করোনায় পুলিশকে আবার চিনলাম আমরা

মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার—স্লোগান সামনে রেখে অধিকতর জনকল্যাণমুখী সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশ যখন এগিয়ে চলছিল, ঠিক তখনই জনবান্ধব পুলিশিং রূপ নেয় অপ্রতিরোধ্য মানবিক পুলিশিংয়ে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে যখন দেশের প্রায় সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, তখন অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় বাংলাদেশ পুলিশ। সবকিছু উপেক্ষা করে নিজেদের বুক এগিয়ে দেয় করোনাযুদ্ধে জনগণকে রক্ষার দৃঢ় সংকল্পে। এ যুদ্ধে ২৬ মে পর্যন্ত জনগণের সেবা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের ৪ হাজার ৫৩ জন সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন পুলিশ সদস্য দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। ঠিক যেভাবে স্বাধীনতা–আন্দোলনে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাংলাদেশ পুলিশ। এই মানবিক বিপর্যয়কালে নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে আবার প্রতিরোধের ডাক দেয় বাংলাদেশ পুলিশ।

জঙ্গিবাদ দমন, মাদক নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাস দমন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণ ও জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের ভূমিকা সর্বমহলে প্রশংসিত।

পুলিশকে নিয়ে সব সময় জনমনে আস্থা ও অনাস্থার বিষয়টি সামনে আসে। জনগণের প্রত্যাশা থাকে সবকিছু পুলিশের নখদর্পণে থাকবে। পুলিশকে নিয়ে মানুষের চাহিদার কমতি নেই। চাহিদা পূরণে ব্যাঘাত ঘটলেই অনাস্থার বিষয়টি সামনে আসে।

বাংলাদেশ পুলিশের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নজিরবিহীন ঘটনা। প্রান্তিক মানুষের কাছেও পৌঁছেছে ৯৯৯–এর সেবা। এর কার্যক্রমের ফলে সাধারণ মানুষের কাছে জরুরি সেবা ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশ সেবা প্রাপ্তি সহজতর হয়েছে, মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। আস্থার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া অনলাইনভিত্তিক সেবা প্রদান, মোবাইল অ্যাপস এবং তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণে বিভিন্ন সফটওয়্যার সংযোজন ও ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে জনগণের সেবাপ্রাপ্তি এখন অনেকটাই সহজ হয়েছে।

পুলিশ বলতেই একসময় চোখে ভাসত বন্দুক, গুলি, রাইফেল। নাটক কিংবা সিনেমায় দেখানো হয় কীভাবে পুলিশ শুধু অপরাধীদের পাকড়াও করে। কীভাবে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, মিছিল–মিটিং ছত্রভঙ্গ করতে হয়। কিন্তু মানবিক পুলিশিংয়ের বিষয়গুলো ছিল সাধারণ জনগণের কাছে একবারেই অজানা। করোনযুদ্ধের এই ময়দানে থেকে পুলিশ দেখিয়ে দিল মানবকল্যাণে নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে, পরিবারের মায়া ত্যাগ করে, জীবন বাজি রেখে জনকল্যাণে কীভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে হয়। পুলিশের নির্দিষ্ট কাজের বাইরে যে কত কাজ করতে হয়, তা অনেকের কাছেই ছিল অজানা। হয়তো লোকচক্ষুর অন্তরালে নীরবেই কাজ করে গেছে এত কাল। করোনাকালে সেসব অপ্রকাশিত মানবিক কার্যক্রমের উদাহরণ সামনে আসছে।

করোনাযুদ্ধে সবাইকে বলা হচ্ছে ঘরে থাকতে, কিন্তু জেগে আছে পুলিশ। মানুষকে ঘরে রাখার, ঘরে ভালো রাখার, নিরাপদে রাখার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অপ্রতিরোধ্য অগ্রণী সেনানির ভূমিকায় এই পুলিশ বাহিনী। করোনাকে প্রতিরোধে, দেশের মানুষকে নিরাপদে রাখতে নানামুখী পদক্ষেপ, ব্যতিক্রমী উদ্যোগ, সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীলতার যে অনন্য নজির আমরা পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে দেখেছি, তা হয়তো স্বল্পপরিসরে বোঝানো কঠিন, তারপরও কিছু উদাহরণ দেওয়া সমীচীন মনে করছি।

‘খাদ্য যাবে বাড়ি’ অভিনব পদ্ধতির অবতারণা করে চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশ। এই পদ্ধতি থেকে খাদ্যসামগ্রী পেতে আগ্রহীরা কিংবা অসহায় মানুষ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের হেল্প ডেস্ক, পুলিশ সুপারকে ফোন বা এসএমএস অথবা ফেসবুকে বিস্তারিত জানালে রাতের আঁধারে তাদের বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে পুলিশ। সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ জনসমাগম শনাক্তে ড্রোন ব্যবহার করে জনসমাগম চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে সন্দেহে গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে পাশে পড়ে থাকা লাশের কাছে যখন কেউ এগিয়ে আসেনি, দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রিকশাভ্যানে তুলে থানায় নিয়ে যান এক পুলিশ সদস্য।

