পাতা জানাবে কোহলি ভারতের হয়ে বিদেশের মাটিতে সবচেয়ে বেশি টেস্ট জয় পেয়েছেন, ওয়াংখেড়ের রূপকথার নায়ক ধোনি। সবকিছুর পেছনের গল্প থাকে, সেই পেছনের গল্প বলবে সৌরভের কথা, সৌরভের লড়াইয়ের কথা, সৌরভের দলকে একসুতোর মালায় গাঁথার কথা। পুরো ভারতের রাজপথ, গলি ক্রিকেট কিংবা কোন রঞ্জি, ইরানি, দিলীপ ট্রফি বা অন্য যেকোনো ম্যাচ—যেখানেই কোনো অধিনায়ক দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাবেন, সেখানেই জিতে যাবেন সৌরভ। যতবার কোনো অধিনায়ক বলবেন, ‘আমি লড়ব, কে কে আছিস সাথে?’ ততবার জিতে যাবেন সৌরভ, ততবার জিতে যাবে সেই ম্যাচ জয়ের তাড়না। হয়তো ততবারই জিতে যাবে সৌরভের নেতৃত্বগুণে মুগ্ধ হয়ে ভিন্ন এক দেশের কোনো মফস্বলে বসে কারও বলা, ‘অধিনায়কের নাম একটাই’ কথাটাও। হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না...


*লেখক: শিক্ষার্থী