মহামারি মানেই কি মৃত্যুর মিছিল

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

সমকালীন পৃথিবী সবচেয়ে বড় যে যুদ্ধের মোকাবিলা করছে তা হচ্ছে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। এ যুদ্ধে কোনো রকম গুলি, বোমা বা কোনো ধরনের পরমাণু অস্ত্রও কার্যকর নয়। এই অসম মানবজাতি বনাম অদৃশ্য করোনা মহাযুদ্ধে লড়াই করার মতো কোনো অস্ত্র এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই পৃথিবীর কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ, যেখানে প্রতিপক্ষ একটি আণুবীক্ষণিক অণুজীব। যার ফলে ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এবং ৬০ লাখ মানুষকে আক্রান্ত করে কেড়ে নিয়েছে সাড়ে ৩ লাখের বেশি প্রাণ। এর ব্যাপকতা এত দ্রুতগামী যে আমজনতা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী এবং প্রবল শক্তিমানদেরও সে কোনো ছাড় দেয়নি।

এমন নয় যে, এই প্রথম পৃথিবী কোনো মহামারি প্রত্যক্ষ করছে। শত সহস্র বছর ধরে বিভিন্ন মহামারি লাখো মানুষের জীবন নিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন মহামারির মধ্যে প্লেগ এবং ফ্লুর নামই সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। কোনো সংক্রামক রোগ যখন বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুত সংক্রমিত হয়, তখন বলা হয়ে থাকে রোগটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো একটি অঞ্চল থেকে কোনো রোগ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে অনেক প্রাণনাশ করে, তখন একে বৈশ্বিক মহামারি বা প্যান্ডেমিক আখ্যা দেওয়া হয়। যেমনটি দেওয়া হয়েছে কোভিড-১৯কে।

পৃথিবীর প্রথম প্লেগ মহামারি শনাক্ত করা হয় গ্রিকের এথেন্সে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে। এ মহামারি গ্রামের পর গ্রাম জনমানবশূন্য করে দিয়েছিল। আবার অনেক ইতিহাসবিদদের মতে, ৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এথেন্সে মহামারি হয়েছিল টাইফয়েড, গুটিবসন্ত অথবা অ্যানথ্রাক্সের মাধ্যমে এবং ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। ২৫০ খ্রিষ্টাব্দে এক প্লেগ মহামারি রোমান সাম্রাজ্যকে বিপর্যস্ত করে দেয়। পরবর্তী দুই শতাব্দীতে বিউবনিক প্লেগে প্রায় ১০ কোটি মানুষ মারা যায়। এই রোগ মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ছড়ায়। মানুষসহ পশুপাখি, কীটপতঙ্গও মারা যায়।

৫৪০-৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে মিসরে এক ভয়ানক প্লেগের উৎপত্তি ঘটে, যা ছড়িয়েছিল ইঁদুরের মাধ্যমে। আক্রমণের হটস্পট ছিল বাইজান্টাইনের রাজধানী, যা বর্তমান ইস্তাম্বুল। ধারণা করা হয়, মহামারির চূড়ান্ত পর্যায়ে সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার মানুষ মারা যেত। ৫০ বছরে এ মহামারি আড়াই কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। প্রাচীন পৃথিবীর ভয়ানক এ মহামারিই ইউরোপে ডার্ক এজের সূচনা করেছিল।

১৩৩৪ সালে লন্ডনে প্লেগ ছড়ায় আসলে চীন থেকে। ইতালিতে ৬ মাসে মারা যায় ৯০ হাজার মানুষ এবং ইউরোপজুড়ে মারা যায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। ১৩৪৬ সালে ইউরোপের কৃষ্ণ সাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়ায় 'দ্য ব্ল্যাক ডেথ' নামে মহামারি। অনেক ইতিহাসবিদদের ধারণা, এটি প্লেগ, আবার অনেকের মতে, এটি ছড়িয়েছে ইবোলা ভাইরাসের মাধ্যমে। ১৩৪৭-১৩৫১ সালের মধ্যে ইউরোপের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এ মহামারি। এ অভিশপ্ত মহামারি কার্যকর ছিল অন্তত ২০০ বছর এবং ১০ কোটি মানুষের প্রাণনাশ করে।

১৫১৯ সালে বর্তমান মেক্সিকোতে স্মলপক্স ছড়িয়ে পড়ে এবং ২ বছরে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ মারা যায়। গবেষণা অনুযায়ী, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে আমেরিকা মহাদেশে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ১৬৩৩ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে স্মলপক্সের দ্বারা প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা যায়। ১৭৯৩ সালে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় ইয়েলো ফিভার মহামারির মাধ্যমে নগরীর দশ ভাগের এক ভাগ মানুষ মারা যায়, যা প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ।

