করোনা এবং এক মধ্যবিত্ত বেকার যুবকের সংগ্রাম

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

হারিয়ে ফেলা, মুছে যাওয়া কিংবা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো বিয়োগসূচক শব্দগুলোর যদি কোনো যুগোপযোগী সমার্থক শব্দ থেকে থাকে, তা হবে ‘করোনা’। কয়েক মাস ধরে পৃথিবীর অর্থনীতির চাকা বিকল হয়ে আছে, যে চক্রপ্রক্রিয়ায় মানুষ তার জীবন ধারণের জন্য জীবিকার সংগ্রহ করে থাকে। আজ স্থবির হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বের কর্মসংস্থানের উৎস। করোনা মহামারির তাণ্ডবে আমেরিকার চাকরির বাজার আজ লন্ডভন্ড, সেখানে বেকারত্বের হার বেড়ে ১৪.৭ শতাংশে এসেছে, যা আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে আসছে সময়ে। ইউরোপের আরেক শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ ইতালিতেও ঠিক একই অবস্থা, সেখানেও বেকারত্বের হার এখন ১১.২ শতাংশ, ইন্ডিয়ায় যা প্রায় ২৬ শতাংশের মতো ছিল গত এপ্রিল মাসে। চায়নায় বেকারত্বের হার এই মুহূর্তে প্রায় ১০ শতাংশ, ইংল্যান্ডে ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম সবচেয়ে বেশি লোক একসঙ্গে কর্মহারা, যা কিনা প্রায় ২.১ মিলিয়ন। ঠিক একইভাবে জার্মানি এবং জাপানের মতো অর্থনৈতিক দানব দেশগুলোতেও ব্যাপক পরিমাণ বেকারত্ব বেড়েছে।

পৃথিবীর যেকোনো দেশেই বেকারত্ব হচ্ছে একটি অভিশাপ, জাতীয় জীবনে তার প্রভাব যেমন নিম্নমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে যার ফল হচ্ছে হতাশা, পারিবারিক কলহ এবং বিচ্ছেদ। বাংলাদেশের মতো একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে সত্যিই এটি একটি দুঃস্বপ্নের মতো, যেখানে মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের প্রতিদিনের গড় উপার্জন ২ ডলার থেকে ২০ ডলারের মধ্যে। আরও এক জরিপে দেখা গেছে যে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২১.৮০ শতাংশ বা ৩ কোটি ৬০ লাখ নাগরিক জাতীয় দারিদ্র্যসীমারেখার নিচে বসবাস করে, যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ আছে হতদরিদ্র। এই বিশাল অঙ্কের মধ্যবিত্তের ৪৮.৪ শতাংশের কর্মসংস্থানের জোগান দেয় ব্যক্তিমালিকানা প্রতিষ্ঠান, এর ২০.৪ শতাংশের জোগান দেয় সরকারি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সরকারের এক জরিপে উঠে আসে বর্তমানে দেশে ২.৬ মিলিয়ন লোক বেকার, যার মধ্যে ১.৮২ মিলিয়ন আছে, যারা গ্রামে বসবাস করে, আর.৭৭ মিলিয়ন বেকার যারা শহরে বসবাস করে। এই যখন আমাদের প্রতিদিনের সাধারণ জীবনের চিত্র সেখানে করোনার ভয়াল থাবা কতটুকু বিভীষিকাময় ও ভয়ংকর করে তুলতে পারে এই বেকারত্বের সংখ্যা এবং তাদের পরিবারের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে, খুব কাছে থেকে না দেখলে তার বাস্তবতা উপলব্ধি করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।

সেই প্রয়াসেই করোনাকালীন একটি বাস্তব জীবনের গল্প তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। ছোট একটি মধ্যবিত্ত পরিবার, বাবা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন, টুকটাক কৃষিকাজ করেন আর বাজারে একটি মুদির দোকান আছে। জীবনের অনেক স্বপ্নই তাঁকে ধরা দেয়নি, কোনো না কোনো এক অজুহাতে শত সহস্ত্র অপূর্ণতাকে সঙ্গী করে জীবন চলেছে তাঁর আপন গতিতে। বাবার একমাত্র ছেলে শফিক (ছদ্মনাম) যাঁকে ঘিরেই কল্পনায় এক অদেখা ভুবন এঁকে রেখেছেন বাবা, সেখানে থাকবে স্বপ্নপূরণের সব স্বাদ, আর গৌরবের সঙ্গে বেঁচে থাকার সুখ। ছেলের জীবনের যেকোনো সফলতার খবরই তাঁর বাবার জন্য অনেক গৌরবের এবং সুখের খোরাক। তাই তো বাজারের কোনো চায়ের স্টল কিংবা দোকানের বেঞ্চে বসে তাঁর মুখে শুধু ছেলের সফলতার গল্পই শোনা যায়। অনুরূপভাবে ছেলেও বাবার সুখে জীবন দিতে প্রস্তুত। ছেলে এখন শহরে থাকেন, বিয়েও করেছেন, একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। কিন্তু শহরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে পারাটা এতটাই কঠিন যে দিন শেষে বোধ হয় এটাই বুঝি সুখ, জীবন ও জীবিকার জাঁতাকলে শফিকের কাছে সুখের সংজ্ঞাটাও আজ অস্পষ্ট।

করোনার ভয়াল থাবায় শফিক আজ এক অভিশপ্ত বাস্তবতার মুখোমুখি, আর তা হচ্ছে আজ তিনি চাকরিহারা। হাতে জমানো অত টাকাও নেই যা দিয়ে বাড়ি ভাড়া এবং সংসার চালানো সম্ভব একটি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। বাবার সঙ্গে শফিকের প্রতিদিনই কয়েকবার করে কথা হয়, কিন্তু বলবেন বলবেন করেও বাবাকে শফিক তাঁর নির্মম পরিস্থিতির কথা বলতে পারেন না। কারণ, বাবার চোখে আজ যে আশা আর অহংকার বিরাজ করছে ছেলেকে ঘিরে, তার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ শফিকের অব্যক্ত কষ্টগুলো। নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা শফিককে এতটা ঘিরে ধরেছে যে মনের অজান্তেই তাঁর চোখে পড়ে যায় ঘরের এক কোনায় রাখা চাল-ডালের কৌটা কিংবা তেলের বোতলের দিকে এবং হিসাব করতে থাকেন আর কত দিন চলতে পারবে অবশিষ্ট দিয়ে। শহরে তাঁর এমন কেউ নেই যে ধার নিয়ে কিছুদিন চলতে পারবেন, আর এই দুর্দিনে সবার মাঝেই ধার দিতে একধরনের অসম্মতি কাজ করে। আজ হতাশার ঘন কুয়াশায় শফিক নিজের আত্মবিশ্বাসকে হারাতে শুরু করেছেন। মহামারির প্রবল প্রলয়ে শফিকের জীবনসংগ্রামে টিকে থাকার ইচ্ছা আর সামর্থ্য আজ দ্বিধাবিভক্ত।

এটা তো ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি শফিকের গল্প, এ রকম লাখো শফিক আজ দেশের এই চরম বাস্তবতার কাছে নিরুপায়, নির্বাক। অন্তরে আহাজারি কিন্তু মুখে বোবা কান্না, কারণ তাঁরা সমাজের কাছে মধ্যবিত্ত, তাঁরা শিক্ষিত, সেহেতু তাঁদের অন্তরে রক্তক্ষরণ হলেও শরীরে তা মানায় না।

*এজিএম, ওপেক্স গ্রুপ। [email protected]