আপনি ঘরে থাকুন, সচেতন থাকুন, নিজে বাঁচুন-পরিবার বাঁচান, দেশ বাঁচান—স্লোগানটি শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে মাইকিং করে ঠাকুরগাঁও সদর থানা–পুলিশ। বগুড়া শহরের চারমাথা এলাকায় প্রায় ২০ ফুট উচু বাঁশের তৈরি ওয়াচ টাওয়ারে বসে শহর নজরদারিতে রেখে মাইকে বিভিন্ন সচেতনতামূলক নির্দেশনা প্রচার করছে পুলিশ। পুরোনো কিছু জনপ্রিয় গান রিমেক করে কিংবা নিজেরাই গান রচনা করে জনগনকে সচেতন করছে চট্টগ্রাম, গাজীপুর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলা পুলিশ। শেরপুর জেলা পুলিশ চালু করেছে ‘নো মাস্ক, নো মেডিসিন’ ও ‘নো মাস্ক, নো বাজার’ ক্যাম্পেইন। ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হাতে নিয়েছে ফরিদপুরের পুলিশ বিভাগ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে করোনার প্রতীক–সংবলিত আলপনা এঁকে জনগণকে সচেতন করছে।

ঝিনাইদহে করোনার সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাজারে একমুখী প্রবেশ চালু করেছে পুলিশ। গুলশান বিভাগ পুলিশ অসহায়, দুস্থ, কর্মহীন, নিম্ন আয়ের চাকরিজীবী, নিম্নমধ্যবিত্তদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাহায্যে এগিয়ে আসে। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ছিন্নমূল মানুষের আহার জোটানোর কাজে সহায়তা করছে ডিএমপি। এক পুলিশ কর্মকর্তা মানিকগঞ্জে নিজের কেনা ১০ শতাংশ জমি দান করেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফনে। করোনায় আক্রান্ত লাশের দাফনে বাধা পেলে তাঁর জমিতে দাফন করা যাবে।

কেউ এগিয়ে না এলেও করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন-কাফন, জানাজা শেষ করে শরীয়তপুরের পুলিশ যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে। বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জের বেদে সম্প্রদায়ের এক যুবকের মৃত্যুর পর স্বজনেরা পালিয়ে গেলে লাশ দাফন করে পুলিশ। একইভাবে রাজধানীর খিলগাঁও, উত্তরা, টঙ্গী, সাভার, গাজীপুর, সাতক্ষীরার তালা, বগুড়ার শিবগঞ্জ, রাজশাহীর বাগমারাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বজন পরিজনহীন অবস্থায় বেশ কয়েকজনের দাফন-কাফনের দায়িত্ব পালন করেছে সংশ্লিষ্ট থানা–পুলিশ।

সমাজের তৃতীয় লিঙ্গ (হিজড়া) সম্প্রদায়ের অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ঢাকা রেঞ্জ পুলিশ। গাজীপুরের পুলিশ সুপার জেলা পুলিশের সব রেশন সামগ্রী সরাসরি অসহায় মানুষের ত্রাণ ঘোষণা দিয়ে সেসব খাদ্য ও ব্যবহার্য সামগ্রী নিয়ে নিজেই পৌঁছে যান ঘরে ঘরে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা মানুষের বাসায় বাজার পৌঁছে দিতে ‘ডোর টু ডোর শপ’ চালু করেছে।

এই করোনাকাল নিশ্চয়ই একদিন শেষ হবে। শুরু হবে আমাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম। তবে এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিজেদের সুরক্ষার দায়িত্ব অনেকাংশে নিজেদের নিতে হবে। পাশাপাশি আজকে যারা আমাদের সেবায় নিয়োজিত, তাদের সেবায়ও আমাদের নিয়োজিত করতে হবে। পুলিশ বাহিনী যেভাবে আমাদের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহার করা, ভিড় এড়িয়ে চলা, গরিব–অসহায় মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা, এগুলো আমরা নিজেরাও করতে পারি। বাংলাদেশ পুলিশের একটা বৃহৎ অংশ যেহেতু আক্রান্ত, তাদের সুরক্ষার বিষয়টিও জরুরি। যারা আমাদের সুরক্ষায়, আসুন তাদের নির্দেশনা মেনে চলি। দেশ ও দেশের জনগণের সেবক হিসেবে পুলিশ বাহিনীকে সহায়তা করি। নিজে ভালো থাকি, মানবিক পুলিশকে ভালো রাখি, নিজেদের ভবিষ্যৎ ভালো রাখার স্বার্থে। অদম্য পুলিশ এগিয়ে যাক, কল্যাণমুখী কার্যক্রম ত্বরান্বিত ও দীর্ঘজীবী হোক।

জয়তু বাংলাদেশ পুলিশ। অভিবাদন অদম্য অজেয় পুলিশ।
[email protected]