স্বরবর্ণে শৈশব

অ.

অনেক আগের কথা। টাঙ্গাইলে ১৯৯২ সালে প্রথম গান পরিবেশন। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে বাবা ছিলেন প্রধান অতিথি। আমি কোলে বসা। আমাকে ছড়া বলতে বলা হয়। আমি গিয়ে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’ গানটি বলে বাবার কোলে এসে বসলাম। সেই থেকে গানের ওস্তাদ রেখে দিলেন বাবা। পরে বাংলাদেশ বেতারে ‘অন্বেষা’তে বাবার সঙ্গে অংশগ্রহণ। পরে বহুবার বিটিভিতে ‘নিবেদন’ অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যেই সংগীত পরিবেশন।

আ.

‘আগুনের পরশমণি’ কোনো এক ১৬ ডিসেম্বরে বিটিভিতে দেখে হুমায়ুন আহমেদের ভক্ত হয়ে যাই। সঙ্গে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ সেলুলয়েডে দেখার অভিজ্ঞতা।

ই.

ইছামতীর পাড়ে সেই যে ছোট্ট সোনার গাঁ

সবাই ডাকে মধুমতি, আমি ডাকি মা

আঁকাবাঁকা মেঠো পথের পাশে

আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা, ইত্যাদি

সুরকার ও গীতিকার লোকমান হোসেন ফকিরের কাছে গান শেখা। তিনি বাবার বন্ধু ছিলেন বলে নিজেই শিখিয়েছেন। তাঁর গানের সমগ্র আর সুর করা ক্যাসেট উপহার শৈশবের পরম প্রাপ্তি।

ঈ.

ঈদ হতো দাদাবাড়ি জয়পুরহাটে। শৈশবেই দাদা মহররমের সময় কাজী নজরুল ইসলামের ‘মহররম’ কবিতা পড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশুতোষ গান শেখাতেন। ঈদে টাঙ্গাইল থেকে জয়পুরহাট যাওয়ার সময় যমুনার ঘাটে এবং ফেরিতে নদীর পাঙ্গাশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়া ছিল প্রধান আকর্ষণ। পুকুরে মাছ ধরা, বিলে মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, গাছে ওঠা ছিল ঈদের আনন্দ। দাদা ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন বলে শেক্‌সপিয়ার সম্পর্কে জানাতেন। কাশিরাম দাসের ‘মহাভারত’ পড়তেন বাবা আর আমরা সবাই গোল হয়ে বসে শুনতাম। শরৎ, বঙ্কিম, মানিক পড়া হতো দাদার নিজস্ব পাঠাগার থেকে।

উ.

উপহার যা পেতাম, অধিকাংশই ছিল বই আর গানের ক্যাসেট। যদিও খেলনার দিকে আগ্রহটা ছিল বেশি। বাসায় ফিরোজা বেগম, কিশোর কুমার, জগজিৎ সিং, আবিদা পারভীনের গজল বাজত বেশি। ঘুম ভাঙত রবি ঠাকুরের গানে।

ঊ.

ঊনসত্তরের গণ–অভ্যুথানের উপন্যাস খুব কষ্টে জেনেছিলাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ পড়ে। বাবা বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন বলেই সাহিত্যের চর্চা তেমন আগ্রহ না থাকলেও তখন পরিবেশের কারণে হয়ে যেত।

ঋ.

ঋত্বিক ঘটক মস্তিষ্কে জায়গা পেল। কিন্তু তাঁর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখে তখন কিছুই বুঝিনি। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের ছবি দেখে অবসর কাটত। তখন থেকেই সিনেমা বানানের আগ্রহ। পোস্টার বানিয়ে বাসার বিভিন্ন জায়গায় টাঙানো, মায়ের উৎসাহ। ক্যামেরা কিনে দিলেন বাবা। ছবি তোলার নেশায় স্কুল ফাঁকি। ধরা খেয়ে আবার গাছ লাগানোর নেশা, ডাকটিকিট সংগ্রহের নেশা।

এ.

‘একান্নবর্তী’ নাটক দেখে তিন্নির প্রতি ভালো লাগা। তিন্নি সম্ভবত এখন অভিনয় করেন না। রবিবাবুর গল্পগুচ্ছের ‘একরাত্রি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ। ভালো লাগতে শুরু হলো ছোটগল্প। প্রয়াত রাষ্ট্রপ্রধান এইচ এম এরশাদের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎ হওয়া। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আমাদের টাঙ্গাইলের বাসায় পারিবারিক আবহের স্মৃতি বিশেষভাবে স্মরণীয়।

ঐ.

ঐ যে কৃষাণ

কাটছে ধান।

প্রথম লেখা। লালনের গান শিখতে গিয়ে লোকসংগীত জানা। রথীন্দ্রনাথ রায় বাবার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধু হওয়ার কল্যাণে তিনি বাসায় এসে গানের পরামর্শক হলেন। তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ শৈশবের পরম প্রাপ্তি। বাবার আরেক বন্ধু সংগীতশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদও এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।

ও.

ওষুধ আর ওজুহাত দুটোই ছিল অ্যালার্জি। ভেষজ বিষয় ভালো লাগত। ওয়াদা রক্ষা করার শিক্ষা পেয়েছিলাম নবী করিম (সা.)–এর জীবনী থেকে।

ঔ.

ঔপন্যাসিকদের তেমন জানা হয়নি শৈশবে। তেমন আগ্রহ ছিল না। ঔদাস্য বলা চলে। দীর্ঘ লেখা, Narration এড়িয়ে যেতাম।

ং.

বাংলা, রং, ব্যাঙের বিষয়ে বেশ আগ্রহ বোধ করতাম। বাংলা আর বঙ্গবন্ধুর প্রতি।

ঃ.

দুঃখ হতো কেন ছোট আছি। আর শাহরুখ খানের মতো কেন নই। আবার কখনো মাদার তেরেসার মতো হতে ইচ্ছে হতো।

ঁ.

‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’, শিখতে গিয়ে পাশের বাসার বাবার সহকর্মী চাচা এসে ওস্তাদকে ইসলামের জ্ঞান দিলেন, তারপরের সপ্তাহ থেকে তিনি আর এলেন না।

* সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]