কালো মানুষের জীবন

দেয়ালচিত্রে জর্জ ফ্লয়েড
দেয়ালচিত্রে জর্জ ফ্লয়েড

নদীর জল ঘোলা ভালো

জাতের মেয়ে কালো ভালো

ছয় ফুট লম্বা দুধে আলতা নানাভাই, আর নানু অনূর্ধ্ব পাঁচ ফুট, রং শ্যামবর্ণ! আত্মীয়-পরিজন নানাভাইকে আবারও বিয়ে করাতে উদ্যমী হলেও কানে তোলেননি, নানুকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আমি নানুকে কালো মেমসাহেব বলে ডাকি, আর গাঁয়ের রং নিয়ে খোঁচাও দিই মজা করে। নানু আমার সাবলীলভাবে ওপরে লেখা দুটো লাইন শুধু উচ্চারণ করেন এখনো দৃপ্ত কণ্ঠে...

সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড পুলিশের কাছে নিগৃহীত হয়ে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন। জর্জ ফ্লয়েড একজন কৃষ্ণাঙ্গ আর সেই পুলিশ ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ, এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু ঝামেলা হলো তখন, যখন জর্জকে শুইয়ে তার গলা হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে ছিল পুলিশ আর তিনি তখন কাতর কণ্ঠে মুক্তি চেয়েছিলেন। তাঁর সবশেষ উচ্চারণ ছিল, ‘আমাকে মেরো না। আমাকে ছেড়ে দাও। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে...’।

ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতার জর্জের অতীত ইতিহাস পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল ছিল না, বরং কলঙ্কের কিছু দাগ তাঁরও ছিল। বিবিসির সূত্রে জানতে পারি, তিনি স্কুলজীবনে ফুটবল, তারপর বাস্কেটবল খেলে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। মাঝখানে হিপহপ গেয়েছেন বেশ ভালো। তবে সঙ্গদোষে বর্ণবৈষম্যের প্রতিবাদে নিজেও সহিংস হয়েছেন, লুটপাটে অংশ নিয়ে জেলও খেটেছেন কিছুকাল। তারপর বোধোদয় হয়েছে, স্থানীয় গির্জার অধীনে সামাজিক কাজে অংশ নিয়ে নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করেছেন। তরুণ-যুবাদের উদ্দেশে তিনি একটি ভিডিও বার্তা দিয়ে বেশ আলোড়ন তুলেছিলেন। সহিংসতা ছেড়ে সুন্দর জীবনের আহ্বান জানিয়েছিলেন...।

সবশেষ কর্মক্ষেত্র ছিল একটি পানশালায় নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি। সুঠাম দেহের দীর্ঘকায় এই জর্জ বাউন্সার হয়ে বেশ ভালোই জীবন যাপন করছিলেন। সাম্প্রতিক করোনা মহামারিতে পানশালা বন্ধ, তিনি কর্মহীন জীবনে ক্লান্ত তখন। তাঁকে মৃত্যুর আগে আটক করা হয়েছিল এই অপরাধে যে তিনি ২০ ডলারের একটি জাল নোট দিয়ে সিগারেট কিনতে চেয়েছিলেন! এই অপরাধে তাঁর শাস্তি হতেই পারত, হওয়া উচিত। কিন্তু তাঁকে দেওয়া হলো...।

আইনশিক্ষার একজন দূরবর্তী ছাত্র হয়ে বলছি, আইনের দর্শন খুব স্পষ্ট: প্রয়োজনে ১০ জন অপরাধী বেরিয়ে যাক, তবু একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন বিনা দোষে শাস্তি ভোগ না করেন। কিন্তু আমরা আইনের শাসন দিতে গিয়ে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হচ্ছি।

ছোটবেলায় স্কুলের বড় আপা একদিন বললেন, ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না।’ আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপা, বুঝি নাই!’ তখন কাঠকয়লা দিয়ে দাঁত মাজা হতো। রান্নায় ব্যবহৃত উনুনে গাছের লাকড়ি পুড়ে কয়লা হতো। আপার পরামর্শ শুনে একদিন একটি বড় এক টুকরো কয়লা নিয়ে সাদা লাক্স সাবানে ধুয়ে পরিষ্কার করতে চাইলাম। সাদা লাক্স কর্দমাক্ত হলো আর কয়লা আকারে ছোট হলেও রং পরিবর্তন হলো না! বুঝলাম, কয়লা ধুলেও সেটা কয়লাই থেকে যায়।

কিন্তু আমরা তো মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব। আমাদের বিবেক আছে, বিবেচনাবোধ আছে। আমাদের মন পলিমাটির মতোই নরম আর শিমুল তুলার মতো কোমল। প্রয়োজন শুধু মানবীয় মূল্যবোধের বিকাশ...