১৮৬০ সালে তৃতীয়বারের মতো প্লেগের বিস্তৃতি ঘটে চীনের উহানে। বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকায় এটি ভারত, আফ্রিকা, ইকুয়েডর, যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। এটি প্রায় দুই দশক স্থায়ী ছিল এবং ১ কোটি ২০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। পরে ১৮৯০ সালে প্লেগের ভ্যাকসিন আসে। ১৯১০ সালে শতাব্দীর সবচেয়ে বড় প্লেগ মহামারি দেখা দেয় চীনের মাঞ্চুরিয়ায় এবং ২ বছরে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ মারা যায়। তবে এর বিস্তৃতি ছিল কম।

১৯১৬ সালে আমেরিকায় প্রথম পোলিও রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। নিউইয়র্কে ৯ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয় এবং ৬ হাজার মানুষই মৃত্যুবরণ করে। নিউইয়র্ক শহর থেকে ক্রমেই পোলিও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১৮ সালের নভেম্বরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর 'দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক'–এর আবির্ভাব হয়, যা 'স্প্যানিশ ফ্লু' নামে অধিক পরিচিত। বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এর সূচনা হলেও মহামারি আকারে বিস্তার ঘটে ১৯১৯ সালে। অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ে। মাত্র এক বছরেই এই প্যানডেমিক কেড়ে নেয় ৫ কোটির বেশি মানুষের প্রাণ।

১৯৫২ সালে আমেরিকায় পোলিওতে আক্রান্ত হয় ৬০ হাজার শিশু এবং ৩ হাজারের বেশি মারা যায়। ১৯৭০ সালে ভারতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে গুটিবসন্ত। টিকা থাকার পরও এ মহামারিতে লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়ে এক বছরে ২০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। ১৯৮৪ সালে প্রথম এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত হয়। এই ভাইরাসের দ্বারা ঘটিত এইডস রোগে সে বছরই আমেরিকায় ৫ হাজার ৫০০ মানুষ মারা যায়। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে ৩৫ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত এবং এ পর্যন্ত এইডসে মারা গেছে আড়াই কোটির বেশি মানুষ।

২০০৩ সালে মহামারির তালিকা আরও দীর্ঘ করতে যুক্ত হয় সার্স। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। সমগ্র বিশ্বে কয়েক লাখ মানুষ সার্স দ্বারা সংক্রমিত হয়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু হওয়ায় মাত্র ৬ মাসের মধ্যে তা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং ৭০০ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুতে ১৮ হাজার ৫০০ জনের মৃত্যু হয়। তবে ধারণা করা হয়, এতে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখ ৭৫ হাজার। ২০১০ সালে হাইতিতে কলেরা মহামারি রূপ নিলে ১০ হাজার মানুষ মারা যায়। ২০১২ সালে ভাইরাসজনিত হামে মারা যায় ১ লাখ ২২ হাজার মানুষ। একই বছরে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ টিউবারকিউলোসিসে মারা যায় ১.৩ মিলিয়ন মানুষ।

আবার ২০১২ সালে সৌদি আরবে মার্স ভাইরাসের অস্তিত্ব শনাক্ত করা হয়, যা উটের মাধ্যমে ছড়ায়। এর দ্বারা আক্রান্তদের ৩৫ শতাংশ মারা যায়। এটি মানুষে ছড়িয়েছে হাঁচি-কাশি, নিকট অবস্থান ইত্যাদির মাধ্যমে। ২০১৪ সালে আফ্রিকায় ইবোলার আঘাতে মারা যায় ১১ হাজার ৩০০ জন। ২০১৯ সালে এশিয়ার কয়েকটি দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর ছড়িয়ে পড়ে। এর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত না হওয়ায় প্রতিরোধই এর থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায়।

১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিকের সময় দেশে দেশে সরকার মানুষকে মাস্ক পরার আইন পাস করে, বড় জমায়েত নিষিদ্ধ করে দেয়, বাজারে লোকসমাগম নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানের করোনা প্যানডেমিকের সঙ্গে তখনকার ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিকের অনেক সাদৃশ্য লক্ষণীয়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করতে পারিনি। ২০০৩ সালে সার্স মহামারি আকারে আসে। কোভিড-১৯ সার্স মহামারিরই একটি রূপ। ২০১২ সালে মার্সও সংক্রমিত হয় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। বর্তমানের কোভিড-১৯–এর ক্ষেত্রেও তা–ই।

পৃথিবীতে প্রতিটি শতাব্দীতে এমনই অনেক মহামারি আঘাত হেনেছে। হয়তো এটি প্রকৃতিরই প্রতিশোধ। মহামারির কারণে যুগে যুগে অনেক সভ্য জাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, যার সংখ্যা নেহাতই কম নয়। কোটি কোটি মানুষ যারা মহামারি নামক যুদ্ধে নিজের প্রাণ হারিয়েছে, তারা আজ আমাদের কাছে কেবলই একটি সংখ্যা, কিন্তু তারা হয়তো দেশ ও সমাজের অমূল্য সম্পদ হতে পারত। তাই সবার উচিত হবে অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে চলা এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হওয়া।

*লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ। [email protected].