কালো সাহেবের মেয়ে
ইশকুল পালিয়ে

ধরতে তোমার দুটো হাত

কত মার খেয়েছি

মুখ বুজে সয়েছি

অন্যায় কত অপবাদ

বয়স তখন ছিল পনেরো

তাই ছিল স্বপ্ন দেখার ব্যারাম

মাথার ভেতর ছিল এলভিস প্রিসলি

খাতার ভেতর তোমার নাম

ম্যারিয়েন, ম্যারি ম্যারি এন

ম্যারিয়েন, ম্যারি...

আমাদের তারুণ্যে অঞ্জন দত্তের গাওয়া এই গান কে গায়নি? তবু ‘বংশের ইজ্জত রাখতে হলে বউ হতে হবে ফরসা’, তাই ম্যারিয়েনকে আর বিয়ে করা হয় না।

রবি ঠাকুরের ‘কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি’, আসলে কীই-বা আমরা বলতে পারি, বলেন? কালো বর্ণে আমাদের অ্যালার্জি মজ্জাগত, এটা আমাদের জন্য লজ্জার কথা। কালোকে আরও বিকৃত করে কাইল্লা বলেও ডাকি। অথচ আমরা ক্রিস গেইলের ক্রিকেট, পেলে, রোনাল্ডোর ফুটবল, ভেনাস সেরেনার টেনিস, টাইগার উডসের গলফ, অ্যাথলেট উসাইন বোল্ডের উদ্‌যাপনে উচ্ছ্বসিত হই, যাঁদের সবাই কালো। মাইকেল জ্যাকসন এই কারণেই গাঁয়ের রং সাদা করতে চেয়েছিলেন? একের পর এক সার্জারি ও মেডিসিন নিয়েছেন।

দূরসম্পর্কের একজন মামি তাঁর বিয়ের পর একদিন গল্পের ছলে বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় আব্বাকে একটা লাল জামা কিনে দেওয়ার জন্য বায়না করেছিলাম ঈদে। তিনি দেননি, গাঁয়ের রং কালো বলে! যদি কেউ বলে টিক্কায় আগুন লেগেছে!’ হুঁকার কলকিতে তামাক সাজিয়ে পোড়ানোর জন্য কয়েনের মতো গোলাকার, বাতাসা আকৃতির টিক্কার এক পাশে আগুন জ্বালিয়ে দম দিলেই টানে টানে জ্বলজ্বল করে ওঠে রক্তলাল আগুন। সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তখন পণ করেছিলাম, বড় হয়ে মামিকে একটা টকটকে লাল শাড়ি কিনে দেবই...

কালো মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা প্রায় তিন দশকের কারারুদ্ধ জীবন ভুলে ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় নেমে এসেছিল শান্তি।

একজন জর্জের মৃত্যু মেনে নেয়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। করোনা মহামারির চূড়ান্ত পর্ব অতিক্রম করছে তারা। মৃত্যুর মিছিলে স্তব্ধ জনপদে এখন ক্ষোভের আগুন। করোনা-ভয়কে পেছনে ফেলে তাঁরা পথে নেমেছেন কারফিউ উপেক্ষা করে। প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউস তাঁরা ঘেরাও করে রেখেছেন। এই সুযোগে সুপারশপে, শপিং মলে লুটপাট চলছে। পুলিশ পিপার স্প্রে, ট্রিয়ার শেল, লাঠিচার্জ করছেই। তবু ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সহিংস এই আন্দোলনে লুটপাট বর্ণবৈষম্য ইস্যুটিকে হালকা করে দিতে পারে।

শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ডিভোর্স দিচ্ছেন, খুনি স্বামীর সঙ্গে একই ছাদের নিতে তিনি থাকবেন না আর। তবু জামিন পেয়েছেন সেই অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য!

একজন বাংলাদেশি মালিকের রেস্তোরাঁ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি শান্ত কণ্ঠে বলেছেন, রেস্তোরাঁ পুড়ে যাক, তবু ন্যায়বিচার হোক। যেকোনো হত্যা ও অপরাধের জন্য আমরা সোচ্চার প্রতিবাদ জানাব, নিশ্চয়ই মানবতার পাশেই থাকব। তবু চাই, দাবি উত্থাপনের পাশাপাশি আমরা অহিংস আন্দোলনের পথেই হাঁটব...।

শান্তির জন্য ন্যায়বিচার আবশ্যক।

জর্জ ফ্লয়েড হত্যার বিচার চাই...।